যাক সেকথা। সেই সূত্রে দেবকীবাবুর পুত্র দিলীপের সঙ্গেও পরিচয় হয়। তদ্দণ্ডেই সে আমার ন্যাওটা হয়ে যায়। খাসা ছেলে। ফিল্ম দেখেও বেড়ে ছেলে– তরুণ বৃদ্ধ এক সুরেই বলবেন।
সে ডাক্তারি প্র্যাকটিসে নামার কয়েক বৎসর পর আমি তখন ঘরের ছেলে কলকাতায় ফিরে এসেছি– দেবকীবাবু আমাকে একদিন শুধোলেন, দিলীপ কীরকম ডাক্তার!
মিত্রপুত্রের প্রশংসা করতে সবাই আনন্দ পায়; একগাল হেসে বললুম, চৌকশ, তালেবর।
মানে?
অতি সরল। এই দেখুন না, মাস ছয় আগে আমার হল দারুণ আর্ত-রাইটিস– আরব ছেড়ে ডাকলুম ডাকসাইটে অমুক ডাক্তারকে। তিনি ওষুধ দেওয়ার পর আমার এমনই অবস্থা যে আরব স্মাৰ্তরব কোনও রবই আর ছাড়তে পারিনে। তখন এলেন আরেক বাঘা ডাক্তার। তিনি নাকি মরাকে জ্যান্ত করতে পারেন। আমার বেলা হল উল্টো; জ্যান্তকে মরা করতে লাগলেন। যাই যাই। সেই যে,
এক দুই তিন,
নাড়ি বড় ক্ষীণ।
চার পাঁচ ছয়,
কী হয় না হয়।
সাত আট নয়,
মরিবে নিশ্চয়।
দশ এগারো বারো,
খাট যোগাড় করো।
আঠারো উনিশ কুড়ি
বল হরি হরি।
কী আর করি? মরি তো মরি, মরব না হয় দিলীপেরই হাতে। আর যা হোক হোক, আমাকে মানে। ভোঁতা নিডল দিয়ে শেষ ইনজেকশনটা দেবে না।
আমি থামলুম, দেবকীবাবু রুদ্ধশ্বাসে, শঙ্কিত কণ্ঠে শুধোলেন, তার পর কী হল? আপনি বেঁচে উঠেছিলেন কি?
আমি বললুম, দিলীপ বাড়িতে ছিল না, তাই আসতে পারল না। আমি সেরে উঠলুম।
তবেই দেখুন, সে ভালো ডাক্তার কি না।
সম্পাদক মশাই, আপনাদেরও কি সেই অবস্থা নয়? ডাকসাইটে অমুক লেখকের লেখা ছাপালেন। কাগজ নাবলো নিচে। বাঁচাতে গিয়ে ডেকে পাঠালেন আরেক বাঘা লেখককে। আপনাদের অবস্থা হল আরও খারাপ! তখন আমি দিলীপ– কাঁচা লেখক– চাইলেন আমার লেখা। আমি বরদায়। লেখা পাঠাতে পারলুম না। হুশ করে আপনার কাগজের মান উঁচু হয়ে গেল। বিশ্বাস না হয়, আপনার সেলস ডিপার্টমেন্টে খবর নিন– যে সংখ্যায় আমার লেখা ছিল না সেটি ইন্ডো-পাকিস্তান ক্রিকেট টিকিটের মতো বিক্রি হয়নি, ডাকে বিস্তরে বিস্তরে খোয়া যায়নি, হয়তো-বা আপনার অজানতে কালোবাজারও হয়েছে। বলতে কি, ওই সংখ্যাটি আমারও বড় ভালো লেগেছে। বিশেষ করে রঞ্জনের লেখাটি এবং ভোম্বে থেকে ভৌমিকের প্রশ্নবাণ। বস্তুত, আমি আজ ঠিক করেছিলুম এ সংখ্যাটি নিয়েই আলোচনা করব কিন্তু উপস্থিত মাত্র দু একটি মন্তব্য করে সে আলোচনা মুলতুবি রাখি।
যেমন মনে করুন, রঞ্জন লিখেছেন, বম্বের চিত্রনির্মাতা ঠিকই ধরেছেন যে অধিকাংশ দর্শক আড়াই ঘণ্টার জন্যে (যখন ছবি ওই সময়ে শেষ হয়) আপন আসন্ন পরিবেশ থেকে অব্যাহতি পেতে চায়। সত্যই কি তাই? তবে আমার প্রশ্ন, বৃদ্ধের আসন্ন পরিবেশ মৃত্যুর। এবং মৃত্যুভয় সবচেয়ে বড় ভয়। তবে বৃদ্ধেরা সিনেমা দেখতে যায় না কেন? আবার দেখুন, লড়াই যখন চলতে থাকে তখন ছুটি-ফেরা জোয়ান সেপাই জোর সিনেমা যায়। চল্লিশ এবং পঞ্চাশের মাঝামাঝি সময়েই এদেশের পরিবেশ সর্বাপেক্ষা নিরানন্দময়। ছেলেদের পড়াবার পয়সা নেই, মেয়েরা বড় হয়েছে অথচ বর জুটছে না, চাকরিতে আর যে একটা মহৎ পদোন্নতি হবে সে সম্ভাবনাও আর নেই– তবু ওই বয়সের লোক সিনেমায় যায় কম। অথচ তার কলেজি ছেলে– যার ঘাড়ে এখনও সংসারের চাপ পড়েনি, খেলাধুলো সে করতে পারে, রকবাজিও তোফা জিনিস, তার আসন্ন পরিবেশ প্রৌঢ় বা বৃদ্ধের তুলনায় অনেক কম ভয়াবহ সেই-বা ড্যাং ড্যাং করে সিনেমায় যায় কেন? না, আমার মন সাড়া দিচ্ছে না।
মঞ্জু বসু আমাদের ভৌমিক সায়েবকে শুধিয়েছেন, বারাঙ্গনা বীরাঙ্গনাতে রূপান্তরিতের একটি উদাহরণ দিন। ভৌমিক ঠিক উত্তরই দিয়েছেন– বাজিরাও প্রেমিকা মস্তানা বেগম।
আমি উল্টোটার বিস্তর উদাহরণ দিতে পারি। বীরাঙ্গনা কী করে বারাঙ্গনা হয়। যে কোনও খবরের কাগজে যে-কোনও দিন দেখতে পাবেন। আমি তো প্রথম দিনে হকচকিয়ে উঠেছিলুম। এক বিখ্যাত বাঙলা দৈনিকের প্রথম পাতার এক কোণে দেখি, একটি সৌম্যদর্শন মহিলার ফোটোগ্রাফ এবং নিচে লেখা বারাঙ্গনা– অমুক। এদের কি মাথা খারাপ না এরা পাগল যে বারাঙ্গনার ছবি কাগজের পয়লা পাতায় ঘটা করে ছাপায়। তলায়। আবার পরিচয় মহিলাটি বঁটি হাতে একা একটা ডাকাতকে ঘায়েল করে প্রাণ হারান। তখন আমার কানে জল গেল। বাঙলা হরফের উপরে ও নিচের দিকের অংশ প্রায়ই ভেঙে যায়। দীর্ঘইকারের উপরের লুপটি ভেঙে যাওয়াতে বী বদলে হয়ে গিয়েছে বা। এটা একদিনের নয়। উপরের লুপ (বঞ্চিত শব্দে উপরের হুক ভেঙে গেলে অবস্থা আরও মারাত্মক), নিচের হ্রস্বউকার গণ্ডায় গণ্ডায় নিত্যি নিত্যি ভাঙে। আমরা অভ্যাসবশে পড়ে যাই বলে লক্ষ করিনে। যদি ঠিক যেরকম ছাপাটি হয়েছে– ভাঙাচোরার পর সেরকমটি পড়েন তবে দেখবেন বিস্তর বীরাঙ্গনা বারাঙ্গনা হচ্ছেন, এবং আরও অনেক সরেস উদাহরণ পাবেন সেগুলো স্বেচ্ছায় সজ্ঞানে ছাপলে আমি সমাজে মুখ দেখাতে পারতুম না। আপনাকে বলে রাখি, এখনও পারিনে– তবে সেটা পাওনাদারের ভয়ে।
অরুণ গুহ শুধিয়েছেন, এমন একটি আশ্চর্য জিনিসের নাম বলুন যা আজ আছে কিন্তু ত্রিশ বৎসর আগে ছিল না। ভৌমিক উত্তর দিয়েছিলেন, শচীন ভৌমিক। সরেস উত্তর। তার পর অরুণ গুহ ফের শুধিয়েছেন, এমন একটি জিনিসের নাম বলুন যা না থাকলে বিশ্বের কোনও ক্ষতি হত না।- ভৌমিক উত্তর দিয়েছিলেন, অরুণ গুহ। আমি শচীন ভৌমিক হলে লিখতুম, শচীন ভৌমিক–এবারেও। কারণটা বুঝিয়ে বলি।