এরকম অভিজ্ঞতা বোধ করি অনেকেরই হয়ে থাকে। রাশি রাশি ঘটনার মধ্যে একটি বিশেষ ঘটনার অতি সামান্য খণ্ডাংশ মুহূর্তেই ধাক্কা দিয়ে পাঠককে সচকিত করে তোলে। ‘শহীদে কারবালার’ বর্ণিত এই ঘটনাটিও সেই জাতীয় একটি। সীমার কারবালা থেকে দামেস্ক যাওয়ার পথে আজর নামধারী জনৈক ব্রাহ্মণের দেখা পেয়েছিল এবং তার বাড়িতে রাতের আতিথ্য গ্রহণ করেছিল। এই অংশটি পাঠ করার পরে মনের ভেতরে একটি ঘোরতর অবিশ্বাস মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। এই সাধারণ একান্ত বাস্তব ঘটনাটিকে পাঠকের মনের জারক রস হজম করে নিতে পারে না। মনের তলাতে শিলাখণ্ডের মতো তা পড়ে থাকে। তিনি যদি তার বদলে ইরানী, তুরানী, ইহুদী, খ্রিস্টান, তাতার, তুর্কী ইত্যাদি যে-কোনো ধর্মের মানুষের সঙ্গে সীমারের সাক্ষাৎ ঘটিয়ে দিতেন, তাহলে পাঠকের মনে কোনো প্রশ্নই জাগত না । কিন্তু তিনি কারবালা থেকে দামেস্ক যাওয়ার পথে ধু-ধু মরুপ্রান্তরে বাংলাদেশের ব্রাহ্মণকে আমদানি করলেন কোত্থেকে? একজন ব্রাহ্মণ কারবালা দামেসৃকের মাঝ পথে দারা-পুত্র-পরিবার নিয়ে কাটা মস্তকের কাছে কলেমা পড়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার জন্য বসবাস করছিল, এইখানে মন ভয়ংকর রকম বেঁকে বসে। শুধু ‘শহীদে কারবালা’ নয় ‘জঙ্গনামা’ পুঁথিটার উপর দৃষ্টি বুলালেও এই রকম অজস্র ঘটনার সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। ‘জঙ্গনামা’তে পুঁথিলেখক হজরত আলীকে দিয়ে কাফের ও বেদীনদের উপর এমন চোটপাট চালিয়েছেন যে গদার আঘাতে থেতলানো, তলোয়ারের ঘায়ে কাটা পড়া কিংবা শেষ পর্যন্ত পবিত্র ধর্ম ইসলামের শরণ গ্রহণ না করা পর্যন্ত কারো রক্ষা নেই। আমীর হামজার শৌর্যবীর্য অবলম্বন করে পুঁথি রচিত হয়েছে, পড়লে লোম দাঁড়িয়ে যাওয়ার মতো অনেক চমৎকার সংবাদ পাওয়া যায়। প্রায়শ দেখানো হয়েছে, মহাবীর হামজা এমন শক্তিশালী যে তিনি দেশ-দেশান্তর ঘুরে ঘুরে কাফেরদের সদলবলে পরাস্ত করছেন আর তাদের ঘরের সুন্দরী নারীদের পাণিপীড়ন করে চলেছেন তো চলেছেনই। কাফের এবং হিন্দু পুঁথিলেখকের কাছে অনেকটা সমার্থক। অনেক সময় কাফের বলতে হিন্দু এবং হিন্দু বলতে কাফের ধরে নিয়েছেন। সে যা হোক, আমীর হামজা এমন মস্তবড় বীর যে তিনি দৈত্যের দেশ কো-কাফে গমন করে অপার শৌর্য বলে দৈত্যদের দমন করে বীর বিক্রমে ফিরে এসেছেন। হজরত আলীর কল্পিত পুত্র মুহম্মদ হানিফার বীরত্বগাঁথা বর্ণনা করে সোনাভান, জৈগুণবিবি ইত্যাদি যে পুঁথি লেখা হয়েছে বিষয় বৈচিত্র্যের দিক দিয়ে সেগুলো আরো মজার। সে সকল পুঁথিতে দেখা যায় যে, মুহম্মদ হানিফা ‘দুলদুল’ ঘোড়ায় চড়ে দুইধারী তলোয়ার ঘুরিয়ে দেশ থেকে দেশে নব অশ্বমেধযজ্ঞ করে বেড়াচ্ছেন। পথে যেসব রাজ্য পড়ছে সবগুলো নারীশাসিত। এই নারীদের সকলেই সুন্দরী; সৎ ব্রাহ্মণ কন্যা। অবিবাহিতা এবং প্রচণ্ড রকমের বীরাঙ্গনা। আর সকলের এমন এক ধনুকভাঙা পণ যে, বাহুবলে যে পুরুষ হারাতে পারবে তাকে ছাড়া অন্য কারো কাছে বিয়ে বসতে মোটেই রাজি নন। মুহম্মদ হানিফা সংবাদ শুনে হাওয়ার বেগে সে দেশে দেখা দিচ্ছেন, রণংদেহি হুংকার তুলছেন। বীরাঙ্গনা ব্রাহ্মণ কন্যাদের বাহুবলে পরাস্ত করে ইসলাম ধর্ম কবুল করিয়ে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করছেন। ব্যাপারটি এতই পৌনঃপুনিকভাবে ঘটেছে যে মুহম্মদ হানিফাকেও মনে হবে ঊনবিংশ শতাব্দীর একজন কুলীন হিন্দু-সন্তান, বিয়ে করে বেড়ানোই তার একমাত্র পেশা। মুহম্মদ হানিফা মস্ত বীর হলে কি হবে, অধিকসংখ্যক রূপসী স্ত্রীর সঙ্গে রতি-রণ এবং ময়দান-রণ দুই-ই একসঙ্গে করতে হলে মাঝে মাঝে এই সমস্ত ভয়ংকরী বীরাঙ্গনাদের হাতেও নাকাল হতে হয়। সেকালে বীরাঙ্গনা পরাজিত করতে পারলে স্বামী আর পরাজিত হলে থাকতে হতো দাস হয়ে। সুতরাং মুহম্মদ হানিফারও দুর্দশার অন্ত থাকে না। সংবাদ যায় হজরত আলীর কাছে। বীর পুত্রের এসব কীর্তিকলাপ তিনি বিলক্ষণ সমর্থন করেন আর হৃদয়ে অপত্যস্নেহও প্রচুর। হায়দরী হক হেঁকে রণ দামামা বাজিয়ে পুত্রের সাহায্যার্থে ছুটে আসেন। পুত্রকে শিখিয়ে পড়িয়ে একেবারে লায়েক করে সেই সমস্ত বিক্রমশীলা রমণীদের হার মানতে বাধ্য করান। তারপরে যুদ্ধকাৰ্য সাঙ্গ হলে পিতা-পুত্র দুজনে একই সঙ্গে দুটো বিবাহ করেন। পিতা যান দেশে ফিরে আর পুত্রবর প্রেমতৃষ্ণায় মাতাল হয়ে মরুভূমির ডনজুয়ানের মতো নতুন রত্নের সন্ধানে দেশে দেশে সফর করেন।
ইসলামের প্রাথমিক যুগের বীর এবং সাধু পুরুষদের নিয়ে যে সমস্ত পুঁথিপত্র লেখা হয়েছে তাতে তাদের ত্যাগ,ধর্মনিষ্ঠা ইত্যাদির সঙ্গে সঙ্গে এ জাতীয় বিস্তর রসাত্মক ব্যাপার-স্যাপার স্থানলাভ করেছে। যে সকল ঐতিহাসিক চরিত্র পুঁথিলেখকেরা তাদের বিষয়ের উপজীব্য করেছেন,তাতে করে চরিত্রের ঐতিহাসিক সত্য সম্পূর্ণভাবে খেলাপ করে নিজেদের মনের রঙে রাঙিয়ে একেবারে জবুথবু করে হাজির করেছেন। কল্পিত চরিত্র হলে তো কথাই নেই, আগাগোড়া রঙ চড়িয়ে রঙিলা না করে ছাড়েননি। তা করতে গিয়ে পুঁথিলেখকরা পরিবেশ, সমাজ এবং সামাজিক সংঘাত, মূল্যচেতনা দুই হাতেই দেদার ব্যবহার করেছেন।
যেমন ধরা যাক, কারবালা থেকে দামেসূকে যাওয়ার পথে কোনো ব্রাহ্মণের বসবাসের বিষয়টি। তা তো একরকম জানা কথাই যে কোনো ব্রাহ্মণের সেখানে নিবাস থাকা সম্ভব নয়। কিন্তু তাহলে কি হবে, পুঁথিলেখকের সেটি জানা থাকা চাই তো। কারবালা দামেসূকের মাঝপথে নয়, গোটা আরবদেশে ব্রাহ্মণ না থাকুক তাতে পুঁথিলেখকের কি আসে যায়? এই বাংলাদেশে তো ব্রাহ্মণ আছে। আর আমাদের পুঁথিলেখক ভদ্রলোকটি তো বাঙালি এবং তিনি ব্রাহ্মণ জাতটার উপর হাড়ে হাড়ে চটা। সুতরাং অনায়াসে ব্রাহ্মণকে কারবালা দামেসূকের মাঝপথে বসিয়ে স্ত্রী-পুত্রসহ সপরিবারে তাকে দিয়ে কলেমা পড়িয়ে মানসিক ঘৃণার মানসিক প্রতিশোধ নেয়া যায় এবং নিয়েছেনও।