.
৬.
‘কবিকে যাবে না পাওয়া জীবন-চরিতে’-রবীন্দ্রনাথের এই ছন্দিত বাক্য কবির বেলায় সত্য হতেও পারে। কিন্তু কবিকে পাওয়া যাবে কোথায়? সহজ উত্তর: কবিতায়। কিন্তু কবিতায় যেটুকু পাওয়া যায়। অর্থাৎ কবির প্রাণ- পাতালের আলো আঁধারের ঝিকিমিকি- সেই চিন্ময় প্রাপ্তিতে মন যখন বশ মানে না, বুদ্ধি সন্তুষ্ট হতে চায় না, বাকিটুকু খুঁজতে হবে কোথায়? তারও সহজ উত্তর: জীবনে। তাহলে কথাটা দাঁড়ালো এই, কবিকে পাওয়া যাবে প্রথমে কবিতায়, তারপরে জীবন-চরিতে অবশ্য যদি হয় তেমন জীবন-চরিত।
শিল্পীকে পাওয়া যাবে শিল্পে। সেটাও এক ধরনের পাওয়া বটে। সে পাওয়া দিয়ে শিল্প উপভোগ করা যায়, তারিফ করা যায়, বাহবা দেয়া যায়, কিন্তু শিল্পের বিচার করা যায় না। রেনেসাঁস পরবর্তী যুগে অনেক কলা সমালোচক রেনেসাঁস যুগের চিত্রকর ও ভাস্করদের অঙ্কনরীতি এবং নির্মাণশৈলীর নানারকম ব্যাখ্যা-বিচার করেছেন। চিত্রকলা এবং ভাস্করদের ইতিহাসে কার কোথায় স্থান, কার প্রভাব কার উপরে কতটুকু, কার প্রাতিস্বিকতা কতদূর এসব নিয়ে বিস্তর পাণ্ডিত্যপূর্ণ আলোচনা সমালোচনা হয়েছে। ভাসারীর সেই সুবিখ্যাত গ্রন্থটির পাশে এসব তত্ত্ব এবং তথ্য বিন্যাস, নন্দনতত্ত্বের উর্ণাতন্ত্র বিস্তার বড় বেশি কাগুঁজে এবং বড় বেশি মেকী মনে। হয়। তার একটি মুখ্য কারণ, ভাসারী শিল্পের আর শিল্পীর এমন একটি সম্পর্ক দাঁড় করিয়েছেন, পিতা-মাতার সঙ্গে পুত্র কন্যার সজীব ও অচ্ছেদ্য সম্পর্কের তুলনামাত্র যার সাথে করা যায়। তিনি বহু খ্যাত, কম খ্যাত এবং একেবারে অখ্যাত শিল্পী আর ভাস্করদের জীবন বৃত্তান্ত এমনভাবে সংকলন করেছেন, তাদের পছন্দ-অপছন্দ ঘরোয়া স্বভাব এবং বেপরোয়া প্রবণতাসমূহ এমনভাবে ধরেছেন, শিল্পে সেগুলোর ছায়াপাত কিভাবে ঘটেছে এমনভাবে দেখিয়ে দিয়েছেন, কাঁচের আধারে শাখা-পত্রে পল্লবে-মুকুলে বর্ধিষ্ণু তরুর দীঘল শরীর যেমন দৃষ্টিগোচর; তেমনিভাবে শিল্পীদের মানস-পরিণতির ছবিটি লক্ষগোচর হয়ে উঠেছে। পাশ্চাত্য শিল্প-সমালোচনায় এই সুবৃহৎ ও সুবিখ্যাত গ্রন্থটি এত অধিক প্রভাব বিস্তার করেছে যে আরভিং স্টোন যখন মিকেলেঞ্জেলো ও ভ্যানগগ-এর জীবন নিয়ে উপন্যাস রচনা করেন, সমারসেট মম যখন পল গঁগার জীবন কাহিনী লেখেন অথবা রমা ব্ললা উপন্যাসের পরিসরে সঙ্গীতশিল্পী বেটোফেনের মানস-জীবনের নিরন্তর ঝঞ্ঝাকে ধারণ করতে চেষ্টা করেন, তখন সকল প্রয়াসের মধ্যে ভাসারীর লাইভ অফ দ্য রেনেসাঁস পেইন্টার্স’-এর একটা জলছবি কোথাও স্পষ্ট, কোথাও অস্পষ্ট, কেমন যেন ফুটে বেরিয়ে আসতে চায়।
এ দেশের চিত্রকলার আলোচনা-সমালোচনার ধারাটি বলতে গেলে একেবারেই অর্বাচীন এবং সেকারণেই গভীরতা বিবর্জিত। অজন্তাগুহাগাত্রের আশ্চর্য ছবিগুলো কারা এঁকেছিলেন, প্রশ্ন করলে গুহার অভ্যন্তরে সে প্রশ্ন শুধু ধ্বনি-প্রতিধ্বনি রচনা করে, কোনো জবাব টেনে আনে না। তাজমহলের স্থপতি কে বা কারা? এ ব্যাপারেও একরাশ মৌনতা চারপাশ থেকে ছুটে এসে প্রশ্নকারীর কণ্ঠস্বর গ্রাস করে ফেলে- জবাব মেলে না। ভারতীয় চিত্র এবং ভাস্কর্যকলার স্রষ্টারা মা-মাকড়সার মতো। হাড়-মাংস-অস্থি-মজ্জা সবটুকু ক্ষয় করে বাচ্চা ফুটোনোর কাজে। যখন বাচ্চা ডিম ফুটে বেরোল পেঁয়াজের খোসার মতো ফুরফুরে একখানি কঙ্কাল ছাড়া আর কোথাও মায়ের কোনো চিহ্ন নেই। ছবি আঁকা হয়ে গেলে, ভাস্কর্য গঠিত হওয়ার পরে শিল্পীর আর কোনো অস্তিত্ব থাকে না। তাই অজন্তাতে হোক, ইলোরাতে হোক, তাজমহলে, কুতুব মিনারে, রাজপুত চিত্রে, কানাড়া চিত্রে, মোগল চিত্রে যিনি শিল্পী তিনি গা ঢাকা দিয়ে রয়েছেন, তার নাম-ধাম কুল-পরিচয় কেউ জানে না।
ইউরোপীয় আদর্শে নব্য-চিত্রকলার বিকাশ ঘটলেও যথার্থ অর্থে চিত্র সমালোচনার ধারাটি এখানে অদ্যাবধি গড়ে ওঠেনি। এখানে এক ধরনের সমালোচনার চল আছে, তা যে একেবারে অন্ধ তাও নয়। এমন পারঙ্গম চিত্র ভাষ্যকার যথেষ্ট ছিলেন, বা এখনো আছেন যারা উৎকৃষ্ট চিত্রের মর্মোপলব্ধি করতে পারেন, শিল্পীর প্রাতিস্বিকতা অনুভব করতে পারেন রঙ-রেখার আঁকাবাঁকা বৈশিষ্ট্য প্রকাশমান করে তুলতে পারেন, বিমূর্ত চিত্রের মধ্যে অর্থের ব্যঞ্জনাও আবিষ্কার করতে পারেন। তার পরেও কিন্তু একটা ফাঁক থেকে যায়। শিল্প আর শিল্পীর মধ্যে একটা দ্বান্দ্বিক, জৈবিক এবং সক্রিয় সম্পর্কসূচক চিত্র-আলোচনার ধারা এখানে আজ পর্যন্ত তৈরি হয়নি। আমাদের দেশে প্রতিভাবান চিত্রশিল্পীকে এখনো অনেকটা বিশেষ জাতের, বিশেষ ধাচের উন্নত শ্রেণীর কারিগর হিসেবে বিচার করা হয়। শিল্প থেকে শিল্পীকে আলাদা করে দেখার সনাতন অনীহা কাটতে কাটতেও যেন কাটে না। একজন বিজ্ঞানী যে মেধাশক্তি প্রয়োগ করে একটা নতুন কিছু আবিষ্কার করেন, যে মেধার বলে পারস্পরিক যুক্তি-শৃঙ্খলার বিন্যাসে একজন দার্শনিক জীবন এবং জগতের নতুন অর্থ খুঁজে বের করেন, একজন উৎকৃষ্ট কবি যেভাবে সনিষ্ঠ মেধাশক্তির প্রয়োগে উপমা-চিত্রকলা-ছন্দ অলংকার সহযোগে আনন্দলোকের দুয়ার উন্মুক্ত করেন, চিত্রকরের দক্ষতাকে কবি-বিজ্ঞানী এবং দার্শনিকের সেরকম সম্মান ও শ্রদ্ধা দিয়ে বরণ করার মতো মানসিক পরিপক্বতা আমাদের সমাজ অর্জন করতে পারেনি। চিত্র-শিল্পীর প্রতিভার যে কদর আমাদের সমাজে তা অনেকটা দায়ে পড়ে, ঠেকে এবং বাধ্য হয়, কদাচিৎ তা স্বাভাবিক এবং স্বতঃস্ফূর্ত।