জর্মনির বিখ্যাত ওয়াইন রাইন (ইংরেজিতে হ) ও মোজেল। রাইন ওয়াইনের শ্যাম্পেনও হয়, তবে তাকে বলা হয় জেন্টু। শ্যাম্পেনের তুলনায় জেট নিকৃষ্ট। অথচ এই জেকট ফ্রান্সে বেচে হের ফনরিবেনট্রপ প্রচুর পয়সা কামান। হিটলার নিজে মদ খেতেন না, কিন্তু যখন শুনলেন রিবেট্রপ শ্যাম্পেনের দেশে ওঁচা জেট বিক্রি করতে পেরেছেন, তখন বিমোহিত হয়ে বললেন, যে ব্যক্তি জেটের মতো রদ্দি মাল ফ্রান্সে বেচতে পারে সে পয়লা নম্বরি সেলসমান। একে আমার চাই– এ আমার আইডিয়াজ ইংলন্ডে বেচতে পারবে। সবাই জানেন, ইনি পরে হিটলারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হয়েছিলেন ও সর্বশেষে নরনবের্গে ফাঁসিকাঠে ঝুলেছিলেন।
হাঙ্গেরির বিখ্যাত ওয়াইন টকাই ও ইতালির কিয়ান্তি।
কাশ্মীরের আঙুর দিয়ে ভালো ওয়াইন হওয়ার কথা। তাই তৈরি করে চীন, জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও আফ্রিকায় চালান দেওয়ার আমি পক্ষপাতী। অবশ্য ওরা যদি কখনও ড্রাই হতে চায়, তবে অন্য কথা।
আপেল ফার্মেন্ট করে হয় সাইডার, মধু ফার্মেন্ট করে হয় মিড (সংস্কৃত মধু থেকে মধ্বী, গ্রিকে মেথু মানে মদ, জৰ্মনে মেট–সব শব্দই সংস্কৃত মধু থেকে)। আমের রস ফার্মেন্ট করে মদ খেতেন বিখ্যাত কবি গালিব। আনারস ও কালোজাম পচিয়েও নাকি ভালো ওয়াইন হয়, সাঁওতাল আদিবাসী ও বিস্তর পার্বত্য জাতি ভাত পচিয়ে বিয়ার বানিয়ে খায়; কিন্তু ফার্মেন্ট করার ভালো কায়দা জানে না বলে তিন সাড়ে তিনের চেয়ে বেশি এলকহল পচাইয়ে তুলতে পারে না। এদের সর্ব, এদের জরুগোরু এমনকি সরল আত্মার পর্যন্ত সর্বনাশ করেছে। ইংরেজ চোলাই (ডেসটি) ধান্যেশ্বরী কালীমার্কা এদের মধ্যে চালু করে। এই ধান্যেশ্বরী একেবারে সম্পূর্ণ বন্ধ না করা পর্যন্ত এদের উদ্ধার নেই। আমার কথা বিশ্বাস না হলে উড়িষ্যার প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী নবকৃষ্ণ চৌধুরীকে শুধোবেন। ইনি আদিবাসীদের জন্য বহু আত্মত্যাগ করেছেন এবং তার প্রতিষ্ঠিত অনুগুল আশ্রমে আদিবাসীরাও শিক্ষালাভ করে। ইনিও আদিবাসীদের ড্রাই করতে চান; কিন্তু সরকার যেভাবে এগোচ্ছেন তার সঙ্গে তার একদম মতের মিল হয় না।
জাপানিদের সাকে মদ ভাতেরই পচাই, চীনাদের পচাই, চু-য়ে কিঞ্চিৎ ভুট্টা মেশানো থাকে।
ভারতবর্ষের তাড়ি (ফার্মেন্টেড খেজুর কিংবা তালের রস) বস্তুটিকে ওয়াইন পর্যায়ে ফেলা যেতে পারে। পৃথিবীর তাবৎ মাদকদ্রব্যের ভিতর এই বস্তুটিই অনিষ্ট করে সবচেয়ে কম। একমাত্র এই জিনিসটাই সম্পূর্ণ বন্ধ করা উচিত কি না সে বিষয়ে আমার মনে কিঞ্চিৎ সন্দেহ আছে। তবে খাঁটি তাড়ি সচরাচর পাওয়া যায় না; লোভী শুড়িরা তাড়ির সঙ্গে দিশি চোলাই মদ (ধান্যেশ্বরী) মিশিয়ে তার এলকহল বাড়িয়ে বিক্রি করে। মাতালরাও সচরাচর নির্বোধ হয়।
***
এতক্ষণ পচাই অর্থাৎ ফার্মেন্টেড বস্তু সম্বন্ধে বর্ণনা হচ্ছিল। এবার ডেসটিলড বা চোলাই। চোলাই বস্তুর নাম স্পিরিট– যদিও শব্দটি সর্বপ্রকার মাদকদ্রব্যের জন্যও ব্যবহার হয়।
আঙুর পচিয়ে ওয়াইন বানিয়ে সেটাকে বকযন্ত্র দিয়ে চোলাই করলে হয় ব্র্যান্ডি–অর্থাৎ ব্র্যান্ড করা বা পোড়ানো হয়েছে। একমাত্র ফরাসি দেশের ব্র্যান্ডিকেই (তা-ও সব ব্র্যান্ডি নয়) বলা হয় কন্যা (Cognac)। মল্ট-বার্লিকে পচিয়ে হয় বিয়ার; সেটাকে চোলাই করলে হয় হুইস্কি। তাড়ি চোলাই করলে হয় এরেক (শব্দটা আসলে আরক কিন্তু আরক অন্য অর্থেও ব্যবহৃত হয় বলেই এস্থলে এরেক প্রয়োগ করা হল)। সেটাকে দু বার চোলাই করে খেতেন বদ্ধ মাতাল বাদশা জাহাঙ্গীর। এরেকে ষাট পার্সেন্ট এলকহল হয়– ডবল ডেসটিল করলে আশি পর্যন্ত ওঠার কথা। সেইটে খেতেন নির্জলা! আখের রস ফার্মেন্ট করার পর চোলাই করলে হয় রাম্। সংস্কৃতে গৌড়ী–গুড় থেকে হয় বলে। জামেকার রাম্ বিশ্ববিখ্যাত। কিন্তু ভারতীয় রাম্ যদি সযত্নে তৈরি করে চালান দেওয়া হয়, তবে জামেকাকে ঘায়েল করা আমাদের পক্ষে অসম্ভব নয়। আমি ফরেন এক্সচেঞ্জ বাড়ানোর স্বপ্ন দেখি বলেই এই প্রস্তাবটি পাড়লুম। রামে এত লাভ যে তারই ফলে চিনির কারবারীরা চিনি সস্তা দরে দিতে পারে। জাভার চিনি একদা এই কারণেই সস্তা ছিল। জিন তৈরি হয় শস্য দিয়ে এবং পরে জেনিপার জামের সঙ্গে মেশানো হয়। খুশবাইটা ওই জেনিপার থেকে আসে।
এসব চোলাই করা স্পিরিটসে ৩৫ থেকে আরম্ভ করে ৮০ ভাগ এলকহল থাকে। হুইস্কি ব্র্যান্ডির চেয়ে রামে এলকহল বেশি, তার চেয়ে বেশি ডবল-চোলাই এরেকে এবং সবচেয়ে বেশি আবৃস্যাঁতে। তাই ওটাকে সবুজ শয়তান বলা হয়। শুনেছি, ও জিনিস বছর তিনেক নিয়মিতভাবে খেলে মানুষ হয় পাগল হয়ে যায়, না হয় আত্মহত্যা করে, কিংবা ডেলিরিয়াম ট্রেমেনসে মারা যায়। ইয়োরোপের একাধিক দেশে এটা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ হয়ে গিয়েছে।
সচরাচর মানুষ এসব স্পিরিটস নির্জলা খায় না। হুইস্কিতে যে পরিমাণ সোডা বা জল মেশানো হয় তাতে করে তার এলকহল ডাইলুটেড হয়ে শক্তি কমে যায়। ফলে এক গেলাস-সোডাতে যতখানি নেশা হয়, দু গেলাস বিয়ারে তাই হয়। অবশ্য নির্জলা হুইস্কি যতখানি খেয়ে স্বাস্থ্যের সর্বনাশ করা যায়, বিয়ারে প্রচুর জল আছে বলে ততখানি পেটে ধরে
বলে খাওয়া যায় না। তবে অবশ্য কেউ যদি অতি ধীরে ধীরে হুইস্কি খায় এবং অন্যজন সাত তাড়াতাড়ি বিয়ার খায় দ্বিতীয় জনেরই নেশা হবে আগে।