রবীন্দ্রনাথের শতবার্ষিকী চলেছে, সেই সুবাদ নিয়েই বলছি–
বিলাতের বিখ্যাত স্ট্র্যান্ড ম্যাগাজিন একবার পৃথিবীর সেরা সেরা গুণীজ্ঞানীদের, প্রশ্ন শোধান,
১. আপনার সবচেয়ে প্রিয় পাপমতি কী (হোয়াট ইজ ইয়োর বেস্ট ফেভরিট আইস??
২. আপনার সবচেয়ে প্রিয় পুণ্যমতি কী (হোয়াট ইজ ইয়োর মোস্ট ফেভারিট ভার্চু?)? উত্তরে রবীন্দ্রনাথ লেখেন–
১. ইনকনসিসটেনসি (অর্থাৎ কোনও জিনিসে অবিচল থাকতে পারিনি– অর্থাৎ মত বদলাই)।
২. ইনকনসিসটেনসি (অর্থাৎ কোনও জিনিসে অবিচল থাকতে পারিনে– অর্থাৎ মত বদলাই)।
একবার চিন্তা করেই দেখবেন, ইকসিটেসি জিনিসটা পাপ বটে, পুণ্যও বটে।
যখন আমি স্বার্থের বশে কিংবা শত্রুভয়ে কাপুরুষের মতো আপন সত্য মত বদলাই (কুলোকে বলে এ ব্যামোটা রাজনৈতিকদের ভিতরই বেশি টার্নকোট এর নাম) তখন আমার ইকসিসটেনসি পাপ। আবার যখন বুঝতে পারি আমার পূর্বমত ভুল ছিল, তখন লোক-লজ্জাকে ড্যাম-কেয়ার করে, এমনকি প্রয়োজন হলে স্বার্থত্যাগ করেও যখন মত বদলাই তখন আমার ইনকনসিসটেনসি সাতিশয় পুণ্যকর্ম।
ঠিক সেইরকম ভৌমিক সায়েব যখন বলেন তিনি ত্রিশ বৎসরের আশ্চর্য জিনিস, আমরা সানন্দে সায় দিই। কারণ তিনি সুন্দর সুন্দর এবং চোখা চোখা মৌলিক এবং চিন্তাশীল উত্তর দিতে পারেন। কখনও আনন্দিত হয়ে বলি বাঃ, কখনও মার খেয়ে বলি আঃ।
আর তিনি না থাকলেও কোনও ক্ষতি হত না। ইংরেজিতে বলে, যা তোমার অজানা সে তোমাকে বেদনা দিতে পারে না। কিংবা বলব, আমরা জানিলাম না, আমরা কী হারাইতেছি।
একটু চিন্তা করে দেখুন, কথাটা শুধু ভৌমিক সাহেব না, টলস্টয়, কালিদাস, আপনি আমি সকলের বেলায়ই খাটে কি না।
***
রবীন্দ্রনাথ ও ইনকনসিসটেসির সুবাদে আমাদের দুটি নিবেদন আছে।
গেল মাসে মিস গেছে তার জন্যই আমি সম্পূর্ণ দায়ী নই। বড় লেখক হলে আমি অনায়াসে বলতে পারতুম, মশাই, ইন্সপিরেশ আসেনি-আমি কি দর্জি না ছুতোর অর্ডার মাফিক মাল দেব? তা নয়। আমি সাধারণ লেখক। আমি আজ পর্যন্ত কখনও ইন্সপায়ার্ড হয়ে লিখিনি। আমি লিখি পেটের ধান্দায়। পূর্বেই বলেছি, চতুর্দিকে আমার পাওনাদার। কে বলে আমি টাকার মূল্য বুঝিনে? যতবার ফুরিয়ে গিয়েছে ততবারেই হাড়ে হাড়ে বুঝেছি। একটু বেশি ব্যক্তিগত হয়ে যাচ্ছে, তবু না বলে উপায় নেই, আপনি হয়তো লক্ষ করেননি, আমি চাকরিতে থাকাকালীন কোনও প্রকারের সাহিত্যসৃষ্টি করিনে– চাকরিতে থাকাকালীন আমার কোনও বই বেরোয়নি। তখন তো পকেট গরম, লিখতে যাবে কোন মূর্খ। অতএব ইনসুপিরেশনের দোহাই কাড়লে অধর্ম হবে।
আমি গিয়েছিলুম বরদা। সেখানে আমি মধ্য যৌবনে আট বছর কাজ করি। ১৯৪৪-এ বরদা ছাড়ি। সেখানে রবি শতবার্ষিকী উদ্বোধন করতে আমাকে আহ্বান জানানো হয়, পুরনো চেনা লোক বলে, অন্য কোনও কারণে নয়। না গেলে নেমকহারামি হত। ট্রেনে লেখা যেত না? না। আপনি যদি গবেষণামূলক উচ্চাঙ্গ উন্নাসিক গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ চাইতেন সে আমি গণ্ডায় গণ্ডায় ট্রেনে-বাসে, ভেটিবুলে-তরুমূলে যেখানে-সেখানে বসে না বসে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েও লিখে দিতে পারি। কিন্তু একটুখানি রসের ভিয়েন দিতে গেলেই চিত্তির। তার জন্য ইন্সপিরেশ না হোক, অবকাশটি চাই। সাধে কি আর জি. কে, চেস্টারসন বলেছিলেন, টাইমস্ কাগজের গুরুগম্ভীর সম্পাদকীয় কলাম আমি দিনের পর দিন আধ ঘণ্টার ভিতর লিখে দিতে পারি, কিন্তু ওই যে ট্রাম-বাসের কাগজ টিট বিটস–তার পয়লা পাতার বিশটি রসিকতার চুটকিলা গল্প একসঙ্গে আমি কখনও রচনা করে উঠতে পারব না। অথচ কে না জানে, চেস্টারসন ছিলেন সে যুগের প্রধান সুরসিক লেখক। আর আমি? থাকগে।
দ্বিতীয়ত, ওই ইনকনসিসটেনসির কথা। ওটায় বাড়াবাড়ি করলে লোক ভাববে পাগল। গল্পটা তাই নিয়ে।
ট্রেনে ফেরার মুখে এক ভদ্রলোকের কাছ থেকে শোনা। এটা উনি কোনও ছাপা বই থেকে পড়ে বলেছেন কি না হলপ করতে পারব না। তবে এইটুকু বলতে পারি সেই থেকে যাকে বলেছি, তিনি উত্তরে বলেছেন, এটা তিনি আগে কখনও শোনেননি। আজ দোল-পূর্ণিমার চন্দ্রগ্রহণ ছিল– তার সঙ্গেও এর কিঞ্চিৎ যোগ (অর্থাৎ এসোসিয়েশন অব আইডিয়াজ) রয়েছে।
ক্লাস-টিচার বললেন, গত শতাব্দীর সূর্যগ্রহণ থেকে চন্দ্রগ্রহণ সংখ্যা বিয়োগ করে, তোমার কলারের সাইজের সঙ্গে এ বাড়ির থামের সংখ্যা যোগ দিয়ে, পদীপিসির নামকে ক্ষান্তমাসির নাম দিয়ে ভাগ করে বল দেখিনি আমার বয়স কত?
ছেলেরা তো অবাক! এ কখনও হয়!
একটি চালাক ছোকরা হাত তুলে বললে, আমি পারি, স্যর।
টিচার বললেন, বল।
চুয়াল্লিশ।
টিচার ভারি খুশি হয়ে বললেন, ঠিক বলেছিস। কিন্তু স্টেপগুলো বাতলা তো, কী করে তুই সঠিক রেজাল্টে পৌঁছলি।
ছেলেটি তিন গাল হেসে বললে, মাত্র তিনটি স্টেপ, স্যর। অতি সোজা :
আমাদের বাড়িতে একটা আধ-পাগলা আছে;
তার বয়স বাইশ;
অতএব আপনার বয়স চুয়াল্লিশ ॥
হুঁশিয়ার
আমরা মফস্বলের লোক। কলকাতা শহরে কী হয়, না হয় আমাদের পক্ষে খবর রাখা সম্ভবপর নয়। বয়সও হয়েছে; ছেলে-ছোকরাদের মতিগতি, কর্ম-কারবারের সঠিক খবরও কানে এসে পৌঁছায় না।
মাসকয়েক পূর্বে পূর্ব-পাকিস্তানে বেড়াতে গিয়েছিলুম। সেখানকার এক কাগজে পড়লুম ইউয়েনেস্কো নাকি কিছুদিন পূর্বে পৃথিবীর বড় বড় শহরে মদ্যপান কোন বহরে বাড়ছে; তার একটা জরিপ নেন এবং ফলে একটি মারাত্মক তত্ত্ব আবিষ্কৃত হয়েছে। সেটি এই : পৃথিবীর বড় বড় শহরের যে কটাতে মদ্যপান ভয়ঙ্কররূপে (ইন্ অ্যান এলার্মিং ডিগ্রি) বেড়ে যাচ্ছে, কলকাতা তার মধ্যে প্রধান স্থান ধরেন।