সে যাহোক, শেখ মুহম্মদ সুলতানের চিত্রকর্ম আলোচনা করতে গেলে অবশ্যই তার জীবন আলোচনা করতে হবে। অবনীন্দ্রনাথ থেকে জয়নুল আবেদীন পর্যন্ত সমস্ত শিল্পীর যে জীবন বৃত্তান্ত আমরা জানি তার সঙ্গে সুলতানের জীবন-বৃত্তের সামান্য মিল কোথাও নেই। অন্য সকল শিল্পীর জীবন এবং তাদের কৃত শিল্পকর্ম একটা ছকে ফেলে বিচার করা যায়। শেখ সুলতানের জীবনকে যেমন তেমনি তার ছবিকেও বিচার করতে হবে অনেকগুলো ছকে ফেলে এবং তার সবগুলো আমাদের মানস-দৃষ্টির সামনে উপস্থিত নেই। সুলতানের জীবন বলতে বড়জোর যা বলতে পারে তা হলো লাল মিয়া নামে একটি শিশু যশোর জেলার একটি দরিদ্র কৃষক পরিবারে আজ থেকে পঞ্চান্ন কি ষাট বছর আগে জন্ম নিয়েছিল। সেই শিশুটিই এখন শেখ সুলতান নাম ধারণ করে যশোরের সেই কৃষক সমাজে ঝাঁকড়া কেশ দুলিয়ে, নমঃশূদ্র নর-নারীর আদরের গোঁসাই সেজে, অর্ধেক ছন্নছাড়া-লক্ষ্মীছাড়া, অর্ধেক সন্তের বেশে সাপ-শেয়াল ইঁদুর-বেড়াল নিয়ে রঙের সংসার পেতে বসে আছেন।
আজকের দিনে সুলতান বলতে যশোরের যে ঝাকড়া কেশের আউলাঝাউলা মানুষটিকে বোঝায়, যিনি পৌঢ়ত্বের চৌকাঠে বেশকিছুদিন আগে পা রেখেছেন; পুত্র কন্যা-স্ত্রী,সংসারহীন একেবারে একাকী একজন প্রাকৃতিক মানুষ; তিনি যখন এ পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবেন, উনিশশ সাতাত্তর সালে ঢাকায় শিল্পকলা একাডেমীর প্রদর্শনী উপলক্ষে আঁকা এসকল চিত্র-সন্তান ছাড়া তার নামের অমরতা ঘোষণা করার আর কেউ থাকবে না।
কস্তুরী হরিণের মতো আপনার গন্ধের পেছনে আপনি কক্ষচ্যুত ধূমকেতুর বেগে, প্রাণ প্রবাহের তাপে, হেথা নয় হেথা নয়’ নিরন্তর তিরিশটি বছরের ছুটে চলা ঋণ প্রবাহের তাপে খু ন হ জীবনের সমস্ত বেগ, সমস্ত আবেগ যশোরের ভাঙা মন্দিরের দ্বারে দ্বারে, জীর্ণ অট্টালিকার খিলানে-অলিন্দে, তরুলতার সংসারে, পশু-পাখির সমাজে অসহায় শিশুর মতো গৃহ সন্ধান করে চলেছে। জীবন যাকে হেঁচকা টানে গৃহ-সমাজ-সংসারের বন্ধন খসিয়ে শিল্পতীর্থের যাত্রী করেছে, শিল্পের মানস-সায়রের উপকূলেই তো তাকে গৃহ। সন্ধান করে নিতে হয়। এই গৃহের সন্ধান তিনি একবার পেয়ে গিয়েছিলেন। তখন উনিশশ একাত্তর সাল। হাজার বছরের পরাধীন বাংলা, প্রাণ-পাতালের অভ্যন্তরে অপরাজেয় সত্তার অস্তিত্ব আবিষ্কার করে, দর্পিত শক্তির প্রকাশ ঘটিয়ে, ভেতরে থেকে শিউরে শিউরে আগুন বরণ ফণা মেলে জেগে উঠেছিল। বাংলার ইতিহাসের সেই অভাবিত, সেই অচিন্তিত-পূর্ব জাগরণের অরুণ আভায় তার একখানি আশ্রয় নিকুঞ্জের ছায়া দর্শন করেছিলেন শেখ সুলতান, কামান-বন্দুকের হুংকারের মধ্যে গৃহের কল-কাকলী কান পেতে শুনেছিলেন। ইতিহাসের এই থরোথরো কম্পিত জাগরণের মধ্যে তিনি ধ্যান-দৃষ্টিতে দেখতে পেয়েছিলেন: সমাজের উপরতলার শ্ৰেণীগুলো, বিভিন্ন ঐতিহাসিক সময়ে যারা ঔপনিবেশিক শক্তির সহায়তা দিতে দিতে উৎপাদন পদ্ধতির সঙ্গে সম্পর্কহীন পরগাছার মতো ফাঁপানো-ফোলানো জীবনে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে, এই সামাজিক ভূমিকম্পে তাদের অস্তিত্ব তাসের ঘরের মতো ভেঙে তছনছ হয়ে যাচ্ছে, সময়ের প্রখর তাপে তারা মোমের পুতুলের মতো গলে একাকার হয়ে যাচ্ছে। এই কম্পনের বেগ ধারণ করা তাদের সাধ্যের বাইরে। এই জাগরণের আগ্নেয় সংবাদ বহন করতে গিয়ে তারা জ্বলেপুড়ে খাক হয়ে যাবে। পাশাপাশি আরেকটি শ্রেণীকে তিনি দেখতে পেয়েছিলেন, প্রকৃতি এবং ইতিহাসের গভীর অঙ্গীকার যারা নিরবধিকাল ধরে বহন করে চলেছে, নতুন ফুটন্ত ইতিহাসের আবেগ-উত্তাপ সবটুকু পান করে ফুটে উঠবার বীর্য এবং বিকাশমান সৃষ্টিশীলতা যাদের আছে। সেই শ্রমজীবী কিষাণ জনগণকে তিনি বাংলার ইতিহাসের নবীন কুশীলব হিসেবে দেখতে পেয়েছিলেন। এই দেখা সমাজ-বিজ্ঞানীর খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সামাজিক সম্পর্কের জটাজাল বিচার নয়, অর্থশাস্ত্রীর চুলচেরা শ্রেণী-বিশ্লেষণ নয়। এ দেখা শিল্পীর দেখা: বিন্দুতে সিন্ধু ঝিলমিলিয়ে ওঠে, ক্ষুদ্র তিল পরিমাণ বীজকণার অন্তরে সম্ভাবনার স্বপ্ন নিয়ে শায়িত থাকে বিশাল মহীরুহ।
তাই সুলতানের কৃষক, জয়নুল আবেদীনের কৃষক নয়। জয়নুল আবেদীনের কৃষকেরা জীবনের সংগ্রাম করে । সুলতানের কৃষকেরা জীবনের সাধনায় নিমগ্ন । তারা মাটিকে চাষ করে ফসল ফলায় না। পেশীর শক্তি দিয়ে প্রকৃতির সঙ্গে সঙ্গম করে প্রকৃতিকে ফুলে-ফসলে সুন্দরী সন্তানবতী হতে বাধ্য করে। এইখানে জীবনের সংগ্রাম এবং সাধনা, আকাক্ষা এবং স্বপ্ন আজ এবং আগামীকাল একটি বিন্দুতে এসে মিশে গিয়েছে। সুলতানের কৃষকেরা নেহায়েত মাটির করুণা কাঙাল নয়। রামচন্দ্র যেমন অহল্যা পাষাণীকে স্পর্শ করে মানবী রূপ দান করেছিলেন, তেমনি তার মেহনতি মানুষদের পরশ লাগামাত্রই ভেতর থেকে মাটির প্রাণ সুন্দর মধুর স্বপ্নে ভাপিয়ে উঠতে থাকে। এ মানুষগুলো পাখা থাকলে দেবদূতের মতো আকাশের অভিমুখে উড়াল দিতে পারত। কিন্তু একটি বিশেষ ব্রতে, একটি বিশেষ অঙ্গীকারে আবদ্ধ বলেই তারা মাটির দিকে ঝুঁকে পড়ে আছে। সে অঙ্গীকারটি, সে ব্রতটি মাটিকে গর্ভবতী ও ফসলশালিনী করা। মাথার উপরে স্বর্গলোকের যা কিছু প্রতিশ্রুতি, যা কিছু প্রেরণা তার সবটুকু- আকাশের নীল থেকে, রামধনুর বর্ণের সুষমা থেকে হেঁকে এনে মাটির ভেতরে চারিয়ে দিয়ে যাচ্ছে এই মানুষ-মানুষীর দল। ম্যাক্সিম গোর্কির সেই বাক্যটি কি দর্পিত, কি ব্যঞ্জনাময় এই মানুষ শব্দটি’ উচ্চারণ মাত্রই নিসর্গের অন্তরে কি ব্যাকুল সাড়া এবং কানাকানি পড়ে যায়। সুলতানের আঁকা এই কৃষকদের যিনি দেখেছেন, অবশ্যই একমত হবেন, ম্যাক্সিম গোর্কির মানুষ সম্পর্কিত মন্তব্য কত সার্থক এবং যথার্থ হয়েছে ।