এ দুটোর তফাত তো ইস্কুল-বয়ও জানে।
নাট্যমঞ্চে হলে তবুও না হয় ভাবতুম, হয়তো নোট ভালো করে মুখস্থ করেননি, কিন্তু এ তো বেতারের ব্যাপার– ছাপা বই তো সামনে রয়েছে।
পুনরায় প্রশ্ন করি, কী প্রয়োজন, কী প্রয়োজন? জানি পনেরো আনা শ্রোতা ভাষা সম্বন্ধে অত সচেতন নয়, কিন্তু যেখানে কোনও প্রয়োজন নেই সেখানে এক আনা লোককেই-বা কেন। পীড়া দেওয়া?
তিন নম্বর– এবং সেইটেই সবচেয়ে মারাত্মক!
রবীন্দ্রনাথের একটি গল্পকে নাটক করা হয়েছে। গল্পটি গত শতকের শেষের কিংবা এই শতকের গোড়ার পটভূমিতে আঁকা এবং নিম্ন মধ্যবর্তী শ্রেণি নিয়ে লেখা। বাপ-মায়েতে ঠিক হয়েছে অমুকের সঙ্গে মেয়েটির বিয়ে দেওয়া হবে। তখন বাপ তাঁর স্ত্রীকে শুধোচ্ছেন, তোমার মেয়ে কী বলে? মা যে কী ন্যাকরার সুরে বললে সে অবর্ণনীয়– ওকে জিগ্যেস করবে কী? সে তো সকাল-বিকাল ওরই ঘরে ঘুর ঘুর করছে। সক্কলের পয়লা কথা, সে যুগে মেয়েকে বিয়ের পূর্বে ওরকম জিগ্যেস করা হত না, সে কাকে বিয়ে করতে চায়, দ্বিতীয়ত, মেয়ের প্রেমে পড়া নিয়ে সে যুগে বাপে-মায়ে এরকম ন্যাকরা করে কথা বলা হত না।
আমার কাছে এমনি বেখাপ্পা লাগল যে, আমি কিছুতেই বুঝতে পারলুম না রবীন্দ্রনাথের পক্ষে এ জিনিস কী প্রকারে সম্ভব। তখন উঠে বই খুলে পড়ে দেখি, মেয়ের মতামত জানবার জন্য বাপ-মায়েতে এই কথোপকথন গল্পটিতে আদৌ নেই।
সস্তা, কুরুচিপূর্ণ, ন্যক্কারজনক বাজে নাটক শুনে শুনে আমাদের রুচি এমনই বিগড়ে গিয়েছে যে, প্রসার মনে করেন যে প্রচুর পরিমাণে ন্যাকামোর লঙ্কা-ফোড়ন না দিলে আমরা আর কোনও জিনিসই সুস্বাদু বলে গ্রহণ করতে পারব না। দোষ শুধু প্রডুসারের নয়, আমাদেরও।
তবে প্রশ্ন উঠতে পারে : স্বয়ং রবীন্দ্রনাথই অনেক কিছু করেছেন।
যেমন মনে করুন শ্যামা নাট্য তাঁর পরিশোধ কবিতার ওপর গড়া। আবার পরিশোধের প্লটটি জাতক থেকে নেওয়া। তাতেও আবার রবীন্দ্রনাথ মূল প্লটকে শেষের দিকে খানিকটা বদলে দিয়েছেন। এ স্থলে বক্তব্য, জাতকের গল্পেতে থাকে শুধু প্লটই। সেখানে অন্য কোনও রসের পরিবেশ থাকে না বলে সেই প্লট নিয়ে কৃতকর্মা রনির্মাতা গল্প উপন্যাস নাট্য নির্মাণ করতে পারেন। অর্থাৎ দেবীর কাঠামোর উপর মাটি-কাদা-রঙ লাগিয়ে প্রতিমা নির্মাণ করা এক কথা– সেটা সহজও, যে-যার খুশিমতো করে তাকে সুন্দর করতে পারলেই হল–কিন্তু প্রস্তুত প্রতিমার উপর আরও মাটি লাগিয়ে হাত দুটিকে আরও লম্বা করা, কিংবা দশ হাতের উপর আরও দুটি চড়িয়ে দেওয়া, সে সম্পূর্ণ অন্য কথা। দ্বিতীয়ত, রবীন্দ্রনাথ তাঁর পরিশোধকে শ্যামাতে পরিবর্তিত করতে পারেন, তার সে শক্তি আছে। সেরকম শক্তিমান আমাদের ভিতর কই? এবং আমার মনে হয় সেরকম শক্তিমান ফিল্ম ডিরেক্টর রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে টানা-হাচড়া না করেও এমন প্লট অন্যত্র পাবে সেখানে সে তার জিনিয়াস, তার সৃজনীশক্তি আরও সহজে, আরও সুন্দর করে দেখাতে পারবে।
জাতক পড়ুন, জাতক পড়ুন, জাতক পড়ন। ওর মতো ভাণ্ডার কোনও ভাষাতেই নেই। এবং রবীন্দ্রনাথ কীভাবে জাতকের প্লট নিয়ে কবিতা এবং নাট্য করতেন সেই টেকনিকটি রপ্ত করে নিন।
লেডি চ্যাটারলি
নিমিত্ত মাত্র। আসলে প্রশ্ন দাঁড়িয়েছে, সাহিত্যে শ্লীল অশ্লীলে কি কোনও পার্থক্য নেই? যদি থাকে তবে তার বিভাগ করব কোন সংজ্ঞা দিয়ে? আর যদি করা যায় তবে পুলিশের সাহায্য নিয়ে অশ্লীল জিনিস বন্ধ করব, না অন্য কোনও পন্থা আছে?
এ প্রশ্ন আজ এই প্রথম ওঠেনি সেকথা সবাই জানেন, এবং একথাও নিশ্চয়ই জানি যে, এ প্রশ্নের চূড়ান্ত সমাধান কোনওদিনই হবে না– যতদিন মানুষ গল্প লিখবে, ছবি আঁকবে, একে অন্যের সঙ্গে কথা কইবে, এমনকি, অঙ্গভঙ্গি করবে (অধুনা কলকাতার এক বিখ্যাত হোটেলে কোনও নর্তকীর নৃত্য দেখে পুলিশ বলে, এগুলো অশ্লীল, নর্তকী ও ম্যানেজার বলেন, ওগুলো উচ্চাঙ্গের নৃত্যকলা, আদালত বলেন, মহিলাটির নৃত্যের পিছনে বহু বৎসরের একনিষ্ঠ কঠোর সাধনা রয়েছে এবং সে নৃত্য কলাসৃষ্টি)।
লেডি চ্যাটারলি খালাস পেলে পর বিলেতে এ নিয়ে প্রচুর তোলপাড় হয়–অবশ্য স্মরণ রাখা ভালো যে, মার্কিন আদালত লেডি চ্যাটারলির লয়ার (লাভার না লিখে আমেরিকা লয়ার- উকিল লিখেছিল) পূর্বেই জিতে গিয়েছিলেন, এবং গত ত্রিশ বৎসর বইখানা কন্টিনেন্টের সর্বত্রই ইংরেজিতেও অনুবাদে পাওয়া যেত। আরও মনে রাখা ভালো যে, এসব বাবদে ইংরেজ সবচেয়ে পদী পিসি মার্কা, অর্থাৎ গোড়া। একটা উদাহরণ দিলে যথেষ্ট হবে। লেও বুম্ যখন ফ্রান্সের প্রধানমন্ত্রী তখন তিনি একখানা বই বের করেন, নাম মারিয়াজ বিবাহ। ভূদেববাবুর পারিবারিক প্রবন্ধ গোছের বই–যদিও রুমের মূল বক্তব্য ভূদেববাবুর ঠিক উল্টো। নানাকথার ভিতরে তার অন্যতম মূল বক্তব্য ছিল, যুবক-যুবতীরা বিয়ের পূর্বে পরিপূর্ণ যৌন অভিজ্ঞতা করে নিয়ে বিয়ে করলেই ভালো– তা হলে একে অন্যকে বোঝার সুবিধে হয়, বিবাহবিচ্ছেদের আশঙ্কা কমে যায় (!)। ইংরেজ সমালোচক তখন বলেছিলেন যে, ইংল্যান্ডের কোনও প্রধানমন্ত্রী যদি আপন নামে এরকম একখানা বই প্রকাশ করতেন। তবে পরের দিনই তাঁকে মন্ত্রিত্বে ইস্তফা দিতে হত।