.
৫.
তাই বলে যামিনী রায়ের শিল্প শ্রম-ঘামের সংঘাত এবং জীবনের সংগ্রামের ক্ষেত্রে অবতরণ করতে পারেনি। এর জন্য প্রয়োজন ছিল আরো একজন শিল্পীর । তেরশ পঞ্চাশের মন্বন্তরের কাকের ছবি জয়নুল আবেদীনের ললাটে শিল্প-সম্ভাবনার সোনালি রেখা এঁকে দিয়েছিল। এটা চিন্তাকে নাড়া দেওয়ার মতো একটা সংবাদ বটে। অবনীন্দ্রনাথের অলকাপুরীর দূরদূরান্তের আধেক স্পষ্ট আধেক অস্পষ্ট স্বপ্নবিজড়িত রোমাঞ্চ কল্পনা নয়, নন্দলালের ছন্দায়িত অর্ধেক বাস্তব অর্ধেক অবাস্ত বের আলিঙ্গনে বাঁধা পড়া ছিমছাম সুন্দর কোনো ফিগার নয়, আর মুখে বৈষ্ণব কবিতার ঢলঢলে লাবণি মাখানো গহন নয়না কোনো কামনার ধন নারীও নয়, অমঙ্গলের বার্তাবাহক একটা তুচ্ছাতিতুচ্ছ কাক- তাও আবার মন্বন্তরের কাক শিল্পীর তুলিতে জন্মলাভ করে সকলের মনোহরণ করল। কিন্তু কেন? আর যিনি আঁকলেন তার সমাজের মধ্যে ঐতিহ্যের ভেতরে, পরিবার কিংবা পরিমণ্ডলের পরিসরে তুলির লেখনের কোনো আদর ছিল না। তথাপি এই তরুণ মুসলমান শিল্পী সৃজনশক্তির যাদুতে কাকের ছবির মধ্য দিয়ে মন্বন্তরের সমস্ত ভয়াবহতা, সমস্ত হাহাকার, সমস্ত নিষ্ঠুরতা, সমস্ত হৃদয়হীনতা এমনভাবে মূর্ত করে তুললেন, এই সংবাদটির ভেতরে অনেকগুলো বড় বড় সংবাদ আত্মগোপন করে আছে।
অবনীন্দ্রনাথ যে সমাজের নিরাপদ পাটাতনে উপবেশন করে স্নিগ্ধ রুচি এবং পূর্ণিমার মধুযামিনীর স্বপ্নচর্চা করতেন, কালের ইঁদুর সেই নিশ্চিন্ত বিলাস বাসরের কড়ি বরগা এবং খিলানে খিলানে দ্রংষ্টারেখা প্রবিষ্ট করিয়ে কেটেকুটে একাকার ছত্রখান করে ছেড়েছে। আর সেই রামধনু ঘেঁকে তোলা চমৎকার সূক্ষ্ম রুচিরেখা কালের জল সম্পূর্ণরূপে ধুয়ে নিয়ে গেছে। নন্দলালের স্বপ্ন-বাস্তব জড়াজড়ি করা ফিগারসমূহ ভয়ংকর এবং অমঙ্গলের ত্রাসিত রূপ দেখে সভয়ে পালিয়ে বিশ্বভারতীর কলাভবনে মুখ লুকিয়ে বেঁচেছে। যামিনী রায়ের চাঁদপানা মুখের রমণীরা দুর্ভিক্ষের দেশ ছেড়ে, হাভাতের হা-ঘরেদের মুলুকের সীমানা অতিক্রম করে নগদ রজতমুদ্রার বিনিময়ে গোরা সৈন্যদের বগলে চড়ে ইংল্যান্ড আমেরিকায় পাড়ি জমাচ্ছে। এই দুর্ভিক্ষ এই অনাহার যন্ত্রণা, এই ধ্বংসলীলা এই অমঙ্গলের ভয়ংকর মূর্তি ধারণ করবে কোন্ শিল্পীর চেতনালোক? জয়নুল আবেদীন তার শিল্পী-জীবনের সূচনাপর্বে সরল সবল বাহু দুটি দিয়ে এই বিনষ্টি, এই বীভৎসতাকেই আলিঙ্গন করতে চেষ্টা করেছিলেন।
গোটা মুসলিম সমাজটার চিত্রকলার হাতেখড়ি হয়েছে জয়নুলের মাধ্যমে। ব্যক্তি হিসেবে জয়নুলের জন্য এটা একটা অভাবিত ঘটনা বটে। কিন্তু সমাজটার কথা চিন্তা করলে মনে প্রত্যয় জন্মায় যে ঠিক সময়েই ঠিক মানুষটি জন্ম নিয়েছে। কাজী নজরুল ইসলামের সিংহনাদ এবং বুলবুল বচন বাংলার কাব্যলোক ও সঙ্গীতলোকে বজ্রবাণ আর পুষ্পবৃষ্টি দুই-ই বর্ষণ করেছে। কবি কাজী নজরুল ইসলাম নামের সিংহ-দরজা পেরিয়ে প্রাণের পতাকা উড়িয়ে বাংলার কাব্য কাননে এলেন জসীম উদ্দীন, মহুয়ার মাদকতার সঙ্গে নিধুয়া পাথারের বিরহব্যথা সুরের দীর্ঘশ্বাসে ছড়িয়ে দিয়ে সঙ্গীত জগতে আত্মপ্রকাশ করলেন আব্বাসউদ্দীন। প্রায় একই সময়ে চরণে ঝংকার তুলে অপরূপ লীলালাস্য এবং গতিভঙ্গিমাসহ বুলবুল চৌধুরী গন্ধর্ব জগতে এসে উদিত হলেন। এই শিল্পী চতুষ্টয় আব্বাস-জসীম-জয়নুল-বুলবুল, ক্ষেত্র আলাদা হওয়া সত্ত্বেও, কোথায় যেন এরা একই সূত্রে বাঁধা পড়ে আছেন। ছোটখাট বৈপরীত্যসমূহ আলাদা করে নিলে দৃষ্টিতে ধরা পড়ে যাবে চারজনের মর্মমূলে একই ধরনের জীবনানুভূতি ক্রিয়াশীল। চারজনের ধমনীর শোণিত প্রবাহে একই আকারের লোহিত তরঙ্গ জাগছে আর ভাঙছে। একই সময়ের ডাকে সাড়া দিয়ে একই সমাজের ভেতর থেকে একই সৌন্দর্যের অগ্নিকাণ্ডে আত্মাহুতি দান করার জন্য এই ভক্ত চতুষ্টয় যেন সমবেত হয়েছেন। ঊনবিংশ শতাব্দীর হিন্দু মধ্যবিত্তের মানসে কর্ষণে ঘর্ষণে এবং অনুশীলনে যে জীবনবোধের উন্মেষ এবং বিকাশ, এদের অবস্থান তার চাইতে অনেক দূরে। বুদ্ধির চাইতে আবেগ, চিন্তার চাইতে সংবেদনা, রীতির চাইতে স্বতঃস্ফূর্ততার দোলা, অনুশীলনের চাইতে সহজ প্রকাশের প্রবণতা এদের অনেক অনেক গুণে বেশি। এদের সকলের সাধনা এসকল গুণে গুণান্বিত এবং পাশাপাশি এ সকল অবগুণে অবগুণ্ঠিত বটে। তথাপি এ চারজন সমাজসংস্কৃতির এমন কতিপয় বৈশিষ্ট্য অত্যন্ত অবলীলায় প্রকাশমান করে তুলেছেন যার বোধটি পর্যন্ত শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙালি হিন্দুর ছিল না, অথচ তা এদেশেরই, এ সমাজেরই কর্মজীবী মানব-গোষ্ঠীর উজ্জ্বল এক উত্তরাধিকার ।
উদাহরণস্বরূপ জসীম উদ্দীন যখন লিখলেন: “এই গাঁয়ের এক চাষার ছেলে লম্বা মাথার চুল কালো মুখে কালো ভ্রমর কিসের রঙীন ফুল”-এই বর্ণনার একটা অমোঘ আকর্ষণী শক্তি আছে। শব্দের মধ্যে সন্ধান করলে পাওয়া যাবে না, শব্দার্থের মধ্যেও নয়, কিন্তু একঝোঁকে সবটা উচ্চারণ করে গেলে একটা সুঠাম কান্তি গ্রাম্য যুবকের ছবি মনের পর্দায় ফুটে ওঠে। সেই ছবিটাই আকর্ষণ করে নিয়ে যায়। সে আকর্ষণ অগ্রাহ্য করা একরকম অসম্ভব। অবচেতনে গোপন, বাঙালির দ্রাবিড় পুরুষের চেহারায় চাষার ছেলেটি সামনে এসে দাঁড়ালে পর সজ্ঞানে হেলাফেলা করলেও অবচেতনে খোঁজখবর নিয়ে সেবাযত্ন না করে উপায় নেই। আবার যখন জসীম উদ্দীন বলেন, “ইতল বিতল ফুলের বনে ফুল ঝুরঝুর করে: দেইখ্যা আইলাম কালো মেয়ে গদাই নমুর ঘরে। ধানের পরে ধানের ছড়া তার উপরে টিয়া: নমুর মেয়ে গা মাজে রোজ তারি পাখা দিয়া”-এই চারটি পঙক্তি পাঠ করার পরে একটি কর্মিষ্ঠা কালো বরণ নমু সমাজের চঞ্চলা বালিকার ছবি যেন হাওয়া ফাঁক করে মূর্তি ধরে জেগে ওঠে। তাকে কি সুন্দরী বলা যাবে? এদেশের কাব্যে সৌন্দর্যের বাঁধা ধরা যে সংজ্ঞা প্রচলিত আছে, না সে বিচারে নমুর মেয়েকে সুন্দরী বলা যাবে না। রামায়ণ, মহাভারত, কালিদাসের কাব্য, রাধা-কৃষ্ণলীলায় এমনকি মুকুন্দরাম ভারতচন্দ্রে যে সৌন্দর্যের বর্ণনা আছে সে অর্থেও নমুকন্যা সুন্দরী নয়। ইরান তুরানের রূপকথা উপকথা অবলম্বন করে পুঁথি-সাহিত্যের যে ভাণ্ডার রচিত হয়েছে, সেখানে কাজলকাটা সুর্মা আঁকা চোখের যে সকল নায়িকাকে আদর্শ সুন্দরী হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে, তাদের দলেরও কেউ নয় আমাদের এই নমু ঘরের কালো বরণ বালিকাটি। তাহলে কি তাকে ‘সুন্দরী নয়’ বলব? এইখানে সমস্ত অনুভূতি পড়ে পাওয়া নান্দনিকবোধের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বসে, চেতনার তন্ত্রীতে তন্ত্রীতে দৈব বাণীর মতো ধ্বনিত হতে থাকে: সে সুন্দরী সে সুন্দরী। কোনো ধরনের সৌন্দর্যের সঙ্গে মেলে না কিন্তু সুন্দর হয় কেমন করে। আর অসুন্দর বলতেও মন চাইছে না, আবার সে দৈববাণী ঘোষিত হয় চেতনার স্তরে: এ সৌন্দর্য বিচারের নয় বোধ করার, বাইরের নয় ভেতরের। এ তর্ক করার নয় মেনে নেয়ার। লম্বা মাথার চুল কালো বরণ চাষীর ছেলে সে সুন্দর, নমুর ঘরের কালো মেয়ে যে সর্বক্ষণ কাজ করে বেড়ায় সে সুন্দরী। এ সুন্দর এ সুন্দরীরা শুরু থেকে আমাদের ইতিহাস আলো করে ছিল, বর্তমানে আছে এবং ভবিষ্যতে থাকবে। আমাদের উৎপাদন পদ্ধতির সঙ্গে সরাসরি জড়িত, কোনো ঔপনিবেশিক শক্তির সহায়তা যারা কস্মিনকালেও করেনি অথচ ঔপনিবেশিকতার যাঁতাকলে হাজার হাজার বছর ধরে পিষ্ট হয়ে নিজেদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সুন্দর পেলব বৈশিষ্ট্যসমূহকে অনাদর করতে শিক্ষা করেছে, জসীম উদ্দীনের কবিতা তার প্রথম শিল্পিত প্রতিবাদ। জসীম উদ্দীন কাব্যকলার সৌন্দর্য আবিষ্কার করেছেন শ্রমনিষ্ঠ মানুষ-মানুষীর মধ্যে। এই শ্রমনিষ্ঠ মানুষের অন্তরের সুন্দর সুরে সুরে মুক্তি দিয়েছেন আব্বাসউদ্দীন। এই মানুষদেরই চলার ছন্দ, জীবনস্পন্দনের হাজারোরকম বৈচিত্র্য বুলবুল চৌধুরী নাচের তালে তালে ফুটিয়ে তুলেছেন। জয়নুল আবেদীনের ছবিতে এই কর্মচঞ্চল মানুষ-মানুষীরাই নতুন প্রাণের বরে চিরদিনের জন্য আয়ুস্মান হয়ে রয়েছে। জয়নুল আবেদীনের হাত দিয়ে বাংলার চিত্রকলা নতুন একটা কক্ষপথে যাত্রা শুরু করল। জয়নুল আবেদীনের শিল্পকর্মে একটি সমাজের গভীর জীবনভাবনা আন্দোলিত হয়েছে, একটি সমাজের চলচ্ছবি দ্রুত ধাবমান বিজুরীরেখার গতিশীলতায় জীবন্ত হয়ে উঠেছে। অবনঠাকুর, নন্দলাল কিংবা যামিনী রায়কে জীবনের সে সংঘাতময় চলমানতা, সে গতিচ্ছন্দ তাদের শিল্পে মূর্ত করার কথা ভাবতে হয়নি। সে কারণ আংশিক সামাজিক এবং আংশিক শৈল্পিক। অবনীন্দ্রনাথ যে পরিবেশে মানুষ, যে বোধ উপলব্ধি তার শিল্পচর্চার রক্তবাহী শিরার মতো তাকে বেগ আবেগ দুই-ই যুগিয়েছে, সেই বোধ সেই উপলব্ধি তাকে ইতিহাসের অতি দূর দূরান্তরের পরিব্রাজক করে ছেড়েছে, রামধনুর কায়াহীন ছায়ার সঙ্গে আলিঙ্গন করিয়েছে। এদেশীয় চিত্রকলার নবজীবন প্রাপ্তির প্রদোষকালে অবনীন্দ্রনাথের এই ভূমিকা অতিশয় সঙ্গত এবং স্বাভাবিক ছিল। মাটির পৃথিবীতে অনুপম স্বর্গলোক সৃজনের প্রয়াস নন্দলালের পক্ষেই শোভা পায়। চাঁদপানা মুখের একই ডৌল একই ভঙ্গির প্রতিমা নির্মাণ যামিনী রায়কেই মানায় ভাল।