এই নবসৃষ্ট সাহিত্যকর্মসমূহের লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য হলো, তাতে নতুন সামাজিক চাহিদার জবাব রয়েছে। জনগণ যে ধরনের রসালো কাহিনী শুনতে আগ্রহী সে ধরনের কাহিনীই লেখকরা পরিবেশন করেছেন। মুসলমান এবং হিন্দু সাহিত্যস্রষ্টারা আপনাপন সমাজের দিকে লক্ষ্য রেখেই সৃষ্টিকর্মে মনোনিবেশ করেছেন। মুসলমানদের তুলনায় হিন্দু কবিদের অনেকগুলো সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক সুযোগ বিদ্যমান ছিল। প্রথমত আক্রমণমুখী বর্ধিষ্ণু মুসলমান সমাজের সঙ্গে সংঘাতে হিন্দু সমাজের তলা পর্যন্ত কেঁপে উঠেছিল। আত্মরক্ষার প্রয়োজনটাই ছিল তাদের কাছে বড় কথা। হিন্দু কবিরা এই সামাজিক ভীতির সঙ্গে একাত্মবোধ না করে পারেননি। আত্মরক্ষার প্রয়োজনে যখনই কোনো নতুন সামাজিক পরিবর্তন এবং নবতরো মূল্যচেতনা সমাজের অভ্যন্তর থেকে সূচিত হয়েছে, তার প্রাণবস্তুটি সাহিত্য-স্রষ্টাদের কণ্ঠে আপনা থেকেই কথা কয়ে উঠেছে। আর মুসলমান শাসনামলে হিন্দু সমাজের যে সামাজিক রূপান্তর ঘটছিল তাতে সংস্কৃতিগত ব্যবধান ছিল না, নিজেদের সংস্কৃতিকে নিজেদের প্রয়োজনে নতুনভাবে রূপদান করেছিলেন। যেখানে বিষয় এবং বিষয়ীর সঙ্গে কোনো দূরত্ব বা বিরোধ নেই। সমাজের পূর্বাৰ্জিত সামাজিক অভিজ্ঞতাসমূহকে পূর্ণ বিশ্বাসে আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গে কাজে লাগাতে পেরেছিলেন। মুসলমান পুঁথিলেখকদের তুলনায় হিন্দু কবিদের রচিত সাহিত্যকর্মে যে অধিক মানসিক পরিশ্রুতি, গঠনপরিপাট্য এবং কাণ্ডজ্ঞানের পরিচয় পাওয়া যায়, তার কারণ তাদের সম্পূর্ণ অজানা একটি বিষয়ের প্রতি ধাবিত হতে হয়নি।
তুলনামূলক বিচারে মুসলমান পুঁথিলেখকদের হাতে সে পরিমাণ সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক সুযোগ সুবিধে ছিল না। প্রথমত তাদেরকে সম্পূর্ণ অজানা একটি বিষয়কে প্রকাশ করতে হয়েছিল। ইসলাম ধর্মের আসল স্বরূপ, তার দার্শনিক প্রতীতি ইত্যাদি সম্বন্ধে মুসলমানদের আরবী ফার্সীতে লেখা গ্রন্থসমূহের বদলে লোকশ্রুতি এবং দূরকল্পনার উপর নির্ভর করতে হয়েছে। একথাও সত্য যে, পুঁথিলেখকদের অধিকাংশেরই আরবী ফার্সী সম্বন্ধে কোনো জ্ঞান ছিল না। তাছাড়া হিন্দুদের দেব-দেবী এবং কাব্যোক্ত নায়ক-নায়িকাদের প্রতি মনে মনে একটি বিদ্বেষের দূরস্মৃতিও সক্রিয় ছিল। কেননা এই দেবদেবীর পূজারীদের অত্যাচার এবং ঘৃণা থেকে অব্যাহতি পাবার আশায় তাদের পূর্বপুরুষেরা প্রথমে বৌদ্ধ ধর্ম এবং পরে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। তাই মুসলমান পুঁথিলেখকেরা তাদের রচনায় যখনই সুযোগ পেয়েছেন, এই দেবদেবীর প্রতি তাচ্ছিল্য এবং ঘৃণা প্রকাশ করতে কুণ্ঠাবোধ করেননি। কিন্তু তা সত্ত্বেও হিন্দু সমাজের দেবদেবী, নায়ক-নায়িকার প্রভাব থেকে তাদের মন মুক্ত হতে পারেনি। তাই তারা সচেতনভাবে এই দেবদেবীদের প্রতিস্পর্ধী নায়ক এবং চরিত্র যখন খাড়া করেছেন, এই সৃষ্ট চরিত্রসমূহের মধ্যেই দেবদেবী নতুনভাবে প্রাণ পেয়েছে। হজরত মুহম্মদ, হজরত আলী, আমীর হামজা, মুহম্মদ হানিফা, বিবি ফাতেমা, জৈগুন বিবি এই চরিত্রসমূহ বিশ্বাসে এবং আচরণে, স্বভাবে চরিত্রে যতদূর আরবদেশীয়, তার চাইতে বেশি এদেশীয়। তাদের মধ্যে যে বুদ্ধিমত্তা এবং হৃদয়াবেগ কাব্যলেখক চাপিয়ে দিয়েছেন তা একান্তভাবেই বঙ্গদেশে প্রচলিত দেবদেবীর অনুরূপ। বাইরের দিক থেকে দেখলে হয়তো অতটা মনে হবে না। কিন্তু গভীরে দৃষ্টিক্ষেপ করলে তা ধরা না পড়ে যায় না। বিশ্বাস এবং অভিজ্ঞতা সাহিত্যের দুই মুখ্য উপাদান। বিশ্বাস অভিজ্ঞতার নব রূপায়নে সাহায্য করে। আলোকিত বিশ্বাস আলোকিত রূপায়ণ ঘটায় এবং অন্ধবিশ্বাস অন্ধ রূপায়ণ। মুসলমান পুঁথিলেখকদের বিশ্বাসের যে শক্তি তা অনেকটা অন্ধবিশ্বাস, কেননা ইসলামি জীবনবোধসমৃদ্ধ বিমূর্ত কোনো ধারণা তাদের ছিল না। তাই তাদের শিল্পকর্ম অতটা অকেলাসিত। প্রতি পদে কল্পনা হোঁচট খেয়েছে বলে তাদের রচনার শক্তি নেই। আলাওল, দৌলত উজির প্রমুখ মুসলমান কবি উৎকৃষ্ট কাব্যরচনা করতে পেরেছেন। তার কারণ তাদের কতিপয় সুযোগ ছিল। আলাওল নিজে আরবী, ফারসী এবং সংস্কৃত সাহিত্যে সুপণ্ডিত ছিলেন। কাব্যের স্বাভাবিকতা-অস্বাভাবিকতা সম্বন্ধে তার পরিপূর্ণ বোধ ছিল। তদুপরি তিনি রাজসভায় বসে কাব্য রচনা করেছিলেন। রাজসভায় যে-রুচি এবং জীবনাদর্শের আলোচনা চলতে পারে,জনসভাতে তা চলে না। একই কথা দৌলত উজির সম্বন্ধেও কম-বেশি প্রযোজ্য।
কিন্তু যে সকল মুসলমান কবিকে জনগণের ধর্মবোধ পরিতৃপ্তি এবং রসপিপাসা মিটাবার জন্য কলম ধরতে হয়েছিল, সেখানে কবি কি বলতে চান, কাদের জন্য বলতে চান এবং যা বলছেন তা অনুধাবনযোগ্য হচ্ছে কিনা এইসব বিবেচনার বিষয় ছিল।
.
৩.
মুসলমান সমাজের কোন অংশের সামাজিক চাহিদা পূরণ করার জন্য এই পুঁথিসমূহ লেখা হয়েছিল, এবং কারা লিখেছিলেন। তাদের বিদ্যাবত্তা এবং সাংস্কৃতিক অগ্রগতি কতদূর ছিল- তলিয়ে বিচার করলে কতিপয় বিষয় স্পষ্টভাবে ধরা পড়বে। মূলত বাঙালি সমাজের যে শ্ৰেণীটি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন এবং নতুন ধর্ম গ্রহণ করার কারণে, অধিকতরো খোলাসা করে বলতে গেলে মুসলিম রাজশক্তি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার দরুন, তাদের মধ্যে নতুন আকাঙ্ক্ষার উন্মেষ ঘটেছিল, সেই শ্ৰেণীটিতেই ছিল পুঁথিসাহিত্যের আদর সীমাবদ্ধ। তারাই এর লেখক, পাঠক এবং সমঝদার। তাছাড়া রোসাঙ ইত্যাদি রাজদরবারে বাংলাভাষা এবং সাহিত্যের যে চর্চা হয়েছে, তাতে যে সকল মুসলিম কবি-সাহিত্যিক আশাতিরিক্ত সাফল্য প্রদর্শন করেছেন জনগণের দৈনন্দিন জীবনধারার সঙ্গে তার সংযোগ খুব নিবিড় কিংবা গভীর ছিল না। রাজসভার বিদ্যাবত্তা, মার্জিত রুচি বিলাসবহুল জীবনযাত্রার ধরনই অধিকাংশ ক্ষেত্রে আলাওল প্রমুখ শক্তিমন্ত কবির কাব্য-ভাবনাকে নিয়ন্ত্রণ করেছিল। আর কবিরাও ছিলেন বহুদর্শী পণ্ডিত। আরবী, ফার্সী এবং সংস্কৃত ভাষাতে ছিলেন সমান পারদর্শী। তাদের সাধনার মধ্যে কাব্যের ঔচিত্যবোধ জখম হয়নি বটে, কিন্তু জনগণের জীবনধারার সমতলে এসে চাহিদামতো কাব্যরচনা তাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। জনগণের সঙ্গে অনেকটা সম্পর্কহীন জ্যোৎস্নাভুক সৌন্দর্যবিলাসী ছিলেন বলেই তাদেরকে কাব্যের সামাজিক আদর্শ নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামাতে হয়নি। আরবী ফার্সী থেকে যে কোনো কাহিনী অনুবাদ করে রসসমৃদ্ধ ভাষায় প্রকাশ করতে পারলেই তাদের দায়িত্ব শেষ হয়ে যেত এবং তাদের সে যোগ্যতায় ঘাটতি ছিল না।