বাঙালি সব দিক দিয়ে পিছিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু অন্তত একটা দিকে এগিয়ে যাচ্ছে শুনে আমার উল্লাসবোধ করা উচিত ছিল, কিন্তু বহু চেষ্টা করেও পারলুম না। ঢাকার এক আমওয়ালাকে যখন বলেছিলুম যে, তার আম বড় ছোডো ছোড়ো তখন সে একগাল হেসে দেমাক করে বলেছিল, কিন্তু, কত্তা, আডি (আঁটি) গুলাইন বরো আছে! সবক্ষেত্রে পিছিয়ে যাবার আম ছোট, আর মদ্যপানের আড্ডা মোডা এ-চিন্তাটা রসাল নয়– কোনও অর্থেই!
ফেরার মুখে কলকাতাতে ডেকে পাঠালুম দ্বিজেনকে। কলেজের ছোকরা অর্থাৎ কলেজ যাওয়ার নাম করে কফি হৌস যায়– বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ, শুনেছি এদের মাথায় পেরেক পুঁতলে ইন্ড্রু হয়ে বেরোয়– মগজে অ্যাসন প্যাঁচ! তদুপরি আমার শাগরেদ!
তাকে আমার অধুনালব্ধ মাদকীয় জ্ঞানটুকু জানিয়ে বললুম, আমি তো জানতুম ইন্ডিয়া শনৈঃ শনৈঃ ড্রাই হয়ে যাচ্ছে- এ আবার কী নতুন কথা শুনি?
গুরুকে জ্ঞানদান করতে পারলে শিষ্যমাত্রই পুলকানুভব করে কাবেল, নাবালক যাই হোক না কেন। ক্ষণতরেও চিন্তা না করে বললে, মদ্যপান কলকাতাতে কারা বাড়াচ্ছে জানিনে, তবে একটা কথা ঠিক ঠিক বলতে পারি, কলেজের ছোকরাদের ভিতরও জিনিসটা ভয়ঙ্কর বেড়ে যাচ্ছে, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। ভয়ঙ্কর ভীষণ দারুণ কথাগুলো আমরা না ভেবেই বলে থাকি, কিন্তু ইউয়েনেস্কো যখন এলার্মিং শব্দটি ব্যবহার করেছে, তখন সঠিক ভয়ঙ্করই বলতে চেয়েছেন। দ্বিজেন সেটা কনফার্ম করলে। (কলেজের ছোকরারা আমার ওপর সদয় থাকুক; এটা আমার মত নয়, দ্বিজেনের।)*[* বিখ্যাত সাহিত্যিক গজেন্দ্র মিত্রও এই মত পোষণ করেন। কথাসাহিত্য, অগ্রহায়ণ ১৩৬৭ পৃ. ২৭৯, পশ্য।]
বললে, এবার যে মধুপুরে আপনার সঙ্গে দেখা করতে পারিনি, তার কারণ আমি আদপেই মধুপুর যাইনি– যখন শুনলাম, ইয়াররা যাচ্ছেন বিয়ার পার্টি করতে সেখানে। ওদের চাপ ঠেকানো আমার পক্ষে অসম্ভব হত– এদিকে মায়ের পা ছুঁয়ে কিরে কেটেছি মদ খাব না।
শ্রাদ্ধ তা হলে অনেকখানি গড়িয়েছে।
সে সন্ধ্যায় আমাদের বাড়িতে দেখি, মেলাই কলেজের ছেলেমেয়ে এসেছে। আমার ভাতিজির ইয়ারি-বক্সিনি, বন্ধুবান্ধব। মাঝে-মধ্যে ওদের সঙ্গে বসলে ওরা খুশিই হয়।
ইচ্ছে করেই ফুর্তি-ফাৰ্তির দিকে কথার নল চালালুম। চোর ধরা পড়ল। অর্থাৎ মদ্যপানের কথা উঠল।
সেদিন আমার বিস্তর জ্ঞান সঞ্চয় হয়েছিল। একের অজ্ঞতা যে অন্যের জ্ঞান সঞ্চয়ের হেতু হতে পারে, সে-কথা এতদিন জানতুম না।
এক গুণী হঠাৎ বলে উঠল, বিয়ারে আবার নেশা হয়!
আমি আশ্চর্য হয়ে বললুম, বলিস কী রে? ইয়োরোপের শতকরা ৮৫ জন লোক যখন নেশা করতে চায়, তখন তো বিয়ারই খায়। ওয়াইন খায় কটা লোক, স্পিরিট
বাধা দিয়ে বললে, বিয়ারও তো ওয়াইন।
আমি আরও আশ্চর্য হয়ে বললুম, তওবা তওবা! শুনলে গুনাই হয়। ওয়াইনে কত পার্সেন্টেজ এলকহল, আর বিয়ারে কত পার্সেন্ট, স্পিরিটে
এলকহল?
বাই উয়েইট অথবা ভলুম। দিশিটা মানে ভদ্কার পড়তুতো ভাই তার হিসেব আন্ডার প্রুফ, অভার ফে। লিক্যোর
মানে লিকার?
আমি প্রায় বাক্যহারা। লিকোর তো আবিষ্কার করেছে প্রধান ক্যাথলিক সাধুসন্ন্যাসীরা (মঙ্ক) বেনিডিটিন
সাধুসন্তরা আবিষ্কার করলেন মদ!
***
পূর্বেই বলেছি, সেদিন আমার বিস্তর জ্ঞানার্জন হয়েছিল। ওদের অজ্ঞতা থেকে।
তারও পূর্বে বলা উচিত ছিল যে, আমি মদ্যপানবিরোধী। তবে সরকার যে পদ্ধতিতে এগোচ্ছে, তার সঙ্গে আমার মতের মিল হয় না। সেকথা আরেকদিন হবে।
ঔষধার্থে ডাক্তাররা কখনও কখনও মদ দিয়ে থাকেন। ব্র্যান্ডির চেয়েও শ্যাম্পেন মিলিয়ে দিলে ভিরমি কাটে তাড়াতাড়ি। কিন্তু ব্র্যান্ডির চেয়ে শ্যাম্পেনে খরচ বেশি পড়ে বলে কন্টিনেন্টের ভালো ভালো নার্সিং হোম ছাড়া অন্য কোথাও বড় একটা ব্যবহার করা হয় না। কৃত্রিম ক্ষুধা উদ্রেকের জন্যও শেরি বা পোর্ট ব্যবহৃত হয়। এসব ব্যাপার সম্বন্ধে আমার হ্যাঁ, না, কিছু বলার নেই। তবে শীতের দেশে ব্র্যান্ডি না খেয়ে গুড়ের সঙ্গে কালো কফি খেলেও শরীর গরম হয় এবং প্রতিক্রিয়াও কম। বহু ধর্মপ্রাণ হিন্দু এবং মুসলমান কবরেজ হেকিমের আদেশ সত্ত্বেও সুরাপান করেননি ভয়ঙ্কর একটা কিছু ক্ষতি হতেও শুনিনি।
মোদ্দা কথায় ফেরা যাক।
বিয়ারে নেশা হয় না, এর মতো মারাত্মক ভুল কিছুই নেই। পূর্বেই বলেছি, ইয়োরোপে শতকরা ৮৫ জন লোক বিয়ার খেয়েই নেশা করে, মাতলামো করে।
ওয়াইন বলতে যদিও সাধারণত মাদকদ্রব্য বোঝায়, তবু এর আসল অর্থ, আঙুর পচিয়ে যে সুরা প্রস্তুত হয়, তারই নাম ওয়াইন। দ্রাক্ষাসব-এর শব্দে শব্দে অনুবাদ (অবশ্য বাজারে যেসব তথাকথিত দ্রাক্ষাসব আছে, তার ভিতর কী বস্তু আছে আমার জানা নেই)।
বিয়ারে ৪ থেকে ৬ পারসেন্ট এলকহল থাকে– বাদবাকি প্রায় সবটাই জল। নেশা হয় এই এলকহলেই। ওয়াইনের পার্সেন্টেজ দশ থেকে পনেরো। তবু বিয়ার খেয়েই নেশা করে বেশি লোক। ওয়াইন খান শুণীরা– এবং ওয়াইন মানুষকে চিন্তাশীল ও অপেক্ষাকৃত বিমর্ষ করে তোলে।
পৃথিবীতে সবচেয়ে ভালো ওয়াইন হয় ফ্রান্সে। বোর্দো (Bordeaux) অঞ্চলে তৈরি হালকা লাল রঙের ওয়াইনকে ইংরেজিতে বলা হয় ক্ল্যারেট। তাছাড়া আছে বার্গেন্ডি, এবং শ্যাম্পেন অঞ্চলের বিখ্যাত ওয়াইন। এসব ওয়াইন আঙুর পচিয়ে ফার্মেন্ট করার সময় যদি কার্ব ডায়োসাইড বেরিয়ে না যেতে দেওয়া হয়, তবে সেটাকে সফেন ওয়াইন (এফারভেসেন্ট) বলা হয়। বোর্দো বার্গেন্ডি বুজবুজ করে না– শ্যাম্পেন করে। শ্যাম্পেন খোলামাত্রই তাই তার কর্ক লাফ দিয়ে ছাতে ওঠে, এবং তার বুদ্বুদ পেটের ইনটেসটিনাল ওয়ালে খোঁচা মারে বলে নেশা হয় তাড়াতাড়ি (ভিরমি কাটে তড়িঘড়ি) এবং স্টিল (অর্থাৎ ফেনাহীন) ওয়াইনের মতো কিছুটা বিমর্ষ-বিমর্ষ সে তো করেই না, উল্টো চিত্তাকাশে উড়ুক্কু উড়ুকু ভাবটা হয় তাড়াতাড়ি।