খৃষ্টের সময় অর্থনৈতিক কুব্যবস্থা চরমে পৌঁছেছে। শোষক সম্প্রদায় জেরুজালেমে জিহোভার মন্দির প্রায় ব্যাঙ্কিং হৌসে পরিবর্তিত করে ফেলেছে–যিশু সেখান থেকে তাদের তাড়িয়ে দিচ্ছেন (মার্ক ১১/১৫)– খাজনা-ট্যাক্সে মানুষ জর্জর। যিশু, মুহম্মদ, বুদ্ধ সকলেই আত্মা, অবিনশ্বর জীবন ও নির্বাণের গূঢ় তত্ত্ব সম্বন্ধে বিচার করলেন, সহজ সরল ভাষায় চরম সত্য প্রকাশ করেছেন, রোগশোকমুক্ত অনন্ত জীবনের সন্ধান দিয়েছেন নিশ্চয়ই, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা সকলেই নতুন ধন-বণ্টন-পদ্ধতি প্রচলিত করতে চেয়েছিলেন এবং তারই ফলে অসংখ্য দীনদুঃখী এবং প্রধানত তারাই তাঁদের চতুর্দিকে সমবেত হয়েছিল। খৃষ্ট যে কামিজ নিয়ে গেলে জোব্বা দিতে বলেছেন, সে কিছু মুখের কথা নয়। তাঁর মহাপ্রস্থানের পর নবনির্মিত খৃষ্টসমাজের যে বর্ণনা পাই, তার থেকে মনে হয় মার্কস্ যে ভাবী আদর্শ সমাজের স্বপ্ন দেখেছেন, তাই সফল হয়ে গিয়েছে, সবাই সব পেয়েছির দেশের তুল্যাধিকারী নাগরিক :
And all that believed were together, and had all things common; and sold their possessions and goods and parted them to all men, as every man had need…And the multitude of them that believed were of one heart and one soul : neither said any of them that ought of the things which he possessed was his own; but they had all things common… Neither was there any among them that lacked: for as many as were possessors of lands or houses sold them, and brought the prices of the things that were sold and laid them down at the apostles feet; and distribution was made unto every man according as he had need (Acts : 2 & 4).
হযরত মুহম্মদ (স.) মক্কাতে যতদিন একেশ্বরবাদ ও আল্লার মাহাত্ম প্রচার করেছিলেন, ততদিনে মক্কাবাসী তার ওপর অসন্তুষ্ট ছিল না, কিন্তু তিনি যখন নবীন ধন-বন্টন-ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে চাইলেন, তখনই মক্কার পদস্থ জনেরা তার প্রাণনাশের সঙ্কল্প করল। পরবর্তী যুগের ইসলামে এই নবীন ধন-বণ্টন-পদ্ধতির প্রাধান্য ঐতিহাসিক মাত্রেরই জানা আছে। ইরানের এক আরব গভর্নর তখন দুঃখ করে বলেছিলেন, এই যে আজ হাজার হাজার ইরানি মুসলমান হচ্ছে, সেটা ইসলামের জন্য নয়, আর্থিক সুবিধা পাচ্ছে বলে।*[* ২. তার অর্থ অবশ্য এই নয় যে ইসলামের আদর্শবাদ এদের কেউ বুঝতে পারেনি। বস্তুত ইসলামের সাম্যবাদ, একেশ্বরবাদ, হজরতের সরল জীবনাদর্শ বহু লোককে অভিভূত করে।]
জরথুস্ত্রের আমলে দ্বন্দ্ব বেধেছে– একদিকে কৃষি ও গো-পালন, অন্যদিকে যাযাবর বৃত্তি ও লুণ্ঠন। জরথুস্ত্র দেশের ধনবৃদ্ধির জন্য কৃষি-গো-পালনের রীতি প্রবর্তন করতে চাইলে শত্রুপক্ষের হস্তে প্রাণ হারান। তাঁর ধর্ম কিন্তু জয়লাভ করল।
বুদ্ধের সময় তপোবন প্রথা প্রায় উঠে গিয়েছে, বন-জঙ্গল সাফ করা হয়ে গিয়েছে– বিস্তর লোক ভিক্ষুকের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে। ওদিকে ছোট ছোট অসংখ্য রাজ্য তাদের অর্থনৈতিক ক্রমবিকাশের চরমে পৌঁছে এমন জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে যেখানে রাজ্যে রাজ্যে শান্তিপূর্ণ সহযোগিতা না করলে আর সমস্ত দেশের শ্রীবৃদ্ধি হয় না; অথচ জাতকে দেখতে পাই, কেউ আপন রাষ্ট্রের প্রত্যন্ত প্রদেশ ত্যাগ করে ভিন্ন রাজ্যে প্রবেশ করতে গেলেই তাকে মেরে ফেলা হচ্ছে। বুদ্ধ ওইসব নিরন্নদের সঙ্রে অন্নবস্ত্র দিয়ে পাঠালেন ভিন্ন রাজ্যে শান্তির বাণী প্রচার করতে তাদের বিশেষ বেশ পরানো হল, যাতে করে সবাই তাদের সহজে চিনতে পারে। গোড়ার দিকে নিশ্চয়ই কিছু ভিক্ষু মারা গিয়েছিলেন; পরে এঁরা অক্লেশে রাজ্য থেকে রাজ্যান্তরে গেলেন। ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়ল, ঐক্য সৃষ্টি হল এবং তাই সর্ব-ভারতের মৌর্য রাজ্য সংস্থাপিত হল।
আমি একথা বলছি না যে, দেশের অর্থনৈতিক শ্রীবৃদ্ধি সাধন ও নবীন ধনবন্টন পদ্ধতি প্রচলন করাই মহাপুরুষদের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল; আমার বক্তব্য তারা এগুলোকে অবহেলা তো করেনইনি, বরঞ্চ অত্যন্ত জোর দিয়েছিলেন বলেই হ্যাভনট প্রলেটারিয়া সর্বহারারা প্রথম এসে জুটেছিল। কয়েক শতাব্দী পর ফের দেখা দেয়, আবার সেই শোষকের দল, পাদ্রিপুরুত-মোল্লারূপে। এঁরা আর ধনবণ্টনের কথা তোলেন না– আচার-অনুষ্ঠান, পূজা-প্রায়শ্চিত্তের কথাই বার বার বড় গলায় গান।
ধর্মের এই অর্থনৈতিক দিকটা নিয়ে এখনও কোনও ভালো চর্চা হয়নি।
খোশগল্প
যখন-তখন লোকে বলে, গল্প বলো।
এ বাবদে স্বৰ্গত ক্ষিতিমোহন সেনের একাধিক রসাল উত্তর আছে। তিনি বাঙাল উচ্চারণে তখন বলতেন, ঘর লেপ্যা মুছা, আতুড়ঘর বানাইয়া, মা ষষ্ঠীর গেছে বাচ্যা চাইলেই তো আর বাচ্যা পয়দা হয় না। নয় মাস দশ দিন সময় লাগে। অর্থাৎ গল্পের সময় এলে তবে গল্প বেরুবে।
ইহুদিদের গল্প এর চেয়ে একটু ভালো। কেন, সে-কথা পরে বলছি।
এক ভালো কথক রাব্বি (ইহুদিদের পণ্ডিত পুরুত) অনেকখানি হাঁটার পর অতিথি হয়ে উঠেছেন এক পরিচিত চাষার বাড়িতে। চাষা-বউ জানত, রাব্বি গল্প বলতে ভারি ওস্তাদ। পাদ্য-অর্ঘ্য না দিয়েই আরম্ভ করেছে, গল্প বলুন, গল্প বলুন। ইতোমধ্যে চাষা ভিন গাঁয়ের মেলা থেকে ফিরেছে একটা ছাগি কিনে। চাষা-বউ সঙ্গে সঙ্গেই গল্পের বায়না বন্ধ করে দুইতে গেছে ছাগিকে–ইহুদি তো! একফোঁটা দুধ বেরুল না দেখে চাষা-বউ বেজার-মুখে স্বামীকে শুধাল, এ কী ছাগি আনলে গো? বিচক্ষণ চাষা হেসে বললে, ওটা হেঁটে হেঁটে হয়রান হয়ে গিয়েছে। দানা-পানি দাও–দুধ ঠিকই দেবে। রাব্বি সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলেন, সেই কথাই তো হচ্ছে। দানা-পানি না পেলে আমিই-বা গল্প বলি কী করে?