চেতনার উর্ধ্বে উড্ডীন অবস্থা থেকেই শিল্পের সৃষ্টি। সমাজে দৃশ্যমান করে তোলার জন্য চেতনাকে ঊর্ধ্বে তুলতে গিয়ে শিল্পী নিজেও কিছুটা আউট-সাইডার হয়ে পড়েন। অর্থাৎ সমাজের কার্যকারণ সম্পর্কে সুগ্রথিত চেতনাস্তর থেকে অন্য একটি কল্পিত স্তরে নিজেকে টেনে তুলতে হয়। এই টেনে তুলতে গিয়েই শিল্পী সমাজের সঙ্গে কেজো সম্পর্কটি হারিয়ে বসেন। তখন শিল্পকলাই সমাজের সঙ্গে সম্পর্কের একটা কৃত্রিম মাধ্যম হয়ে দাঁড়ায়। সমাজটির চেতনাও যদি আনুপাতিক হারে শিল্পীর চেতনার সঙ্গে সামঞ্জস্য রক্ষা না করে তাহলে শিল্পীকে দুটি পরিণতির একটিকে বেছে নিতে হয়। হয়তো তাকে আত্মধ্বংসী কোনো প্রবণতাকে আমন্ত্রণ করে আনতে হয়, নতুবা তান্ত্রিক বা বাউল কিংবা অন্য কোনো সাধকের পথ ধরতে হয়। বলা বাহুল্য, এ দুটোই শিল্পীর শিল্প-সত্তার প্রেতরূপ। শিল্পীর চেতনার গতি যদি জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি পায় আর সমাজের চেতনার গতিটি যদি থাকে গাণিতিক, সেখানে শিল্পী-চেতনার সঙ্গে একটা সংঘাত অনিবার্য হয়ে ওঠে। বড় শিল্পী, বড় কবি, বড় লেখকদের জীবনের চেতনার এই বিস্রস্ত অগ্রথিত সময়কে বলা হয় মানস সংকট কাল।
এমনও দেখা যায় কোনো কবি কোনো শিল্পী জীবদ্দশায় একজনও সহৃদয় হৃদয় সংবেদী পাঠক বা দর্শক পেল না। দেখা গেল মৃত্যুর পরে তার লেখা কবিতা বা আঁকা ছবি নিয়ে সমাজে বেশ মাতামাতি চলছে। উদাহরণস্বরূপ বোদলেয়ারের কথা বলা যেতে পারে। বোদলেয়ার তার জীবদ্দশায় একেবারে অনালোচিত থেকে গেছেন। জীবনানন্দ দাশ ট্রামের তলায় পড়ে মারা গিয়েছিলেন, সে সংবাদটিও ভাল করে কাগজে ছাপা হয়নি। এটা কেন ঘটে- ঘটে একারণে যে শিল্পী বা কবির চেতনা ঋদ্ধি-সমৃদ্ধি লাভ করেছে, এবং শিল্পের মাধ্যমে সমাজের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করছে; কিন্তু সে হারে সমাজের নাড়ি চঞ্চল হয়ে ওঠেনি; তাই সমাজের বুকে কোনো সাড়া, কোনো চঞ্চলতা জাগছে না। পরে যখন সমাজ সাড়া দেয়ার শক্তি অর্জন করেছে তখন হয়তো দেখা যাবে শিল্পী বেঁচে নেই। অনাত্মীয় সমাজের দ্বারে দ্বারে হৃদয়ের অর্ঘ্য সাজিয়ে কত কবি শিল্পী যে জীবনের জ্বালা জুড়িয়েছেন, শিল্প সংস্কৃতির ইতিহাসে তার দৃষ্টান্তের কি অভাব আছে? সুতরাং কোনো কোনো কবি, লেখক, শিল্পী, বিজ্ঞানী দার্শনিককে জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এই আউট সাইডারই থেকে যেতে হয়। দুই কারণেই শিল্পী আউটসাইডার হয়ে পড়েন। চেতনার প্রচণ্ড উল্লম্ফন প্রক্রিয়ার অভিঘাতে কেউ কেউ আউটসাইডার হয়ে পড়েন, আবার কেউ প্রচলিত সমাজ কাঠামোতে কোনো সহায়ক ভিত্তি না থাকার দরুন আউটসাইডার হয়ে পড়েন। শিল্পতত্ত্ব সম্পর্কে কিছু কথা বলা হলো একারণে যে শেখ মুহম্মদ সুলতান তার জীবনের আদি, মধ্য, এমনকি হালের অন্তপর্বেও এই আউট সাইডারের জীবন যাপনই করে যাচ্ছেন।
কোনো কোনো মানুষ জন্মায়, জন্মের সীমানা যাদের ধরে রাখতে পারে না। অথচ তাদের সবাইকে ক্ষণজন্মাও বলা যাবে না। এরকম অদ্ভুত প্রকৃতির শিশু অনেক জন্মগ্রহণ করে জগতে, জন্মের বন্ধন ছিন্ন করার জন্য যাদের রয়েছে এক স্বাভাবিক আকুতি। তাদের সকলের জন্মে জন্মান্তর ঘটে না। কোটিতে গুটি হয়তো মেলে, যারা জন্মেই জন্মান্তরের নির্বাণ লাভ করে। জীবনের দেবতা আপনি এগিয়ে এসে তাদের প্রাণের দেহলীতে সে আশ্চর্য পিদিম জ্বালিয়ে দিয়ে যান। সৌভাগ্য হোক, দুর্ভাগ্য হোক এ সকলের হয় না। শেখ মুহম্মদ সুলতান সে সৌভাগ্যের বরে ভাগ্যবান, আবার সে দুর্ভাগ্যের অভিশাপে অভিশপ্ত ।
সুলতান ওরফে লালমিয়ার জন্ম যশোর জেলার নড়াইল মহকুমার একটি কৃষক পরিবারে। কৃষি ছাড়াও তার বাবা বছরের অকর্মা মাসগুলোতে কিছু বাড়তি আয়ের জন্য করতেন রাজমিস্ত্রির কাজ। রাজমিস্ত্রি গ্রামীণ সমাজের পেশা বিচারে একটি বিশিষ্ট কর্ম ।
সে যাক, উত্তরাধিকারসূত্রে বিচার করলে বড় জোর এটুকু বলা যেতে পারে, রাজমিস্ত্রি শিল্পী পিতার কাছ থেকেই লালমিয়ার মনে অপূর্ব বস্তু-নির্মাণের আকাঙ্ক্ষা জাগ্রত হয়। কিন্তু সেটাও সবার কাছে পুরোপুরি গ্রহণযোগ্য হবে, তেমন বলার উপায় নেই। সে যাহোক, শিশু লালমিয়া সুযোগ পেলেই কাঠ-কয়লা দিয়ে ছবি আঁকত, রঙ পেলে তো কথাই নেই। কিন্তু রঙ পাবে কই? তাই সে কাঁচা হলুদ আর পুঁই গাছের ফলের রস টিপে টিপে ছবি আঁকত। একদিন লালমিয়ার আঁকা এসকল ছবি স্থানীয় জমিদারের দৃষ্টিতে পড়ে। জমিদার মশায় খুবই অবাক হয়ে যান। তিনি লালকে ছবি আঁকার কিছু রঙ কিনে দেন এবং স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন। সেখানে তার পড়াশোনা কতদূর হয়েছিল, বিশদ জানা যায়নি। তবে এটুকু সত্য যে স্কুলের শেষ পরীক্ষা পাস করার আগেই লালমিয়া পালিয়ে কলকাতা চলে যায়।
কলকাতাতেই কিভাবে জানা যায়নি কলা-সমালোচক শাহেদ সোহরাওয়ার্দীর চোখে পড়ে কিশোর লালমিয়ার ছবি। তিনি তাকে বাসায় নিয়ে খাওয়া-থাকার ব্যবস্থা করে দেন, জামা-কাপড় কিনে দেন এবং নির্ধারিত যযাগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও সুপারিশ করে আর্ট স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন। তার নামান্তর ঘটে যায়। সোহরাওয়ার্দী সাহেব লালমিয়ার নতুন নামকরণ করলেন শেখ মুহম্মদ সুলতান। এই নামান্তর ঘটিয়েই জন্মান্তরের একটি ধাপ পার করে দিলেন। আর্ট স্কুলেও তার আঁকাবুকির পালা সাঙ্গ হবার আগে লালমিয়া ওরফে সুলতান আরো একবার নিরুদ্দেশের পথে পা বাড়ালেন, রবীন্দ্রনাথের ‘অতিথি’ গল্পের সে সুকুমার স্নিগ্ধকান্তি কিশোরটির মতো । অযাচিতভাবে পাওয়া আদর-যত্ন বিত্ত-বৈভব এবং ভাবী স্ত্রীর মায়া পরিত্যাগ করে বিয়ের দিন সে কাউকে না বলে শ্বশুর বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিল। প্রথমবার গ্রামের লালমিয়া পালিয়ে শহর কলকাতায় এসেছিল। দ্বিতীয়বার শহর কলকাতা ছেড়ে কন্যা-কুমারিকা থেকে হিমালয় পর্যন্ত প্রসারিত গোটা ভারতবর্ষ অভিমুখে তিনি ছুটে গিয়েছিলেন। শাহেদ সোহরাওয়ার্দীর মতো একজন স্নেহশীল অভিভাবকের আশ্রয়, সোহরাওয়ার্দী পরিবারের গরিমা কিছুই সুলতানকে আটকে রাখতে পারেনি। তখন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের কাল। সুলতান পাঁচ-দশ টাকার বিনিময়ে গোরা সৈন্যের ছবি আঁকছে, আর ভারতের শহর থেকে শহর ঘুরে বেড়াচ্ছে। ভয়-ভাবনা নেই, দায় দায়িত্ব নেই, আছে শুধু সুন্দরের প্রতি সুতীব্র আকর্ষণ আর ছুটে চলার গতি। এ সময়ে আঁকা ছবিগুলোর কি হয়েছে, কোথা থেকে কোথায় গেছে, কেউ বলতে পারে না। ভারতবর্ষের নানা শহরে অনুষ্ঠিত প্রদর্শনীগুলোর বিলম্বিত সংবাদ আজ বুকে শুধু দীর্ঘশ্বাসের জন্ম দেবে। অনুমান করারও উপায় নেই, সে সময়ে তার অঙ্কনশৈলী কি রকম ছিল; সময়ের এবং বয়সের ব্যবধানে কতদূর বিবর্তিত এবং রূপান্তরিত হয়েছে অঙ্কনরীতি, বোধ এবং উপলব্ধি।