শিল্প-সাহিত্যের ইতিহাসে এমন মাহেন্দ্রক্ষণের হঠাৎ হঠাৎ আবির্ভাব ঘটে যখন গোটা ইতিহাসের ধারাটাই শিল্পীর চেতনালোকে মাতম করে ওঠে। সেই বিশেষ সময়টিতে নিসর্গের স্কুল-চিকন দৃষ্টি-অগোচর কার্যকারণ সম্পর্কের সম্পূর্ণ সূত্রটাই শিল্পী-চেতনার মুকুরে এমনভাবে প্রতিফলিত হয়ে ওঠে যে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এই গহন ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় স্বভাব সম্বন্ধে শিল্পীর নিজেরও কোনো স্বচ্ছ, যুক্তিনিষ্ঠ ধারণা থাকে না। তা থাকা সম্ভবও নয়, আর শিল্পীর জন্য প্রয়োজনও নয়। এই একান্ত সংগোপন ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার দোলা, যার আবেশে শিল্পী সব ভুলে শিল্প-কর্মে মনোনিবেশ করে, তার সহজ নাম প্রেরণা। প্রেরণার স্পর্শ না পেলে কিছুই নির্মাণের স্তর অতিক্রম করে শিল্পকর্মের ব্যঞ্জনা লাভ করে না। আবার সব শিল্পীর প্রেরণার ধরনও এক নয়। প্রেরণা নিজের অস্তিত্বকে পুড়িয়ে অন্যরূপে রূপান্তরিত করার সুন্দর সুখকর আনন্দ-বেদনাদায়ক অনুভূতি। এই অনুভূতি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রঙ, বিভিন্ন রসে আত্মপ্রকাশ করে। কোনো বিশেষ সময়ে স্নিগ্ধ রঙ, শান্ত রস, কোনো সময়ে উজ্জ্বল চড়া খুনখারাবীর মতো রঙ আর ভয়ংকর রস প্রাধান্য পায়। সময়ের বৈশিষ্ট্যের মতো শিল্পীর ব্যক্তিত্বের বৈশিষ্ট্য ভেদেও একেক রঙ একেক রস মুখ্য হয়ে ওঠে। কোনো শিল্পী স্নিগ্ধ রঙের, শান্ত রসের, কোনো শিল্পী মধুর রসের আর চিত্তহারী রঙের কোনো শিল্পী হাল্কা ফুরফুরে তুলিতে হাল্কা রস বিকশিত করতে পারেন। রাগ সঙ্গীতের মতো। যেমন সব রাগ সকলের কণ্ঠে সমান খেলে না। শিল্পে যুগ-বিভাগ অর্থাৎ একেক যুগের শিল্পের প্রণিধানযোগ্য বৈশিষ্ট্যসমূহকে সাধারণ লক্ষণ ধরে নিয়ে এক যুগের শিল্পকর্মকে অন্য যুগের চাইতে আলাদা করার একটা প্রচলিত পদ্ধতি আছে, তাতে সময়ের রঙ এবং রসের ব্যাপারটিকেই নির্ণায়ক হিসেবে ধরা হয়। শিল্পীর ক্ষমতা এবং যোগ্যতায় যত আকাশ-পাতাল ফারাক থাকুক
কেন, একই সময়ের সৃষ্ট নানা শিল্পের মধ্যে একটা সাধারণ, ব্যাপ্ত লক্ষণ অবশ্যই ধরা পড়বে। প্রাক-রেনেসাঁস চিত্রের একটা সাধারণ, সহজে চেনা যায় এমন কতিপয় বৈশিষ্ট্য রয়েছে, তেমনি রয়েছে রেনেসাঁস, উত্তর-রেনেসাঁস, ইম্প্রেশানিস্ট, ইমেজিস্ট, সুররিয়ালিস্ট প্রতিটি যুগের শিল্পের আলাদা আলাদা কতেক সাধারণ ধরন।
কোনো কোনো শিল্পীর চেতনায় ইতিহাসের অন্তর্লীন সূত্রটি রক্তশিখায় জ্বলে ওঠে, মাদল ধ্বনিতে বেজে ওঠে। কেন? কেন আতশকাঁচ সূর্যের সামনে ধরলে আগুন জ্বলে, সাধারণ কাঁচ জ্বলে না কেন? সেরকম কোনো কোনো জাতের শিল্পী আছে উপযুক্ত সমিধ পেলে চেতনায় গোটা ইতিহাসের ধারাটিই জ্বালিয়ে তুলতে পারেন। এটি একটি দেবদুর্লভ ক্ষমতা। যার আসে এমনিই আসে। ইতিহাস যাকে মনোনীত করেন, অনেক দুঃখ নিয়েই যোগ্য করে তোলেন। অনেকে আবার দুঃখ সহ্য করেন বটে কিন্তু শিল্প-সৃজনলোকে নির্বাণ লাভ করতে পারেন না, এ-ও ঘটে। তুলনা করলে দেখা যাবে শিল্পতীর্থের অভিযাত্রী হাজার হাজার জনের মধ্যে কৃচিত কখনো দুয়েকটি প্রাণ সেই অমরলোকে সশরীরে হাজির হতে পেরেছে।
তান্ত্রিক সাধনার মতো শোনাবে। শিল্প-সাধনা আসলে একধরনের তান্ত্রিক সাধনারই ফলিত প্রকাশ রূপ। কথাটা শুনলে কেউ কেউ ক্ষুব্ধ হতে পারেন, কিন্তু আধুনিক মনোবিজ্ঞানীর দৃষ্টি প্রয়োগ করে বিষয়টি বিচার করলে সে ভুলটা অতি সহজে ঘুচে যাবে। তান্ত্রিক বাউল এমনকি সুফি সাধকেরাও বিভিন্নভাবে শরীরের গতি নিয়ন্ত্রণ করে ঊর্ধ্বায়িত করার সাধনা করেন। শিল্পীর কাজও অনেকটা সেরকম। তবে তিনি সজ্ঞানে বোধ করতে চান না যে সে সাধনাটিই তিনি করছেন। শিল্পী একটা বিশেষ ছবি আঁকতে চান, কবিতা লিখতে চান, তাতে মনের বিশেষ ভাব-অনুভাবগুলো জ্বালিয়ে তুলতে চান। এই বিশেষ ছবি আঁকতে গিয়ে, বিশেষ কবিতা লিখতে গিয়ে তাকে সর্বপ্রথম নিজের অস্তিত্বের বিপক্ষে যেতে হয়।
হয়তো অস্তিত্বের বিপক্ষে যাত্রা করেও আরেকটি অস্তিত্ব কেউ কেউ আবিষ্কার করেন। সমাজ যদি এই বৃহত্তর অস্তিত্ব অভিমুখে যাত্রার পথ করে না দেয়, শিল্পীর সংবৃদ্ধি এবং পরিবৃদ্ধির সেখানেই ইতি। শিল্পীকে সমাজের নানাকিছুর মধ্যে দিয়েই পথ কেটে বয়ে যেতে হয়। শিল্পী যা-ই কিছু সৃষ্টি করেন, তার গোটা সৃজন-ক্রিয়ার মাধ্যমে আপন অন্তর্নিহিত চেতনার সামাজিক রূপান্তর সাধন করেন। শিল্পীর আপন অন্তরকে বাইরে টেনে আনার এই যে পদ্ধতি তার স্বরূপটিও দ্বান্দ্বিক। বাছুর যেমন ডুস দিয়ে গাভীর ওলান থেকে দুধ বের করে আনে, কিছুটা তার সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। সামাজিক ঘাত-প্রতিঘাতসমূহও শিল্পীর চেতনায় নতুন তরঙ্গ সৃষ্টি করে, আর শিল্পের মধ্যে তারই অভিব্যক্তি প্রকাশরূপ লাভ করে।
এইখানেই একজন শিল্পীর সঙ্গে একজন তান্ত্রিক সাধক, বাউল বা সুফি-সাধকের পার্থক্য। গোটা সমাজের দিকে পিঠ দিয়ে গহন বনে, জনতার অগম্য অরণ্যে সাধক গোটা জীবন কাটিয়ে দিতে পারেন, সমাজের কথা না ভাবলেও চলে। অন্তরের মর্মরিত স্পন্দনের গভীর আবেগে সর্ব অস্তিত্ব সমর্পণ করতে পারলেই তিনি প্রকৃত সাধকের শিরোপা লাভ করেন। সাধকের চেতনা নিজের ভেতরে আবর্তিত হয়, আর শিল্পীর চেতনা সমাজকে আলোড়িত-বিলোড়িত করে। যদিও দুয়ের মধ্যে জল-অচল এরকম কোনো নিরেট পাথুরে প্রাচীরের ব্যবধান নেই। প্রায়ই বড় শিল্পী প্রকৃতিতে কিছুটা সাধক। এবং সাধকেরাও প্রকৃতিতে কিছুটা শিল্পী বৈশিষ্ট্য অর্জন করেন।