ইতিহাসের অয়নান্তকালে একটি নতুন শ্রেণী সম্পূর্ণ প্রাকৃতিকভাবে নতুন ঐতিহাসিক বলে বলীয়ান হয়ে, নতুন সামাজিক প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে যখন জাগ্রত হয়; শিল্পকলাতে সে সমাজের ব্যক্তি-স্বরূপের অভিব্যক্তি যখন ঘটতে থাকে, তখন ব্যক্তি ব্যক্তিমাত্র থাকে না, জাগরণশীল নিখিলের অংশ হয়ে যায়। রেনেসাঁস যুগের চিত্রকলা এবং ভাস্কর্যের মধ্যে একবার জাগরণশীল নয়া নিখিল পুরনো চরাচরের নাগপাশ ছিন্ন করে মূর্তিমান হয়েছিল। দেবতা এবং দেবলোকের নষ্ট-অপচিত স্বপ্নের অশরীরী সৌন্দর্যের মায়াকাননের বলয় গ্রাস থেকে চিন্তা কল্পনাকে মুক্ত করে প্রাকৃতিক নিয়ম শাসিত এই পৃথিবীর দিকে এবং সমস্ত সুন্দরের নিবাসভূমি এই দেহ-দেউলের প্রতি বিস্ময়াপুত নয়ন মেলে অগ্রপথিক মানুষেরা যখন নয়া মানব বিজ্ঞানের প্রসাদে, সম্ভাবনা স্পন্দিত অন্তরে তাকাতে আরম্ভ করেছে; সেই দেখার আবেগ, প্রত্যাশাই রেনেসাঁস যুগের শিল্পীদের শিল্পকর্মে প্রতিভাত হয়ে উঠেছে।
শরীরী সৌন্দর্যের প্রতি এই গভীর অনুরাগ, সুন্দর এবং শক্তির এই যুগল সম্মিলন রচনার কৌশল সুলতানের রেনেসাঁস শিল্পীদের কাছে শেখা। ভাগ্যবশত রেনেসাঁস শিল্পের পীঠস্থানসমূহে পরিব্রাজকের বেশে ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ তার হয়েছিল। পুরনো দেবতারা যেমন মরে না, পুরনো শিল্পও তেমনি অমর। গ্রিসের রঙ্গমঞ্চ যখন শুধু একটা স্মৃতিতে পরিণত হয়েছে, দেবী অ্যাথেনীয় মন্দির যখন একটা পাথুরে কঙ্কালমাত্র, ভাস্করের খোদাই করা রস লাবণ্যমাখানো মূর্তিসমূহ খোঁড়া-অন্ধ-বিকলাঙ্গ, কালের প্রহার অঙ্গে ধারণ করে সময়-সমুদ্রেবিলীন গরীয়ান গ্রিক সভ্যতার যৌবন দিনের কথা স্মরণ করিয়ে দর্শকের বুকে একটু করুণা একটা দীর্ঘশ্বাস জাগাবার জন্য দিবস-রজনী, মাস-বছর, যুগ-যুগান্ত প্রতীক্ষা করছে; সেই সময়ে খ্রিস্টধর্মের বর্বরতাঠাসা আদিম অন্ধকার থেকে পরিত্রাণের আকাঙ্ক্ষায় ‘আলো আলো’ বলে চিৎকার করছে তামাম ইউরোপ। আলো চাই, আরো আলো চাই। টলেডো, কর্ডোভা, গ্রানাডার মূর পণ্ডিতেরা অঙ্গুলি সংকেতে দিক নির্দেশ করল; যাও গ্রিসে যাও। আলো জ্বালানোর কৌশল শিখতে চাও তো গ্রিক লেখকদের লেখা পড়ো, তাদের ধ্যানের দীপ্তি, মননের ঐশ্বর্য অন্তরে ধারণ করো।
ইহজাগতিকতা বা সেকুলারিজম, যার অর্থ এই জগৎ সুন্দর, এই জীবনের প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য, সমস্ত কর্ম, সমস্ত অভিব্যক্তি সুন্দর। প্রাচীন গ্রিস বার্ধক্যের জীর্ণতার ভারে ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে পড়লেও তার হৃদয়ে এই অবিনাশী সৌন্দর্যের প্রেরণার ঝর্নাধারা, এই ধ্বংসস্তূপের অন্তরালে, এই মৃত্যুহিম শীতলতার গভীরে এখনো উষ্ণস্রোতে প্রবহমান। ইউরোপে সে কি উৎসবের সাড়া। দলে দলে বলাকারা যেমন মানস-সরোবরের সন্ধানে যায়, ইউরোপের আলোকিত আত্মারা প্রাচীন অ্যাথেন্স নগরীর অভিমুখে মানস যাত্রা রচনা করল। রব উঠল গ্রিকদের মতো চিত্র আঁকতে হবে, ভাস্কর্য গড়তে হবে, নাটক লিখতে হবে, খ্রিস্ট ধর্ম যেসব একান্ত মানবিকবোধের মুখে পাথর চাপা দিয়েছে সে সমস্ত অর্গল টুটিয়ে দিয়ে একান্ত জৈবিক অনুভূতিসমূহও থরে থরে ফুলের মতো ফুটিয়ে তুলতে হবে। এই ফোঁটার কাজ শিল্প-সাহিত্যে, চিত্রে-ভাস্কর্যে, বিজ্ঞানে-দর্শনে এমনিভাবে ঘটেছে সৃজন-ঋতুর কল্পনা করামাত্রই মন এক লাফে রোম, ভেনিস, জেনোয়া- এসকল নগরীর দিকে যাযাবর বিহঙ্গের মতো ছুটে যেতে চায়।
শেখ সুলতানের মধ্যে দ্যভিঞ্চি, মিকেলেঞ্জেলো, রাফায়েল প্রমুখ শিল্পীর প্রকাণ্ড কল্পনা এবং কল্পনার বলিষ্ঠতার ছাপ এত গভীর এবং অনপনেয় যে মনে হবে এ চিত্রসমূহ, কোনোরকমের মধ্যবর্তিতার বালাই ছাড়া, সরাসরি রেনেসাঁস যুগের চেতনার বলয় থেকে ছিটকে পড়ে এই উনিশশ সাতাত্তর সালে বাংলাদেশের কৃষক সমাজে এসে নতুনভাবে জন্মগ্রহণ করেছে। এই ছবিগুলো আঁকার মতো মানসিক স্থিতাবস্থা অর্জন করার জন্য শেখ সুলতানকে সব দিতে হয়েছে। পরিবারের মায়া, বংশধারার মধ্য দিয়ে নিজের অস্তিত্বকে প্রবাহিত করার স্বাভাবিক জৈবিক আকাঙ্ক্ষা ভেতর থেকে ছেটে দিয়ে, এই চিত্র-সন্তান জন্ম দেয়ার একাগ্রপ্রায় কাঁপালিক সাধনায় নিযুক্ত থাকতে হয়েছে সারা জীবন। শেষ পর্যন্ত অসম্ভব হয়েছে। বাংলার শিল্পীর হাত দিয়ে বাংলার প্রকৃতি এবং বাংলার ইতিহাসের একেবারে ভেতর থেকে রেনেসাঁস যুগের ফুল ফুটেছে। সুলতানের সাধনা মিথ্যা হয়ে যেত, যদি না বাংলার শিল্পীর সঙ্গে সহযোগিতা করে একটি যুদ্ধ বাধিয়ে দিয়ে ইতিহাসের জাগ্রত-দেবতা আপন স্বরূপে শিল্পীর সামনে এসে না দাঁড়াতেন।
এইখানেই সুলতানের অনন্যতা। এইখানেই বাংলার কোনো শিল্পীর সঙ্গে ভারতবর্ষের কোনো শিল্পীর সঙ্গে সুলতানের তুলনা চলে না। অবনীন্দ্রনাথ, যামিনী রায়, নন্দলাল, জয়নুল আবেদীন, আবদার রহমান চাঘতাই, নাগী, এসকল দিকপাল শিল্পীর মধ্যে যতই পার্থক্য থাকুক, তবু সকলের মধ্যে অন্তর্নিহিত যোগসূত্র অবশ্যই রয়ে গেছে। হ্যাভেল ভারতীয় শিল্পাদর্শের যে ব্যাপক সংজ্ঞাটি দিয়েছেন, কেউ তার আওতা ছাড়িয়ে যেতে পারেননি- একমাত্র সুলতান ছাড়া । বাংলা কাব্যের ক্ষেত্রে মাইকেল মধুসূদন যখন মহাকাব্য লিখেছেন, তার বহু আগেই ইউরোপে মহাকাব্য লেখার কাজ চুকেবুকে গেছে। কিন্তু মধুসূদন মহাকাব্য লিখলেন বাংলা ভাষায়। মধুসূদন দত্তের মহাকাব্য বাংলার সাহিত্য, গগনে সূর্য-সংকাশ দীপ্তি নিয়ে, অনন্যতার নিদর্শন হয়ে মানব কল্পনার কুতুবমিনারের মতো দাঁড়িয়ে আছে, তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু এই অতিকায় কল্পনার বোঝা আরো অধিক বহন করবার জন্য তার স্বগোত্রীয় কবিকুলের মধ্যে দুচারজনের আকাঙ্ক্ষা জন্মালেও ক্ষমতা কারো যে ছিল না, তা তো প্রমাণিত হয়ে গেছে। সুলতানের এই চিত্রগুলোও অনেকটা সে গৌরবে গরীয়ান।