অতএব বিয়ারে নেশা হয় না, এ বড় মারাত্মক ভুল ধারণা। বন-বিখ্যাত মনিক-বিয়ারে তো আছে কুল্লে তিন, সাড়ে তিন পারসেন্ট এলকহল। যারা রাস্তায় মাতলামো করে, তারা তো এই খেয়েই করে।*[*আশ্চর্যের বিষয় ইয়োরোপের সব শহরের মধ্যে মনিকই সবচেয়ে বেশি দুধ খায়। আমাদের গডাডরের মতো।]
এদেশে আরেকটা বিপদ আছে। আঙুর সহজে পাওয়া যায় না বলে এদেশের অনেক ব্রান্ডিতেই আছে ডাইলুটেড এলকহল এবং তার সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে ব্রান্ডির সিনথেটিক সেন্ট– অর্থাৎ আঙুরের রস এতে নেই। অনেক সরল লোক ফ্লু-সর্দি সারাবার জন্যে কিংবা দুর্বল রোগীর ক্ষুধা বাড়াবার জন্য এই ব্রান্ডি খাইয়ে রোগীর ইস্টের পরিবর্তে অনিষ্ট ডেকে আনেন। এ-বিষয়ে সকলেরই সাবধান হওয়া উচিত–বিশেষ করে যেসব লোক নিজে নিজের বা আত্মীয়-স্বজনের ডাক্তারি করেন।
ফ্রাসে অত্যধিক মদ্যপান এমনি সমস্যাঁতে এসে দাঁড়িয়েছে যে, তার একটা প্রতিবিধান করা বড়ই প্রয়োজন হয়ে উঠেছে। কিন্তু কেউ সাহস করে তার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারছে না। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মাদেজ ফ্লস চেষ্টা করেছিলেন; অনেকে বলেন প্রধানমন্ত্রীত্ব হারান তিনি প্রধানত এবং গুহ্যত এই কারণে। আমেরিকা ও নরওয়েও চেষ্টা করেছিল, সফল হয়নি। রাজা যদিও আইনের বাইরে তবু নরওয়ের রাজা একদিন দুঃখ করে বলেছিলেন, দেখা যাচ্ছে, মদ না-খাওয়ার আইন একমাত্র আমিই মানি– আর সবাই তো শুনি বে-আইনি খেয়ে যাচ্ছে।
বৈদিক, বৌদ্ধ ও গুপ্তযুগে মাদকদ্রব্য সেবন করা হত ও জুয়াখেলার রেওয়াজ ছিল। আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাস শঙ্করাচার্য যে নব-হিন্দু দর্শন প্রচার করলেন সেই সময় থেকেই জনসাধারণের মদ্যপান ও জুয়াখেলা প্রায় বন্ধ হয়ে যায় (অবশ্য মুনিঋষিরা মাদকদ্রব্য ও ব্যসন বারণ করেছিলেন খৃস্টের পূর্বেই) এবং পাঠান মোগল যুগে রাজা-রাজড়া এবং উজির-বাদশারাই প্রধানত মাদকদ্রব্য সেবন করেছেন। চরমে চরম মিশে বলেই বোধ হয় অনুন্নত সম্প্রদায় ও আদিবাসীরাও খেয়েছে। ভারতবর্ষ কোন অবিশ্বাস্য অলৌকিক পদ্ধতিতে এদেশে একদা মদ জুয়া প্রায় নির্মূল করতে সক্ষম হয়েছিল সেটা আমি আবিষ্কার করতে পারিনি। পারলে আজ কাজে লাগানো যেত। ইংরেজ আমলে মদ্যপানের কিছুটা প্রচার হয়– মাইকেল ও শিশির ভাদুড়ী নীলকণ্ঠ হতে পারলে ভালো হত। ওই সময় ব্রাহ্মসমাজ, বিবেকানন্দ, অরবিন্দ, রবীন্দ্রনাথ, গাঁধী যে জীবন ও আদর্শ সামনে ধরেন তার ফলে মদ্যপান প্রসার লাভ করতে পারেনি। শুনলুম, এখন নাকি কোনও কোনও তরুণ ঝাবো-ব্লাবো ভেরেরেন ভেরেরেন করে এবং ওদের মতো উত্তম(?) কবিতা না লিখে অন্য জিনিসটার সাধনায় সুখ পায় বেশি। ইতোমধ্যে কলকারখানা হওয়ার দরুন চা-বাগানে, জুটমিলে মদ ভয়ঙ্কর মূর্তিতে দেখা দিল। মাঝিমাল্লারা অর্থাৎ সেলাররা মাতলামোর জন্য বিখ্যাত– কিন্তু আশ্চর্য, ভারতীয় ও পাকিস্তানি খালাসিরা মদ খায় না। আমাদের সৈন্যবাহিনীতে যেটুকু মদ্যপান হয় তা-ও তুচ্ছ। কলকাতার শিখেদের দেখে কেউ যেন না ভাবেন যে, দিল্লি-অমৃতসরে সম্ভ্রান্ত শিখরা মদ খান। ধর্মপ্রাণ শিখ মদ্যপানকে মুসলমানের চেয়েও বেশি ঘৃণা করেন ও বলেন, ইংরেজ শিখকে পল্টনে ঢুকিয়ে মদ খেতে শেখায়।
হিন্দু বৌদ্ধ জৈন ধর্ম ও ইসলামে মদ্যপান নিন্দিত– ইহুদি খৃস্টান ও জরথুস্ত্রী ধর্মে পরিমিত মদ্যপানকে বরদাস্ত করা হয়েছে। এবং ওইসব ধর্মের বহু প্রগতিশীল গুণী-জ্ঞানীরা অধুনা মদ্যপান-বিরোধী।
মদ্যপান এখনও এদেশে কালমূর্তিতে দেখা দেয়নি, কিন্তু আগের থেকে সাবধান হওয়া ভালো। কিন্তু পূর্বেই বলেছি– সরকার যেভাবে এগোচ্ছেন তার সঙ্গে আমার মত মেলে না। একটা উদাহরণ দি। কয়েক বৎসর পূর্বে দিল্লি শহরে পাব্লিক ড্রিংকিং, অর্থাৎ বার রেস্তোরাঁতে মদ খাওয়া বন্ধ করে দেওয়া হল। হুকুম হল, যারা খাবে তারা মদের দোকান থেকে পুরো বোতল কিনে নিয়ে অন্যত্র খাবে। অন্যত্র মানে কোথায়? স্পষ্টত বোঝা গেল বাড়িতে। কারণ পার্কে বা গাছতলায় বসে খাওয়াও বারণ। আমার প্রশ্ন, এটা কি ভালো হল? একদম বন্ধ করে দাও, সেকথা বুঝি; কিন্তু যে দেশে মদ খাওয়াটা নিন্দনীয় বলে ধরা হয়– বিশেষত মা-বোনেরা এর পাপ-স্পর্শের চিন্তাতেও শিউরে ওঠেন– সেখানে ওই জিনিস বাড়ির ভিতর প্রবর্তন কি উত্তম প্রস্তাব শুনেছি দিল্লিতে একাধিক পরিবারে এই নিয়ে দাম্পত্য কলহ হয়েছে। খুবই স্বাভাবিক। এতদিন বাইরে বাইরে খেয়ে বাড়ি ফিরতেন। ছেলেমেয়েরা
অধিকাংশ স্থলেই কিছু জানত না। এখন দাঁড়াল অন্য পরিস্থিতি। ওদিকে ব্যাচেলারদের বৈঠকখানাতে যে হট্টগোল আরম্ভ হল তার প্রতিবাদ করতে প্রতিবাসীরা সাহস পেলেন অল্পই মাতালকে ঘ্যাঁটোনো চাট্টিখানি কথা নয়।
দ্বিতীয়ত, যে ব্যক্তি বারে ঢুকে সামান্য একটু খেয়ে ক্লান্তি দূর করে বাড়িতে এসে খেয়ে-দেয়ে শুয়ে পড়ত, তাকে এখন কিনতে হল পুরো বোতল। প্রলোভনে পড়ে তার মাত্রা বেড়ে গিয়ে শেষটায় তার পক্ষে উচ্ছল হয়ে যাওয়াটা অসম্ভব নয়।
তৃতীয়ত– এবং এইটেই সবচেয়ে মারাত্মক বাড়িতে বাপের মদ্যপান ছেলেমেয়েরা দেখবেই। অনুকরণটাও অস্বাভাবিক নয়। অর্থাৎ নতুন কনভার্ট করবার ব্যবস্থা করলুম।