এই প্রথম একটা বিচক্ষণ লোক পেলুম যে প্রথম দর্শনেই ধরে ফেলেছে, আমি কোন দেশের লোক। এস্কিমো বা মঙ্গলগ্রহবাসী কি না, শুধাল না। বললে, কোথা যাবে? ভদ্রতার খুব বেশি ধার ধারে না।
ইন্ডিয়া।
আদপেই বিচলিত না হয়ে বললে, তা হলে তো অনেকখানি পেট্রল নিতে হবে। ঠিক আছে। সামনের স্টেশনেই নিয়ে নেব। তা আপনি বন্ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন না।
শার্লক হোমসের জর্মন মামা ছিল নাকি? পরিষ্কার ভাষায় সেটা শুধালুমও।
হেসে বললে, না। শুনুন। আচ্ছা, আপনি লেফারকুজেন ফার্বেন ইনডুষ্ট্রির নাম শুনেছেন?
দুনিয়ার সবচেয়ে বড় না হোক– দুসরা কিংবা তেসরা, রঙ আর ওষুধ বানায়?
আমি অজ্ঞতা স্বীকার করলুম।
বললে, আমি সেখানে কাজ করি। এখন হয়েছে কী, আমরা পৃথিবীর প্রায় সর্বত্রই বহুত কিছু বেচি। ইন্ডিয়াও আমাদের বড় মার্কেট। একটা ওষুধের বিজ্ঞাপন ছাপাতে গিয়ে দেখি তাতে ইন্ডিয়ার যা খরচা পড়বে তার চেয়ে অনেক কম খরচায় হবে এখানে। ইন্ডিয়া থেকে ছবি ক্যাপশন আনিয়ে এখানে জোড়াতালি লাগিয়ে ছাপতে গিয়ে হঠাৎ মনে হল, এ জোড়াতালি লাগানোতে যদি উল্টো-পাল্টা হয়ে গিয়ে থাকে তবেই তো সর্বনাশ! ছাপা হবে তিন লক্ষখানা– তদুপরি মেলা রঙ-বেরঙের ছবি। খরচাটা কিছু কম হবে না– যদিও ওই যা বললুম, ইন্ডিয়ার চেয়ে অনেক কম। তাই ভাবলুম, ওটা কোনও ইন্ডিয়ানকে দেখিয়ে চেকআপ করে নি। আমাদের লেফারকুজেন শহরে কোনও ভারতীয় নেই। কাজেই কলোন বিশ্ববিদ্যালয়। গেলুম সেখানে। তারা তাদের নথিপত্র ঘেঁটে বললে, ভারতীয় ছাত্র তাদের নেই, তবে পাশে বন্ শহরে থাকলে থাকতেও পারে– সেখানে নাকি বিদেশিদের ঝামেলা। কী আর করি, গেলুম সেখানে। সেখানেও গরমের ছুটির বাজার। সবাই নাকে কানে ফ্লোরোফর্ম–আমাদের কোম্পানিরই হবে– ঢেলে ঘুমুচ্ছে। অনেক কষ্ট করে একজন ইন্ডারের নাম বাড়ির ঠিকানা বের করা গেল। তার বাড়ি গিয়ে খবর নিতে জানা গেল সে মহাত্মাও বেরিয়েছেন হাইকিঙে! লাও! বোঝ ঠ্যালা। এসেছিল তো বাবা তিন হাজার না পাঁচ হাজার মাইল দূরের থেকে! তাতেও মন ভরল না। আবার বেরিয়েছেন পায়ে হেঁটে আরও এগিয়ে যেতে। আমার আরও কাজ ছিল মানহাইমে। ভাবলুম, রাস্তায় যেতে যেতে নজর রাখব ইন্ডারপানা কেউ চোখে পড়ে কি না। তার পর এই আপনি।
আমি বললুম, আমি ইন্ডার নিশ্চয়ই, কিন্তু তাতে আপনার সমস্যার সমাধান হবে কি না বলা কঠিন। ইন্ডিয়াতে খানা তেরো চোদ্দ ভাষা! তার সব কটা তো আর আমি জানিন!
বললে, সর্বনাশ! তা হলে উপায়? সেই জোড়াতালির মাল ইন্ডিয়া পাঠাব, সেটা ফিরে আসবে, তবে ছাপা হবে, এতে করে যে মেলা দেরি হয়ে যাবে।
আমি শুধালাম, ইন্ডিয়ার কোন জায়গাতে সেটা তৈরি করা হয়েছে মনে পড়ছে কি?
বললে, বিলক্ষণ! কালকুট্টা।
আমি বললুম, তা হলে বোধহয় আপনার মুশকিল আসান হয়ে যাবে। অবশ্য জোর করে কিছু বলা যায় না। কারণ কলকাতার শহরেও সাড়ে বত্রিশরকম ভাষায় কাগজপত্র ছাপা হয়।
বেশ সপ্রতিভ কণ্ঠেই বললে, আর শুনুন। আমরা কোনও কাজই ফ্রি করাইনে। আপনি বললেও না।
আমি বললাম, আপনি কিছুমাত্র দুশ্চিন্তা করবেন না। আপনাদের মহাকবি হাইনরিষ হাইনের আমি অন্ধভক্ত। তাঁর সর্বক্ষণই লেগে থাকত তার অভাব। পেলেই খরচা করতেন দেদার এবং বে-এক্তেয়ার। তিনি বলছেন, কে বলে আমি টাকার মূল্য বুঝিনে? যখনই ফুরিয়ে গিয়েছে, তখনই বিলক্ষণ বুঝতে পেরেছি। আমার বেলাও তাই। আপনি নির্ভয়ে আপনার মাল বের করুন।
জর্মন বললে, ওই তো ডবল সর্বনাশ। আমি সেটা সঙ্গে আনিনি। মোটরে তেলমেলের ব্যাপার, জিনিসটা জখম হয়ে যেতে পারে সেই ভয়ে। তার জন্য কোনও চিন্তা নেই। সামনের কোলেস্ শহরে সবচেয়ে দামি হোটেলের ম্যানেজার আমার বন্ধু, অতিশয় পণ্ডিত এবং সজ্জন। আপনার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেব। তার সঙ্গে দু দণ্ড রসালাপ করে সত্যই আপনি আনন্দ পাবেন। আপনার হোটেল খরচা অতি অবশ্য আমাদের কোম্পানিই দেবে। আমিও প্রতিবার মানহাইম যাবার সময় সেখানে দু রাত্তির কাটিয়ে যাই। আপনাকে তার কাছে বসিয়ে আমি লেফারকুজেন যাব আর আসব।
মোটর থামল।
বাপস! রাজসিক হোটেল। ম্যানেজারটির চেহারাও যেন রাজপুতুর। আরামসে বসেছি। হোটেল খরচা দিতে হবে না। পকেটে একশো মার্ক।
ম্যানেজারের সঙ্গে গালগল্প করলুম। রাত এগারোটায় সেই জর্মন ফিরে এল। কাজকর্ম ইল। আরও একশো টাকা পেলুম।
কিন্তু বাধ সাধল পাশের ওই টেলিফোনটা। বার বার লোভ হচ্ছিল ক্যেটেকে একটা ফোন করি।
রবীন্দ্র রচনাবলি
রবীন্দ্র রচনাবলি/জন্মশতবার্ষিকী সংস্করণ। বিশ্বভারতীর সৌজন্যে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পক্ষে শিক্ষাসচিব শ্রীধীরেন্দ্রমোহন সেন কর্তৃক প্রকাশিত/২৫ বৈশাখ ১৩৬৮ বিশ্বভারতীর কর্তৃপক্ষের অনুমতিক্রমে গ্রন্থ সম্পাদনের সহায়তা করেছেন শ্রীপ্রবোধচন্দ্র সেন, শ্রীপ্রমথনাথ বিশী, শ্রীবিজনবিহারী ভট্টাচার্য, শ্রীহীরেন্দ্রনাথ দত্ত ও শ্রীঅমিয়কুমার সেন।
রবীন্দ্র রচনাবলি সদ্য প্রকাশিত দুই খণ্ড যে আমার এবং আমার মতো রবীন্দ্রানুরাগী বহু সহস্র পাঠকের মনে কী গভীর পরিতৃপ্তি : সৃষ্টি করেছে সেটি এই অবকাশেই প্রকাশ না করলে পশ্চিমবঙ্গ সরকার তথা বাঙালি জনমতের প্রতি বিলক্ষণ অবিচার করা হবে। উভয়েরই কৃতিতু সমান। রবীন্দ্ৰশতাব্দী উপলক্ষে সুলভ রবীন্দ্র রচনাবলি প্রকাশিত হোক, এই ঐকান্তিক ও ঐক্যবদ্ধ কামনা দেশের কাগজে কাগজে প্রকাশিত হয়েছে; আমরা, যাদের কথার কোনও মূল্যই নেই, যতদূর সম্ভব অনুনয়-বিনয় করেছি কর্তৃপক্ষের কাছে, উৎসাহ দিয়েছি যারা বাঙালির হয়ে তাঁদের কামনাটি বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ ও পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে জানিয়েছেন। অবশ্য বলে রাখা উচিত, এই উভয় কর্তৃপক্ষের ভিতর বিস্তর রবীন্দ্রানুরাগীও আছেন যারা এই সুলভ রচনাবলি প্রকাশের জন্য জনমত তৈরি হওয়ার পূর্বেই এ ব্যাপারে উৎসাহী ছিলেন। বলা বাহুল্য, এঁদের সকলেই বিস্তর বিরুদ্ধাচরণ অতিক্রম করে আজ সাফল্যের দ্বারে এসে পৌঁছেছেন। বলা আরও বাহুল্য বিরুদ্ধাচারীগণ যে রবীন্দ্রভক্ত নন একথা বললে অন্যায় বলা হবে। কী কারণে তারা এ প্রস্তাব অনুমোদন করেননি সে প্রসঙ্গ এস্থলে নিষ্প্রয়োজন।