তারপরে ভারত তো ভাগ হলো। সুলতান এলেন পাকিস্তানে। তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের লাহোর-করাচীতে অবস্থান করার সময় কখনো ঘর বাঁধার স্বপ্ন এ ঘরছাড়া মানুষটির মনে ঘনিয়ে এসেছিল কিনা, সে অন্তর্গত সমাচার দেয়া রীতিমতো দুঃসাধ্য। সুমা-আঁকা কাজলটানা কোনো রমণীর ব্রীড়াভঙ্গি তাকে চঞ্চল এবং উতলা করেছিল কিনা, বলতে পারব না। তেমনি করতে পারব না ছবির সম্পর্কে কোনো মন্তব্য। এ সময়ে তিনি বিমূর্ত রীতিতে নাকি দেদার ছবি এঁকেছেন । পরী-কন্যার স্তনের গল্পের মতো কেবল গল্পই শুনব। কোনোদিন চোখে দেখতে পাব না। তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে তার অনেক প্রদর্শনী হয়েছে। অনেক বিখ্যাত ব্যক্তি সে সকল প্রদর্শনী উদ্বোধন করেছেন, সংবাদপত্রের প্রশংসা প্রশস্তির সবটুকু হারিয়ে যায়নি। নানা সাময়িকীর কল্যাণে দুয়েকটার মুদ্রিত ব্লকও হয়তো সন্ধান করলে পাওয়া যাবে। সেগুলো তো আর ছবি নয় । ছবির ছবি। সুতরাং কোনো সুচিন্তিত মন্তব্য করা অসম্ভব ।
বিলেতে অনুষ্ঠিত প্রদর্শনীর ছবিগুলো সম্পর্কেও আমরা একইরকম অন্ধকারে থেকে গেছি। যদিও ‘নিউ স্টেটসম্যান’ পত্রিকায় উষ্ণ আলোচনা থেকে অনুভব করতে পারি ছবিগুলো ভাল হয়েছিল এবং দর্শকেরা প্রাণভরে উপভোগ করছিলেন। কিন্তু আসল ছবি যেখানে অনুপস্থিত সেখানে কি কোনো কথা চলে? মন্তব্যগুলো শুনে যাওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। বিলেতের পর আমেরিকা। সেখানেও সুলতান ছবি এঁকেছেন, সে ছবিগুলো কে কিনেছে, কোথায় কিভাবে আছে, অস্তিত্ব নিয়ে বেঁচে আছে না হারিয়ে গেছে, কার কাছে জিজ্ঞেস করলে সদুত্তর পাওয়া যাবে জানি না। এখানেই নিরুদ্দেশ যাত্রার ইতি। অন্ন চল্লিশ বছরের জীবনের একটানা ছুটে চলা ঘরবিরাগী জীবনের সম্পর্কে কোনো গহন কথা আমরা যেমন উচ্চারণ করতে পারব না, তেমনি তার এ সুদীর্ঘ কালের আঁকা ছবির উপর কোনো বক্তব্য রাখতেও পারব না। তাবৎ কলা-সমালোচকের মনে সুলতানের এ-পর্যায়ে আঁকা ছবিগুলো একটা অতৃপ্ত কৌতূহল এবং একটা আফসোসের বিষয় হয়ে থাকবে। সুতরাং সুলতান বলতে যশোরের গগ্রামনিবাসী, মুসলমান চাষী এবং নমঃশূদ্র জীবনের একান্ত শরিক এই মানুষটিকেই চরম ও পরমভাবে মেনে নিতে হবে। তার জীবনের যেন কোনো সূচনা নেই, শৈশব-নেই, কৈশোর নেই, হঠাৎ করে বাংলাদেশের ইতিহাসের ভেতর থেকে একরাশ কাঁচাপাকা বাবরী চুল দুলিয়ে জেগে উঠেছেন। তার ছবির সম্পর্কেও একই কথা। এ ছবিগুলোও অতীতের একেবারে কোলঘেঁষা অন্ধকার ভেদ করে দলে দলে জগৎ-সংসারের কাছে এই মানুষ, এই সভ্যতা, এই সমাজ, এই ইতিহাস এবং এই ঐতিহাসিক সংগ্রামের বার্তা প্রেরণ করবার জন্য যেন আচমকা কার মন্ত্রমুগ্ধ আহ্বানে ছুটে এসেছে।
এই যুদ্ধ এই জাগরণের একটা উল্লসিত বার্তা তো ছবিগুলোর মধ্যে আছে হাজার হাজার বছরের পরাধীনতার শৃঙ্খল ছিন্ন করে একটা জাতি প্রাকৃতিক সত্যের মতো জেগে উঠেছে, শিল্পীর তুলিতে যখন এ জাগরণ-বৃত্তান্ত মূর্তিমান হয়, সে প্রবল প্রাণস্পন্দন ঝংকারিত না হয়ে কি পারে? কিন্তু পাশাপাশি একটা বেদনার দিক আছে। সুলতানের আঁকা একটা ছবি আছে, যা তিনি প্রদর্শনীতে হাজির করেননি। ছবিটির নাম ‘বিপ্লব’। একেক জন শক্ত-সমর্থ মানুষ আপন হাতে তার মস্তক ছিঁড়ে ফেলে ছুঁড়ে দিচ্ছে। নিজেই নিজের হাত ভেঙে ফেলছে, পা মচকে দিচ্ছে। প্রচণ্ড সামাজিক আলোড়নের ফলে যে বিপ্লবী শক্তি মুক্তি পেয়েছে, তা যে কি রকম আত্মঘাতী রূপ নিতে পারে এই ছবিটিতে তার সবটুকু বিধৃত রয়েছে। আজকের বাংলাদেশের বিপ্লবী রাজনীতির আত্মঘাতী ক্রিয়াকলাপ হৃদয়ঙ্গম করার জন্য সুলতানের এ ছবিটিই যথেষ্ট। অর্থনীতি, সমাজতত্ত্ব, রাজনীতি কোনো বিষয়ের অবতরণার প্রয়োজন নেই।
সুলতান নিরুদ্দেশ যাত্রা অন্তে যখন দেশে ফিরলেন, তখন বোধকরি উনিশশ চুয়ান্ন কি পঞ্চান্ন সাল। ঢাকাতে জয়নুল আবেদীনের নেতৃত্বে একটি চিত্রপীঠ স্থাপিত হয়েছে। সেখানে সুলতানের কোনো ঠাই হলো না। কারণ অতিশয় স্পষ্ট,যে নতুন মধ্যবিত্তটি সবেমাত্র জেগে উঠছে এবং শিল্প-সাহিত্যের নানাদিকে হাঁটি হাঁটি পা পা করে পথযাত্রা শুরু করেছে, তার মানস অতিশয় সংকীর্ণ, রাজনৈতিক লক্ষ্য অস্পষ্ট কুয়াশাচ্ছন্ন, শিল্প-সংস্কৃতির কোনো গভীর উপলব্ধিতে রঞ্জিত হয়নি তার মানস পরিমণ্ডল । স্নিগ্ধতার বদলে উগ্রতা, উপলব্ধির বদলে বিক্ষোভ, স্কুল আত্মপ্রতিষ্ঠার দুর্মর মোহ তাকে এমনভাবে পেয়ে বসেছে যে কোনো বিকশিত চেতনার প্রতি প্রণত হওয়া তার ধাতের মধ্যেই স্থান পেতে পারেনি। সুলঅনের কলেজের সার্টিফিকেট নেই এটা উপলক্ষ মাত্র। এমনিভাবে এ শ্ৰেণী সৈয়দ মুজতবা আলীর মতো সাহিত্যের একজন দিকপালকেও দেশের বাইরে ছুঁড়ে দিতে সামান্য দ্বিধান্বিত হয়নি। মুজতবা আলীর ক্ষেত্রেও উপলক্ষের অভাব ঘটেনি। আসলে সে সময়টাই ছিল এমন: বাংলাদেশের মধ্যবিত্তটি তার ফিলিস্টিন মানসিকতার কারণে যা কিছু তার জাগতিক অধিকারবোধের বিপক্ষে যায় তার বিরোধিতা করেছে এবং প্রদর্শন করেছে অসহিষ্ণুতা।
সৈয়দ মুজতবা আলীর জার্মান বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিক্টরেট ডিগ্রি ছিল, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আশীর্বাদ ছিল, আর বাংলা সাহিত্যের অনুরাগী পাঠক সমাজ ছিল, সর্বোপরি সমাজের উপরতলায় একটা স্থায়ী আশ্রয় ছিল। তাই তিনি নির্বিবাদে ফিরে যেতে পারলেন বিশ্বভারতীতে এবং সেখানে সম্মানের সঙ্গে গৃহীত হলেন। কিন্তু সুলতান? তিনি তো আপন পরিচয়ের সূত্র আপন হাতে কেটে দিয়ে সমাজ এবং সময়ের স্রোতের ভেতর দিয়ে কেবল বয়েই গেছেন। মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত, নিম্নবিত্ত কোনো সমাজেই গৃহীত হওয়ার মতো কোনো কিছুই তিনি অর্জন করেননি, না স্ত্রী না পুত্র না স্বভাব-চরিত্র আদব-কায়দা। বিত্ত-বেসাত, বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি কিছুই নেই, বুকের তলায় উজ্জ্বল আলোকিত চেতনা ছাড়া। তিনি যাবেন কোথায়? বিশ্বভুবনে এমন কে আছে তাকে গ্রহণ করে?