একুশে ফেব্রুয়ারি উনিশশ বাহাত্তর
একুশে ফেব্রুয়ারি উনিশশ বাহাত্তর
আজ বাংলাদেশের মানুষ, বাংলাভাষী মানুষ বাহান্নর শহীদদের স্মরণ করছেন। একটি জনযুদ্ধে জয়ের আনন্দ নিয়ে, একটি নতুন সম্ভাবনাময় শোষণমুক্ত সুসভ্য সমাজ সৃজনের দৃঢ় আকাক্ষা স্পন্দিত অন্তরে- একটি প্রবল, রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে পাকিস্তানি ফ্যাসীবাদী সেনাবাহিনীর নির্মম নৃশংস ইতিহাসের নজিরবিহীন হত্যাকাণ্ডের করুণ বেদনায় আপুত বাংলাদেশের মানুষ, বাংলাভাষী মানুষ- সমগ্র বাঙালি জাতি রাইফেল, কামান, মেশিনগান ধরা কড়পরা হাত, বাংলাভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য বিসর্জিত প্রাণ শহীদদের অন স্মৃতির প্রতি সম্মাননায় পরস্পর যুক্ত করেছেন। অপরিসীম স্পর্ধা বিনয়ে প্রশান্ত করেছেন, গর্বিত মস্তক শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসায় অবনত করেছেন। জয় হোক বাংলাভাষার, জয় হোক বাংলাভাষীর । জয়ী হোক বাংলাভাষার অপরূপ গতিভঙ্গিমা, জয় হোক বাংলার লক্ষ স্বাধীনতাপ্রেমিক শহীদের অন্তরের অনিভন্ত কামনা।
আটই ফাল্গন তথা একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে বিজয়ের, জাতীয় স্বাধীনতা অর্জনের পথে রক্তলাল তোরণদ্বার। আমাদের জাতির অন্তরে সঞ্চিত অগ্নিপ্রভ স্বদেশপ্রেমের প্রখর জ্বালামুখ, আমাদের জাতীয় অন্তরে সঞ্চিত অমৃতধারার সংলাপিত ঝরনা। বিগত বিশ বছর ধরে প্রতিটি বছর এই দিনে আমরা সবান্ধবে সমবেত হয়ে এই দিনটির জ্বলন্ত সূর্যের কাছে কায়মনোবাক্যে উজ্জ্বল জীবনের, সুন্দর জীবনের বর প্রার্থনা করেছি। অত্যাচারী শাসকের রক্ত চোখের কুটিল-দৃষ্টি এবং কুটির রেখা দেখে আমরা ভীত হইনি, সন্ত্রস্ত হইনি। অত্যাচার, অপমান, লাঞ্ছনাগঞ্জনার চণ্ডাল রাজত্বে বাস করেও আমরা এই দিনটিতে অত্যন্ত প্রসন্নভাবে উদার মন এবং বিশুদ্ধ আকাঙ্ক্ষায় বাংলাদেশের সমস্ত মানুষের হয়ে, বাংলাভাষার সমস্ত মানুষের হয়ে বড় কিছু মূল্যবান কিছু, জীবনের মতো প্রিয় সূর্যের মতো জ্বলন্ত কিছুর কামনা করেছি। গোটা বছর আমরা মূক পশুর জীবনযাপন করেছি, মানুষী প্রেরণার প্রমিথিয়ান শিখায় দগ্ধ হয়েছে আমাদের অন্তর্লোক, আঘাতে আঘাতে জর্জরিত হয়েছে আমাদের জাতীয় অস্তিত্ব। প্রতি বছর এই দিনটিতে আমাদের অন্তরের অবরুদ্ধ কামনা ময়ূরের মতো কলাপিত হয়ে উঠেছে, ক্ষোভ বজ্র নিমেষে ফেটে পড়েছে, আনন্দধারা দিগন্তরেখার ধারে ধারে অভিসার করেছে। আমাদের কবিতার প্রতীক চিত্রকল্প আকাশের নক্ষত্রমালার মতো জ্বলজ্বলে হয়ে ফুটেছে, আমাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা দোলায়িত ধানের সবুজ শীষের মতো দুলেছে, ডগায় ডগায় হাওয়া লাগা কচি পাটের চারার মতো আন্দোলিত হয়েছে। নারকীয় ষড়যন্ত্র এবং পৈশাচিক নির্যাতনের মধ্যে বাস করেও এই দিনটিতে আমরা বাংলাভাষার স্বাধীনতার দাবিতে বিসর্জিত প্রাণ শহীদদের ত্যাগের বলে বলীয়ান হয়ে মানুষ হিসেবে কথা কয়েছি, গান গেয়েছি, বেদনার্ত চিৎকারে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে তুলেছি। আমাদের শ্রম কল্পনা ও সংঘ শক্তির উপর ভরসা করে মেরুদণ্ড সোজা রেখে সমস্ত পৃথিবীর প্রতি মৈত্রীদৃষ্টি সম্প্রসারিত করেছি। এই দিনটিতে আমরা উৎসবের আসর জমিয়েছি। আদ্যিকালের প্রাগৈতিহাসিক চেতনা থেকে উৎসারিত আদিমতার ছাপ আঁকা যুথবদ্ধ উৎসব নয়। এই উৎসবের দিনের স্রষ্টা আমরা নিজেরাই, আমাদের সুসভ্য মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার তীক্ষ্ণ তাগিদ থেকে, আমাদের তরুণের লাল খুন থেকে উঠে এসেছে এই উৎসব আমাদের জনজীবনে। সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারের রক্তের উপর দাঁড়িয়ে আমরা গাঢ় গভীর স্বরে শপথের বাণী উচ্চারণ করেছি, ধৈর্যের সঙ্গে শক্তি সঞ্চয়ের প্রেরণা নিয়েছি, আঘাত খেয়েও আঘাত করার প্রচণ্ড স্পর্ধা বুকে লালন করেছি। জল যে পথে যায় রক্ত সে পথে যায় না, কেননা রক্ত জলের চাইতে গাঢ় এবং ঘন। আমরা শহীদের রক্তের উপর আস্থা স্থাপন করেছি, প্রতি বছর সে আস্থা চক্রবৃদ্ধি হারে বেড়েছে। বাহান্নর রক্ত গোটা জাতিকে আরো রক্তদানের পথে ধাবিত করেছে। বাহান্নর উৎসর্গিত প্রাণ আরো প্রাণকে উৎসর্গের পথে ডেকে নিয়ে গেছে। সে প্রাণের সীমা নেই, সংখ্যা নেই। ভেদ নেই স্ত্রী পুরুষ, জাত নেই হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খ্রিস্টান। বয়স নেই আতুর ঘরের শিশু, থুথুরে বুড়ো, শ্যামল বটের মতো উঠতি বয়সের তরুণ যুবা। বাহান্ন থেকে বাহাত্তর আমাদের জাতীয় চেতনার উন্মেষের রক্ত সূত্রটি পাহাড়িয়া নদীর মতো বেঁকে বেঁকে এগিয়ে এসেছে, রক্তে আরো রক্ত মিশেছে, প্রবাহ খরতর হয়েছে, তাতে তরঙ্গ ভেঙেছে, জোয়ার ফুলেছে, নামহারা বাংলাদেশের মানুষের ধমনীর নিঃসরিত খুনে মেঘনার স্রোত বয়েছে। এই রক্তের দরিয়ার উপকূলে আভাসিত হয়েছে বিগত বিশ বছরের প্রতিটি ফাল্গুনের উন্মথিত আকাক্ষা, উজাগর চেতনার স্বরূপ স্বাধীন স্বদেশ। স্বাধীন বাংলাদেশে আমরা আমাদের কল্পনার রত্নভাণ্ডার, স্বপ্নের মুকুল, চিন্তার চিত্রশালা, আবেগ প্রবাহের মধুভাণ্ড, গোপন বেদনার চিনাংশুকের শাড়ি,বাংলাভাষার স্বাধীনতা সংগ্রামে বিসর্জিতপ্রাণ শহীদদের অম্লান স্মৃতির প্রতি পুস্পাঞ্জলি প্রদান করছি। আমরা শহীদের রক্তে আস্থা স্থাপন করে ভুল করিনি। শহীদের রক্ত আমাদেরকে সঠিক পথেই পরিচালিত করেছে। শুধু আমরা নই, ওপার বাংলায় আমাদের ভাষার ভাই এবং সংস্কৃতির অঙ্গজ সন্তান বঙ্গবাসী এবং বঙ্গভাসী জনগণ ইতিহাসে অভূতপূর্ব বাঙালিজাতির একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার দিনে, ভাষা আন্দোলনে নিহত শহীদদের স্মৃতি তর্পণ করছেন। আমরা পশ্চিম বাংলার ভাইদের প্রতি আজ বহুদিনের অর্গলবদ্ধ প্রীতি এবং সম্প্রীতির দুয়ার উন্মুক্ত করব। বাংলাভাষাভাষী জগতে অমর হোক, শহীদের স্মৃতি অক্ষয় হোক। বাঙালির কাব্যলোক, গল্পলোক, কল্পলোক, সঙ্গীত লোক এবং সাহিত্য সৃজনকে প্রাণের মুক্তি পিপাসা, জীবনের বিচিত্র জিজ্ঞাসা, সুর-তান লয়ে রূপে রসে ছন্দে ধ্বনিত হয়ে উঠুক।