ইতিহাসে হজরত আলীকে কম বিচক্ষণ বলার যথেষ্ট অবকাশ আছে। কিন্তু তিনি মানুষ হিসেবে উদার মনের অধিকারী ছিলেন এবং তার চরিত্র এমন নির্মল সুন্দর ছিল যে এখনো পর্যন্ত তার গুণগ্রাম সর্বসাধারণের অনুকরণীয় বলে বিবেচনা করা হয়। পুঁথিলেখক তাকে শক্তিমন্ত এবং বীর দেখাতে গিয়ে পশুশক্তিতে বলীয়ান হৃদকম্পসৃষ্টিকারী একজন প্রায় নারীলোলুপ মানুষের চিত্র অঙ্কন করেছেন।
হজরত হামজা মদিনাতে ওহোদের যুদ্ধে শহীদ হয়েছিলেন এবং হিন্দা নাম্নী জনৈকা কোরেশ রমণী যে তার রক্তাক্ত হৃৎপিণ্ড চিবিয়ে খেয়েছিলেন একথা সর্বজনবিদিত। তিনি জীবনে মক্কা-মদীনার বাইরে কোথাও গিয়েছেন কিনা সন্দেহ। পুঁথিলেখক তাকে শতাধিক বছর পরমায়ু দান করেছেন, কমপক্ষে অর্ধশত পত্নীর স্বামী, সে অনুপাতে পুত্র পৌত্রাদি উপহার দিয়েছেন। আমির হামজা হাজারখানেক যুদ্ধে বিজয়ী বীর, দেশ-দেশান্তরে তার তো অবারিত গতায়ত, এমন কি দৈত্যের দেশ কো-কাফে গিয়েও অসম সাহসিক কাজ সামাধা করে এসেছেন। হিন্দু সমাজের বীরেরা যদি পাতাল বিজয় করে বহাল তবিয়তে ফিরে আসতে পারেন, আমির হামজা দৈত্যের দেশে গমন করে তাদের শায়েস্তা করে আসতে পারবেন না কেন? ঐতিহাসিক চরিত্র হিসেবে মুহম্মদ হানিফার মূল কাণ্ড কিছু নেই বলেই তো সুবিধে। কল্পনা যেভাবে ইচ্ছে বিচরণ করতে পেরেছে। হিন্দুদের দেবতা শ্রীকৃষ্ণ যদি বৃন্দাবনে মোলশত গোপবালা নিয়ে লীলা করতে পারেন, মুহম্মদ হানিফার কি এতই দুর্বল হওয়া উচিত যে মাত্র এ কয়টা ব্রাহ্মণ কন্যাকে সামলাতে পারবেন না!
.
২.
এই ধরনের দো-ভাষী পুঁথিসমূহের বিষয়বস্তুর প্রতি দৃষ্টিপাত করলে কতিপয় বৈশিষ্ট্য পাঠকের চোখে পড়বেই। সেগুলোর মধ্যে অত্যন্ত প্রণিধানযোগ্য কয়েকটি হলো: প্রথমত ধর্মের মাহাত্ম্য বর্ণনা করার জন্যই এই সকল কাহিনী লেখকরা প্রবৃত্ত হয়েছেন। নায়কের অসাধারণ শৌর্যবীর্য এবং অসমসাহসী ক্রিয়াকলাপের অন্তরালে সত্য ধর্মের বিজয়ই স্কুরিত হচ্ছে,এটা স্বদেশবাসীর কাছে স্বদেশী ভাষায় প্রকাশ করাই বেশির ভাগ লেখকের মনোগত অভিপ্রায়। মহাভারতের বাংলা অনুবাদক যেমন বলেছেন: মহাভারতের কথা অমৃত সমান। কাশীরাম দাস কহে শুনে পুণ্যবান! তার অনুকরণ করে পুঁথিলেখকও পাঠক এবং শ্রোতাদের কাছে লোভনীয় আবেদন রেখেছেন। একটা দৃষ্টান্ত: অধীন ফকির কহে কেতাবের বাত, যেবা শুনে বাড়ে তার বারেক হায়াত। এজাতীয় হৃদয় মনে উচ্চাকাঙ্ক্ষা সৃষ্টিকারী আশাব্যঞ্জক পঙক্তিমালা পুঁথিগুলোর পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায় ছড়িয়ে রয়েছে। সুতরাং বিশ্বাস করতে দ্বিধা থাকা উচিত নয় যে মানুষের মনে ধর্মবোধ জাগ্রত করা এবং ইসলাম ধর্মাশ্রিতমানুষের হাতে যে সাংসারিক সম্পদ, সুন্দরী নারী আপনাআপনি এসে পড়ে এবং পরকালে অনন্ত সুখভোগের লীলাস্থল বেহেশত তো তাদের জন্য অবধারিত, আর শত্রুদের উপর তাদের বিজয় অর্জন সে তো একরকম স্বাভাবিকই। এই সকল বিষয় প্রমাণ করাই ছিল পুঁথিলেখকদের অধিকাংশের মনের প্রাথমিক অভিপ্রায়। দ্বিতীয়ত, এই পুঁথিসমূহের প্রতি তীক্ষ্ণ বিশ্লেষণাত্মক দৃষ্টি ফেললে একটা জিনিস বার বার চোখে পড়তে থাকে। যে সময়ে ওগুলো রচিত হয়েছিল, সে সময়কার মুখ্য গৌণ বিবদমান, বর্ধিষ্ণু ক্ষয়িষ্ণু যে সকল সামাজিক ধারা, ধারাসমূহের মধ্যবর্তী দ্বন্দ্ব সংঘাত কোথাও প্রচ্ছন্নভাবে, আবার কোথাও সুস্পষ্টভাবে পুঁথিসাহিত্যে ছাপ ফেলেছে। পুরনো সমাজের গর্ভ থেকে তুর্কী আক্রমণের ফলে আরেকটি নতুন সমাজ জন্মলাভ করেছে এবং সমাজের জনগণের একাংশের মধ্যে নতুন চলমানতার সঞ্চার হয়েছে, সেই নতুনভাবে চলমানতা অর্জনকারী জনগোষ্ঠীর মধ্যে নতুন আকাক্ষার পরিতৃপ্তি বিকাশ করার উদ্দেশ্যেই পুঁথিলেখকেরা রচনায় মনোনিবেশ করেছেন। তার ফলে তাদের মনেও নতুন এক ধরনের জনপ্রিয় বীরশ্রেণী জন্মলাভ করতে আরম্ভ করে। পুরনো সমাজের যে সকল নায়ক, খলনায়ক-রামচন্দ্র, লক্ষ্মণ, সীতা, রাবণ, ভীম, অর্জুন, হনুমান, কর্ণ, ভীষ্ম, দ্রোন, শ্রীকৃষ্ণ, রাধিকা, দ্রৌপদী ইত্যাদির কাহিনীতে ধর্মীয় এবং সামাজিক কারণে মুসলমান সমাজ মনোনিবেশ করতে রাজি ছিল না। এই নতুন সমাজের নিজস্ব নায়ক চাই, চাই নিজস্ব বীর। যাদের জীবনকথা আলোচনা করে দুঃখে সান্ত্বনা, বিপদে ভরসা পাওয়া যায়, যারা তাদের আপনজন হবেন এবং একটি আদর্শায়িত উন্নত জীবনের বোধ সৃষ্টি করতে পারবেন। এই সকল কারণের দরুন হজরত মুহম্মদ, হজরত আলী, বিবি ফাতেমা, হাসান-হোসেন, বীর হানিফা, আমির হামজা, হাতেমতাই, রুস্তম ইত্যাদি চরিত্র বাংলা সাহিত্যে নবজন্ম লাভ করে। তাদের জন্ম প্রক্রিয়ার মধ্যে দুটি মুখ্য বিষয় মিলমিশ খেয়েছে। এই ঐতিহাসিক মহামানবদের যে সকল কীর্তি-কাহিনী লোকশ্রুতি জনশ্রুতি আকারে তাদের কাছে এসে পৌঁছেছে (পুঁথিলেখকদের অধিকাংশই আরবী ফার্সী ভাষা জানতেন না এবং ইসলামি শাস্ত্রে পারদর্শী ছিলেন না) তার সঙ্গে মহামানব এবং সামাজিক নায়কদের সম্পর্কে প্রচলিত যে ধারণা তৎকালীন সমাজে বলবৎ ছিল তার সংশ্লেষ ঘটেছে। তাই ইসলামের ইতিহাসের দিকপালদের নিয়ে রচিত পুঁথিসাহিত্যে যেমন চরিত্রের ঐতিহাসিকতাকে পাওয়া যাবে না, তেমনি বাঙালি সমাজের প্রচলিত বীরদের সম্বন্ধে যে ছকবাঁধা ধারণা বর্তমান ছিল তাও পুরোপুরি উঠে আসেনি। দুটি মিলে একটি তৃতীয় বস্তুর সৃষ্টি হয়েছে। আসলে পুঁথিসাহিত্য হলো দুটি পাশাপাশি সমাজব্যবস্থা এবং সামাজিক আদর্শের ঘাত-প্রতিঘাতে মুসলমান জনগণ যেভাবে সাড়া দিয়েছে তারই প্রতিফলন। মুসলমান জনগণের মতো হিন্দু জনগণও আরেকরকমভাবে এই সামাজিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় সাড়া দিয়েছেন, মঙ্গলকাব্যসমূহ এবং বৈষ্ণব সাহিত্যে ঘটেছে তার প্রকাশ।