কিন্তু জয়নুল আবেদীন? তিনি ভিন্ন মানুষ, ভিন্ন যুগের, ভিন্ন সমাজের শিল্পী। তার চেতনার স্তরে স্তরে ভিন্ন রকম জীবনবীক্ষা এবং জীবন অভিজ্ঞতা মর্মরধ্বনিতে বাংলার শ্রমশীল সমাজ, বৃহত্তর অর্থে বাংলার কৃষক সমাজের জীবন সঙ্গীত বাজিয়ে তুলছে। যোজন যোজন মাঠব্যাপী ছড়ানো উৎপাদন-শৃঙ্খলে আবদ্ধ বাংলার কৃষক, বংশ-পরম্পরা কায়িক শ্রমে যাদের একমাত্র উত্তরাধিকার। এই বৃক্ষপ্রতিম অচল সমাজের মানুষেরা শিল্পীর মনের দুয়ারে দুয়ারে সবেমাত্র টোকা দিতে আরম্ভ করেছে। শ্রমে-স্বেদে সিক্ত মলিনমুখো মানুষেরা শিল্পীর কাছে আবেদন জানাতে লেগেছে: আমাদের মূর্তিমান করো, প্রকাশিত করো। অবনীন্দ্রনাথ কেমন করে সে আহ্বান শুনতে পাবেন? নন্দলাল কেমন করে স্নিগ্ধ রঙে চুবিয়ে রোদে পোড়া বৃষ্টিতে ভেজা এই মানুষদের ছবি আঁকবেন? যামিনী রায় কোন সাহসে সুন্দরীদের সঙ্গ ছেড়ে এমন নিখাদ চাঁছাছোলা জীবনসংগ্রামের রঙ্গভূমিতে অবতীর্ণ হবেন? এই নিসর্গনির্ভর মানুষদের বার্তাবাহক একজন শিল্পী প্রয়োজন। তাই এলেন জয়নুল আবেদীন।
তেরশ পঞ্চাশের ভয়াবহ মহামারী-মন্বন্তর, মহাযুদ্ধের বীভৎসতা এবং শহর কলকাতার দুঃসহ সামাজিক বাস্তবতা একযোগে তার স্নায়ুতে চাপ সৃষ্টি করে তাকে দিয়ে কাকের ছবি আঁকিয়ে নিয়েছিল। একটি পর্যায়ে, শুধু একটি পর্যায়ে তার তুলি মানবতার বীভৎস করুণ রূপসৃষ্টির দিকে ধাবিত হয়েছিল। এটা শিল্পীর স্থায়ী পরিচয় নয়, পরিবেশ পরিস্থিতির চাপে হঠাৎ করে জ্বলে ওঠা । শিল্পী জয়নুল তার যৌবন দিনে একবার জ্বলে উঠে, এই পর্যায়ের চিত্রসমূহের মধ্যে যুগের পরিবর্তন, শিল্প রুচি এবং শিল্পাদর্শের পালাবদল এবং সমাজ আদর্শের রূপান্তর কত-কিছুর ঘোষণা রটিয়ে দিতে পেরেছিলেন । এসকল কারণেই তার এ পর্যায়ের ছবিসমূহ হানা দিয়ে চিত্রপ্রেমিকদের মনে স্থান দখল করে নিতে পেরেছে।
কিন্তু সামাজিক চিত্রাবলীর মধ্যেই শিল্পী জয়নুলের প্রকৃত এবং স্থায়ী পরিচয়। যেসকল চিত্রের মধ্যে বাংলার ইতিহাস হাজার বছরের ওপার থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেলেছে, শত অবগুণ্ঠনের অন্তরাল ভেদ করে গ্রামীণ কর্মজীবী মানুষের সরল জীবনযাত্রা উঁকি দিতে পেরেছে, সেখানে কেবল সেখানেই জয়নুলের সুন্দর চিত্র শরীরে কান্তিমান হয়েছে। তার পিতৃনিবাস ব্রহ্মপুত্র নদের ধারের ময়মনসিংহের সে পাটক্ষেত, সে চাষা, সে মাঝি, সে নৌকা, সে ধানক্ষেত, হাল-লাঙল-বলদ, পাঁড়াগেঁয়ে বিয়ের আসর, পাল্কি চড়ে নববধূর শ্বশুর বাড়ি যাত্রা, দুধাল গাই, গুণটানা নাও, তেজী ষাড়, গাবের কষে রাঙানো জেলেদের মাছ ধরা জাল, কৃচিত কখনো একজন-দুজন বিরল সাঁওতাল রমণী, বাংলার আবহমানকালের চিরপরিচিত এসকল দৃশ্যে জয়নুল আবেদীন তার সুন্দরকে আবিষ্কার করেছিলেন। এ সুন্দর অবনীন্দ্রনাথের মায়ামরীচিৎকার সুন্দর নয়, নন্দলাল বসুর স্নিগ্ধ শোভন ধ্যান দৃষ্টির সুন্দর নয়, যামিনী রায়ের অঙ্গের সীমান্তপ্রান্তে অন্তর উদ্ভাসিত হওয়া সুন্দর নয়। এ সুন্দর রক্তমাংস চলা-অচলা, স্থূল-চিকনে মেশানো সুন্দর। জসীম উদ্দীনের কবিতার মতো তাকে হাত দিয়ে ধরা যায়, ছোঁয়া যায়। জীবনানন্দ দাশের কবিতার মতো একটি আভাস মাত্র রচনা করে ধূপের শরীর ধরে হাওয়ায় হাওয়ায় ঘুরে বেড়ায় না ।
জয়নুলের আঁকা ছবিগুলো একটার পাশে আরেকটা সাজালে গ্রামীণ মেহনতী মানুষের জীবনসংগ্রামের বিচিত্রমুখী রূপটিই প্রকটিত করে তুলবে। মনে হবে এক একটি ছবি আরেকটি বড় ছবির স্বয়ংসম্পূর্ণ অংশ। আর সে বড় ছবিটি বাংলার উৎপাদনশীল মেহনতী মানুষের সমাজ কাঠামো। এই পরিপ্রেক্ষিতটা আবিষ্কার করাই হলো চিত্রকলার ক্ষেত্রে জয়নুল আবেদীনের মৌলিক অবদান।
আর্ট স্কুলের ছাত্র হিসেবে অবনঠাকুর-নন্দলাল-যামিনী রায়ের ঘরানা যে স্টাইল বা অঙ্কনশৈলী তিনি রপ্ত করেছিলেন, তার আপন বিষয়ে প্রয়োগের বেলায় দেখা গেল সে রীতি ছোট মাছধরা জালে সামুদ্রিক তিমি আটকাবার দুরাকাঙ্ক্ষার মতোই অকেজো এবং হাস্যকর। এই গ্রাম বাংলার শ্রম-ঘাম-সংগ্রামে কাতর মানুষদের চকচকে পেশী সাপের ফণার মতো রঙের ছোঁয়ায় ছোঁয়ায় ফুলে উঠল। কখনো বা রঙের যাদু সময় সমুদ্র মন্থন করে এমন একখানা মুখদর্পণ কোত্থেকে টেনে আনল, চোখে পড়লে হঠাৎ করে অনেক প্রকাশহীন কথা বুকে কারণহীন ব্যথায় আকুলি বিকুলি করে। এই তো জয়নুল আবেদীন! অবনীন্দ্রনাথ চিত্রশিল্পের যে ধারাটি রামধনুর রঙে রঙে মুক্তি দিয়েছিলেন, ইতিহাসের স্বপ্ন-কল্পনার জগতে টেনে নিয়ে গিয়েছিলেন, সেই একই ধারাটিকে তিনি অপার মমতায় বাংলার প্রাকৃত জনগণের জীবনের সঙ্গে, জীবিকার সঙ্গে গেঁথে দিতে পেরেছেন। এ কি কম কথা! তবু এই জয়নুল আবেদীন বড় বেশি একঘেঁয়ে, বড় বেশি প্রাদেশিক । ইনস্টিঙ্ককে ছাড়িয়ে তার ছবি কোনো উচ্চতর আবেদন, সূক্ষ্ম ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করতে সত্যি সত্যি অপারগ। তার ছবির নর-নারীগুলো যেন সমাজের প্রতিনিধিত্বশীল এক একটা টাইপ বিষয়বস্তু। ব্যক্তি-স্বাতন্ত্রের ছাপ বড় একটা চোখে পড়ে না। তার শিল্পী জীবনেও তেরশ পঞ্চাশের হঠাৎ জ্বলে ওঠার ক্ষণটি ছাড়া আপনাকে আপনি ছাড়িয়ে যাওয়ার কোনো প্রাণধর্মী তাগিদ কিংবা প্রেরণার বড় অভাব। শেষপর্যন্ত জয়নুল আবেদীন চিত্র আঁকা শিক্ষকে পরিণত হয়েছিলেন আর শিল্পী ছিলেন না। উনিশশ সত্তর সালের সর্বগ্রাসী বন্যা এবং জলোচ্ছ্বাসের পর ‘মনপুরা’ শীর্ষক চিত্রে আরেকবার যৌবন দিনের মতো জ্বলে উঠবার একটা সজ্ঞান প্রচেষ্টা করেছিলেন। ভয়াবহতার প্রতীকরূপে ঢেউগুলোকে হাঙ্গরের বিরাট বিরাট হা-য়ের মতো করে এঁকেও ছিলেন। কিন্তু সে ছবি অভ্যস্ত হস্তের নির্মাণ কৌশল অতিক্রম করে সঠিক সৃজনকর্ম হতে পেরেছে বলে মনে হয় না। চিত্রকলার বোধ এবং উপলব্ধির দিক দিয়ে, নিষ্ঠা এবং সাধনার গভীরতার বিচারে জয়নুল আবেদীন, অবনীন্দ্রনাথ,নন্দলাল, যামিনী রায় এই তিনজন শিল্পীর পাশাপাশি স্থান পেতে পারে কিনা সে বিষয়ে যথেষ্ট ভাবনা-চিন্তা করে দেখতে হবে। তথাপি জয়নুল আবেদীন বড়,তার হাতে আটকোটি মানুষের একটি জাতি চিত্রশিল্পের দীক্ষালাভ করেছে। বলতে গেলে তার একক প্রচেষ্টায় ঢাকা শহরে একটি চিত্রকলার পীঠস্থান রচিত হয়েছে। একসময় ভারত ভাগ না হলে হয়তো জয়নুল আবেদীনকে সে গুরুদায়িত্ব বহন করতে হতো না। এবং তিনি আরো বড় শিল্পী হতে পারতেন। কিন্তু সবকথার সারকথা হলো, ভারত বিভক্ত হয়েছিল। ছবি আঁকা বাদ দিয়ে জয়নুলকে ছবি আঁকার মাস্টার হতে হয়েছিল।