স্পষ্টই দেখতে পাচ্ছি, কোনও কোনও আলঙ্কারিকের মতে তিনি সক্ষম হননি, কারণ তারা বলেছেন, কালিদাস অত্যন্ত অনুচিত কর্ম করেছেন। পড়ার সময় লজ্জাবোধ সত্ত্বেও বিদ্যাভূষণ কিন্তু তাঁর নিন্দা করেননি। পড়ার সময় আমার সঙ্কোচ বোধ হয়নি, কারণ প্রতি ছত্রে আমি প্রতীক্ষায় ছিলাম, কালিদাস আমাকে তাঁর অতুলনীয় কাব্যসৃষ্টি প্রসাদাৎ সর্বশেষে আমাকে এমন দ্যোলোকে উড্ডীয়মান করে দেবেন যেখানে কামের পার্থিব মলিনতার কথা আমার স্মরণেই থাকবে না। হয়তো আমি অক্ষম, কিংবা কালিদাসের সে শক্তি ছিল না। ব্যাসের যে সে শক্তি ছিল সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু কাম সম্বন্ধে ব্যাসের মনে কোনও দ্বন্দ্ব ছিল না বলে তিনি নির্লিপ্তভাবে তার বর্ণনা দিয়েছেন।
রচনা দীর্ঘ হয়ে যাচ্ছে। সংক্ষেপে নিবেদন,
ইয়োরোপের অনুসরণ যদি আমরা অত্যধিক শুচিবায়ুগ্রস্ত হয়ে কামকে সাহিত্য থেকে তাড়িয়ে দিই তবে নিছক নির্জলা অশ্লীল রচনা উত্তরোত্তর বেড়েই যাবে। আর্টের কাজ তাকে আর পাঁচটা বিষয়বস্তুর মতো আপন কাব্যলোকে রসস্বরূপে প্রকাশ করা। কালিদাস করেছেন, চূড় কবি করেছেন, বিদ্যাপতি ভারতচন্দ্র করেছেন।
অশ্লীল সাহিত্য তাড়াবার জন্য পুলিশ সেন্সর বোর্ড বিশেষ কিছু করতে পারবে না। মার্কিন মুলুকে তারা আপনার হার মেনে নিয়েছে। বিশেষত সাহিত্যিকরাই যখন শ্লীল-অশ্লীলে ঠিক কোথায় পার্থক্য সে জিনিসটা সংজ্ঞা এবং বর্ণনা দিয়ে ভালো করে বুঝিয়ে বলতে পারেননি।
সংস্কৃত আরবি ফারসিতে নিছক অশ্লীল রচনা অতি অল্প। তার কারণ গুণী-জ্ঞানীরা রুচিবোধ ও সাধারণ জনের শুভবুদ্ধি ও কাণ্ডজ্ঞানবোধ (কমনসেন্স)। নির্ভর করতে হবে প্রধানত এই দুটি জিনিসের ওপর।
পাঠক হয়তো শুধোবেন, চ্যাটারলি বইখানা আমি পড়েছি কি না? পড়েছি। যৌবনে প্যারিসের কাফেতে বসে পড়েছি। ভালো লাগেনি। লরেন যা প্রমাণ করতে চেয়েছেন সে অতি সাধারণ জিনিস। এবং ওই অতি সাধারণ স্বতঃসিদ্ধ জিনিস প্রমাণ করতে গিয়ে তিনি দেগেছেন বিরাট বিরাট কামান। এবং কামানগুলো পরিষ্কার নয়।
সম্পাদক লেখক পাঠক
শ্ৰীযুত জলসা সম্পাদক মহাশয় সমীপেষু,
মহাশয়,
সচরাচর আমি পাঠকদের জন্যই আপনার কাগজে লিখে থাকি (এবং আপনার কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ আছি যে প্রতি সংখ্যায়ই কিছু লেখা দেব)। আপনার পড়ার জন্য নয়। কারণ আমি নিন্দুকের মুখে শুনেছি, সম্পাদকেরা এত ঝামেলার ভিতর পত্রিকা প্রকাশ করেন যে, তার পর প্রবন্ধগুলো পড়ার মতো মুখে আর তাদের লালা থাকে না। কথাটা হয়তো একেবারে মিথ্যা নয়। কারণ যেদিন আমি
তিন্তিড়ী পলাণ্ডু লঙ্কা লয়ে সযতনে
উচ্ছে আর ইক্ষুগুড় করি বিড়ম্বিত
প্রপঞ্চ ফোঁড়ন লয়ে।
রন্ধনকর্ম সমাধান করি, সেদিন আমারও ক্ষিদে সম্পূর্ণ লোপ পায়। কাজেই আপনার বিরুদ্ধে যে প্রিমা ফাশি কে একেবারেই নেই, সেকথা বলতে পারবেন না। অন্তত আমার লেখা যে আপনি একেবারেই পড়েন না, সে-বিষয়ে আমি সুনিশ্চয়– কারণ পড়া থাকলে দ্বিতীয়বারের জন্য লেখা চাইতেন না। ন্যাড়া একাধিকবার যেতে পারে বেলতলা- নিমতলা কিন্তু যায় একবারই।
ইতোমধ্যে আমি কথা দিয়েও কথা রাখতে পারিনি। অথচ দোষটা পড়েছে নিশ্চয়ই আপনার ঘাড়ে। বাঙলাতে বলে,
খেলেন দই রমাকান্ত
বিকারের বেলা গোবদ্দন!
অর্থাৎ জবান খেলাপ করলুম আমি, বিকারটা হল আপনার!
অয়, অয় জানতি পারো না–আকছারই হয়। তার কারণটাও সরল। যে-দোষ আপনি করেছেন, তার গালমন্দ আপনিই খাবেন, এ তো হক কথা, এ তো আপনার ন্যায্য প্রাপ্য। তাই তাতে আপনার ক্ষোভ থাকাটা অশোভন, কিন্তু সংসারটা তো ন্যায়ের ওপর চলে না, সে কথা তো আপনি বিলক্ষণ জানেন– তাই মাঝে মাঝে অন্যায় অপবাদ সইতে হয়। আপনারই কাগজে দেখলুম, এক পাঠক আপনাদের টাইট দিয়েছেন, রাবিশ লেখা ছাপেন কেন? উত্তরদাতা বেচারি মুখ শুকনো করে (আমি হরফগুলোর মারফতেই তাঁর চেহারাটি স্পষ্টই দেখতে পেলুম) বলছেন, নাচার, নাচার স্যার! নামকরা লেখক। অনুরোধ জানিয়েছিলুম, একটি লেখা দিতে– অজানা জনকে তো আর অনুরোধ করতে পারিনে, বৃষ্টিতে ভেজার ভয়ে পুকুরে তো আর ডুব মারতে পারিনে তার পর এসে উপস্থিত এই খাজা মাল। না ছাপিয়ে করি কী?
বিলকুল সচ্চি বাত (আপনার কাগজে হিন্দি-উর্দু শব্দের বগহার দিতে আমার বাধে না, কারণ আপনার পাঠক সম্প্রদায় পাইকিরি দরে হিন্দি ফিলিম দেখে দেখে দিব্যি হিন্দি বুঝতে পারেন)! কারণ ফ্রান্স-জর্মনিতেও বলে, বরঞ্চ রদ্দি মাল খেয়ে পেটের অসুখ করব, তবু শা– হোটেলওলাকে ফেরত দেব না, পয়সা যখন দিতেই হবে– পাছে অন্য খদ্দেরকে বিক্রি করে ডবল পয়সা কামায়! অতএব আমার মতে ছাপিয়ে দেওয়াটাই সুবুদ্ধিমানের কর্ম।
এ হেন অবস্থায় একটা মাস যে মিস্ গেছে, সেটা কি খুব খারাপ হল? বুঝলেন না? তা হলে একটি সত্যি ঘটনা বলি :
ফিল্মকাশের পূর্ণচন্দ্ৰ শ্ৰীযুত দেবকী বসু আমার বন্ধু। দিল্লিতে যখন তার রদীপের হিন্দি কার্বন কপি দেখানো হয়, তখন দিল্লির ফিল্ম সম্প্রদায় তাঁকে সেখানে নিমন্ত্রণ করে অভ্যর্থনা জানায়। স্বাগতিক ভাষণটি বলবার অনুরোধ আমাকেই করা হয়েছিল। কেন, তা জানিনে। এ তো ছাই ফেলতে ভাঙা কুলো নয়। দেবকীবাবু যদি চটকদার রাবিশ ফিল্ম বানাতেন, তবে আমি ডাক পেলে আশ্চর্য হতুম না। তখন বুঝলুম, মুক্তো তুলতে ডুবুরি অর্থাৎ জউরি, যে সত্যই মুক্তোর মূল্য জানে, সে জলে নামে না– নামে মুক্তো বাবদে আনাড়ি ডুবুরি। কারণ আমি ফিল্ম দেখতে যাইনে– এরকম একটা বদনাম তরুণদের মধ্যে আমার আছে। বৃদ্ধেরা অবশ্য খুশি হয়ে বলবেন, বা, বা, বেড়ে ছেলে, খাসা ছেলে। আমি কিন্তু বৃদ্ধের প্রশংসার চেয়ে তরুণের নিন্দাই কামনা করি। সংস্কৃতেও বলে, বৃদ্ধার আলিঙ্গনের চেয়ে তরুণীর পদাঘাত শ্রেয়।