উনিশশ বাহান্ন সালের ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে আমাদের জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের প্রশ্নটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল। নিজেদের ভেতরের ব্যাপার নিয়ে এত বেশি মগ্ন থাকতে হয়েছে যে, আমাদের ভাষা আন্দোলনের যে একটা আন্তর্জাতিক তাৎপর্য আছে সেদিকে তাকিয়ে দেখার মতো সুস্থির চিত্ত কখনো হতে পারিনি। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ‘ভাষাদীন’ জাতি তার ভাষায় কথা বলতে পারে না, কারণ তাকে সব সময় একটা না একটা শক্তিশালী জাতির ভাষায় কথা বলতে হয়, কাজ কারবার চালাতে হয়, মনের ভাব প্রকাশের জন্য শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ব্যর্থ প্রয়াস চালাতে হয় । এটা কোনো জাতি শখ করে করে না, বাধ্য হয়েই করে। আফ্রিকা এশিয়ার দেশগুলিতে ইংরেজি, ফ্রেন্স, ডাচ প্রভৃতি ইউরোপীয় ভাষাসমূহের যে প্রসার ঘটেছে তার মূলে যতটা জবরদস্তি, তার ছটাক পরিমাণও জ্ঞান কিংবা সৌন্দর্যপ্রীতি নেই । যুগে যুগে আমরা দেখেছি বিজয়ী বিজিত জাতির কাঁধে তার ভাষা শিক্ষার দায় চাপিয়ে দিয়েছে। চিরায়ত সাম্রাজ্যবাদের যুগ এখন অবসিত। কিন্তু পচা আদার ঝাঁঝের মতো ভাষার সাম্রাজ্যবাদী ভঙ্গি এখন কোথাও কোথাও নাক উঁচিয়ে রয়েছে। শুধু তাই নয়, কোনো কোনো দেশে কেবল সংখ্যাধিক্যের জোরে কোনো কোনো ভাষা সংখ্যালঘু ভাষাগুলো গ্রাস করার জন্য হাঙরের মতো মুখ ব্যাদান করছে। বাংলাদেশের আন্দোলনের ফলে দুটো বিষয়ই পরিষ্কার হয়েছে। একটি হলো, একটি জাতির ভাষা যতই অসমৃদ্ধ হোক না কেন দৃঢ়ভাবে ইচ্ছে করলে এ ভাষার সাহায্যেই জাতি কাজ কারবার চালাতে পারে এবং গভীর নিষ্ঠায় জাতির সামগ্রিক সৃষ্টিশক্তি নিয়োজিত করলে ঐ ভাষাকেই সমৃদ্ধ ভাষা হিসেবে বিকশিত করে তোলা সম্ভব । অন্যটি একটি দেশের অভ্যন্তরে একটি ভাষা, রাষ্ট্র শক্তির আনুকূল্যে প্রবল হয়ে অন্যান্য ভাষাগুলোর প্রাণশক্তি রুদ্ধ করে ফেলে, আস্তে আস্তে তখন ভাষাগত সংখ্যালঘু ‘ভাষাদীন’ হয়ে দাঁড়ায়। ডারুইনের মতে, ব্যবহারের অভাবে মানুষের লেজ খসে গেছে, তেমনি ব্যবহারের অভাবে ভাষার প্রাণশক্তি থিতিয়ে আসবে তা বিচিত্র কি। একটি ভাষার বিকাশ রুদ্ধ করে একটা জাতিকে চিরকালের জন্য বামুন করে রাখা সম্ভব। বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলন এই ‘ভাষাদীন’ মানুষদের হাতে একটা শক্তিশালী অস্ত্র তুলে দিয়েছে। আমাদের আশপাশের দেশসমূহে যে তার প্রভাব গভীরভাবে পড়েছে বিগত কয়েক বছরের ঘটনাতেই তার প্রমাণ মেলে। উনিশশ বাহান্ন সালের ভাষা আন্দোলন প্রমাণ করেছে, বুকের রক্ত ঢেলে মুখের ভাষার ইজ্জত রক্ষা করার হিম্মত থাকলে যে কেউ ঐ ভাষাকে আশ্রয় করেই জগতে নিজের পরিচয় ফুটিয়ে তুলতে পারে।
উপনিবেশবাদী পাকিস্তানি আমলে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাভাষার স্বীকৃতি মিলেছে। সেটা কি সত্যিকারের স্বীকৃতি? প্রকৃত সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ উপনিবেশবাদের মতো ভাষারও সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ এবং উপনিবেশবাদ রয়েছে। পাকিস্তানি আমলে বাংলাভাষা কখনো গণতান্ত্রিক মর্যাদা লাভ করেনি। সমুদ্রের জল থেকে যেমন নীলকে হেঁকে আলাদা করা যায় না, তেমনি একটি জনগোষ্ঠীর থেকে তার ভাষাকেও আলাদা করা অসম্ভব। একটি জাতির ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, ইতিহাস, জলহাওয়া, মৃত্তিকা, নদনদী, কল্পকথা, রূপকথা কত কিছুর মধ্যে শিকড়িত একটি ভাষা। বটবৃক্ষের মূল ঝুরি কেটে কাণ্ড এবং ডালপালাকে যদি বটবৃক্ষ বলে অভিহিত করা যায়, তাহলে পাকিস্তানি আমলের বাংলাও মূলহীন ডালপালাসর্বস্ব রাষ্ট্রভাষাই ছিল। আমরা কি বাংলা ভাষায় বাঙালি ঐতিহ্যের অনুসন্ধান করতে পেরেছি? আমরা কি বাঙালির সাঙ্গীতিক ঐতিহ্য, শৈল্পিক ঐতিহ্যের সঙ্গে বর্তমানের সাধনার সংযোগ স্থাপন করতে পেরেছি? আমরা কি নির্ভাবনায় বাঙালি মনীষীদের রচনা পড়তে পেরেছি? না স্বাধীনভাবে বিচার করতে পেরেছি? আমরা কি বাংলাভাষায় একখানি বই লিখে জীবনবিরোধী ধর্মীয় জাড্য কুসংস্কারের মরচেয় প্রচণ্ড আঘাত করে বাঙালি জাতির সংস্কার মুক্তি সাধন করতে পেরেছি? আমরা কি একখানি বই লিখে বাংলার সাধারণ মানুষের দুঃখ-দুর্দশা, তাদের জীবনের চারপাশ ঘিরে যে ষড়যন্ত্রের জাল, তা কি মুক্ত আলোকে দৃশ্যমান করে তুলতে পেরেছি? আমরা কি বহতা নদীর মতো সৃষ্টিশীলতার আমেজবাহী একখানা সাময়িকপত্র দীর্ঘদিন ধরে চালাতে পেরেছি? এসব কিছুই আমরা পারিনি। তবু বাংলা ছিল পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। পাকিস্তানি সংস্কৃতির প্রবক্তাবৃন্দ, যারা ইকবালকে চালু করতে চেয়েছেন রবীন্দ্রনাথের বদলে, সুসভ্য মানুষের জন্য দোভাষী পুঁথি আমদানি করেছেন, জঙ্গিলাট আয়ুব খা-ও কবিতার রসিক একথা অপরকে বিশ্বাস করাতে চেয়েছেন, মহাপুরুষ, আদমজী-দাউদেরা সাহিত্যের সমঝদার এ কথা ভুল করে ঠিক ঠাউরেছেন, স্বাধীন বাংলাদেশে তাদের দীর্ঘায়ু কামনা করি। পুষ্প চন্দন বর্ষিত হোক শিরে, তাদের পদোন্নতি ঘটুক সরকারের পররাষ্ট্র বিভাগে। তারা বাংলার সংস্কৃতি নিয়ে বিস্তর খোঁচাখুচি করেছেন এবং সাফল্যজনকভাবে অনেকগুলো চক্ৰ উপচক্রের জন্ম দিতে পেরেছেন দয়া করে তারা বিশ্রাম করুন । আমাদের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন ক্ষমাই মহত্ত্বের লক্ষণ। বাঙালি সংস্কৃতিকে ক্ষমা করে সত্যি মহত্ত্বের পরিচয় দেবেন, রক্তস্নাত বাঙালি জাতি এটা স্বাভাবিকভাবেই আশা করে। প্রধানমন্ত্রীর কাছে সনির্বন্ধ অনুরোধ, যদি অসুবিধা না হয় আমাদের সংস্কৃতির প্রাক্তন মুরুব্বিদের কূটনৈতিক দায়িত্ব দিয়ে বিদেশে পাঠিয়ে দিন। দেশে থাকলে তাদের ক্লান্ত মস্তকগুলো আবার সক্রিয় হয়ে উঠবে। যাবজ্জীবন ধরে সাম্প্রদায়িকতার বেসাতি করে যাদের নাম ধাম খ্যাতি এবং পদোন্নতি, তারা যদি পুরনো আসনগুলোতে নড়ে চড়ে ফের বসেন তাহলে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতার ভরাডুবি হবে।