আর আমিও তো অতটা নিমকহারাম নই যে এতখানি স্নেহভালোবাসা পাওয়ার পর হঠাৎ বলে বসব, আমি চললুম। যেন পচা ডিমের ভাঙা খোটা জানালা দিয়ে ফেলে দেবার মতো ওদের বাড়ি বর্জন করি!
শেষটায় মরিয়া হয়েই প্রস্তাবটা পাড়লুম।
ক্যেটে বললে, কেন? এখানে আরও কয়েকটা দিন থাকতে আপত্তি কি? তুমি যে ঘরটায় আছ সেটা সাড়ে এগারো মাস ফাঁকা থাকে, খদ্দেরদের জন্য এখানে প্রতিদিন রান্না হয় অন্তত তিরিশটা লাঞ্চ-ডিনার। একটা লোকে বেশি খেল কি কম খেল তাতে কী যায় আসে?
আমি বললুম, আমি আর তিন দিন থাকলেই তোমার প্রেমে পড়ে যাব।
আমি ভেবেছিলুম, কেটে বলবে, তাতে ক্ষতিটা কী? সে কিন্তু বললে অন্য কথা। এবং অত্যন্ত গম্ভীর স্বরে। বললে, কোনও ভয় নেই তোমার। তোমার স্বভাব প্রেমের লক্ষণে দীন (যেন, হুবহু রবীন্দ্রনাথের ভাষা)। মানুষ হঠাৎ একদিন প্রেমিক হয় না। যে প্রেমিক, সে প্রেমিক হয়েই জন্মায়। কিংবা যেমন কেউ বাকা নাক নিয়ে। যাদের কপালে প্রেমের দুর্ভোগ আছে তাদের জন্ম থেকেই আছে। তোমার সে ভয় নেই।
আমি চুপ করে রইলুম।
দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললে, অটো যত দূরে চলে যাচ্ছে আমার জীবনটা ততই ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। এই যে তোমার প্রিয় কবি হাইনরিষ হাইনে তারই একটি কবিতা আছে–
গোলাপ, কমল, কপোত, প্রভাত রবি
ভালোবাসিতাম কত যে এসব আগে,
সেসব গিয়েছে, এখন কেবল তুমি,
তোমারি মূর্তি পুরাণে কেবল জাগে!
নিখিল প্রেমের নিঝর তুমি, সে সবি–
তুমিই গোলাপ, কমল, কপোত, রবি।*
[* যতীন্দ্রমোহন বাগচীর অনুবাদ।]
কবি একদিন তাঁর প্রিয়াতেই গোলাপ, কমল, কপোত সবই পেয়ে গেলেন। কিন্তু তার পর আরেকদিন যখন তার প্রিয়া তাকে ছেড়ে চলে গেল তখন কি তিনি সঙ্গে সঙ্গে আবার গোলাপ-কমলকে ভালোবেসে সে অভাব পূর্ণ করতে পারলেন? আমার হয়েছে তাই। এ তো আর চটিজুতো নয় যে, যখন খুশি পরলে, যখন খুশি ছুঁড়ে ফেলে দিলে। এ যেন নির্জন দ্বীপে পৌঁছে নৌকোটাকে পুড়িয়ে দেওয়া।
তার পর একদিন যখন ভূমিকম্পে দ্বীপটি সমুদ্রে বিলীন হয়ে গেল তখন তুমি যাবে কোথা?
এর উত্তর আমার ঘটে নেই। তার অন্য পন্থা ধরে বললুম, তোমার বয়েস আর কতটুকু? এত শিগগির নিরাশ হয়ে গেলে চলবে কেন?
ইতোমধ্যে অটো এসে পড়াতে আমাদের এ আলোচনা বন্ধ হল। অটোকে অশেষ ধন্যবাদ। তাকে বললুমও, অটো, আপনি অনেক লোকের বহু উপকার করবেন।
অটো বুঝতে না পেরে বললে, কীরকম?
আমি বললুম, পরে বলব, আমি কাল চললুম।
অটো কিছু বলার পূর্বেই কেটে আমাকে বললে, কিন্তু তুমি তো এখনও আমার গান শোনোনি।
অটো বললে, ও সত্যি খুব ভালো গাইতে পারে।
আমি বললুম, কেটে, ডার্লিং, একটি গাও না।
পাবে’র এক প্রান্তে গ্র্যান্ড পিয়ানো। প্রায়ই দেখেছি, সেলারদের একজন কিংবা কেটে স্বয়ং সেটা বাজায়, আর বাকিরা নাচে। কেটে স্টুলে বসে মুহূর্তমাত্র চিন্তা না করে বাজাতে আরম্ভ করে। তার পরেই গান,
তুমি তো আমার
আমি তো তোমার
এই কথা জেনো,
দ্বিধা নাহি আর।
হিয়ার ভিতরে
তালা চাবি দিয়ে
রাখিনু তোমারে
থাকো মোরে নিয়ে
হারায়ে গিয়েছে
চাবিটি তালার
নিষ্কৃতি তব
নাই নাই আর।*
[*Du bist min, ich bin din:
des solt du gewis sin.
du bist beslozzen
in minem herzen:
verlorn its daz sluezelin :
du most immer drinne slin.]
গান শেষ হলে কেটে দৃপ্তপদে ফিরে এসে অটোর মুখোমুখি হয়ে তাকে শুধালে, অটো, এ গানটি তুমিই আমাকে শিখিয়েছিলে না?
.
২০.
বলা বাহুল্য যে কতখানি বলা বাহুল্য এই প্রথম টের পেলুম। ক্যেটের কাছ থেকে বিদায় নেওয়াটা উভয়ের পক্ষেই বেদনাদায়ক হয়েছিল সেটা বলা বাহুল্য, না বলাও বাহুল্য।
ধোপার কালি দিয়ে সে আমার শার্টটার ঘাড়ের ভিতরের দিকে তাদের বাড়ির ফোন নম্বর ভালো করে লিখে দিয়ে বললে, দরকার হলে আমাকে ফোন কর।
আমি শুধালুম, আর দরকার না হলে? এটা ইডিয়টের প্রশ্ন। কিন্তু আমি তখন আর কোনও কথা খুঁজে পাচ্ছিলুম না। কেটে কোনও উত্তর দিলে না। ইতোমধ্যে ক্যেটের মা-বোন এসে পড়াতে আমি যেন বেঁচে গেলুম।
ক্যেটের মা আমার গলায় একটি ক্রুশবিদ্ধ যিশুর ক্ষুদ্র মূর্তি ঝুলিয়ে দিলেন। চমৎকার সূক্ষ্ম, সুন্দর কাজ করা। এখনও আছে।
***
প্রথমটায় রাইনের পাড়ে পাড়ে সদর রাস্তা দিয়েই এগিয়ে চললুম।
এদেশের লোক বিদেশির প্রতি সত্যই অত্যধিক সদয়। পিছন থেকে যেসব গাড়ি আসছে তাদের ড্রাইভার সোওয়ার আমার ক্ষুদ্রাকৃতি, চামড়ার রঙ আর বিশেষ করে চলার ধরন দেখে বুঝে যায় আমি বিদেশি আর অনেকেই কেউ হাত নেড়ে, কেউ গাড়ি থামিয়ে জিগ্যেস করে লিফট চাই কি না। আমি মৃদু হাসির ধন্যবাদ জানিয়ে হাত নেড়ে ওদের এগোতে বলি।
মনে মনে বলি, এ-ও তো উৎপাত। আচ্ছা, এবারে তা হলে গাঁয়ের রাস্তা পাওয়া মাত্রই মোড় নেব। এমন সময় একখানা ঝা চকচকে মোটর আমার পাশে এসে দাঁড়াল। ওনার ড্রাইভার। দরজা খুলে দিয়ে আমার দিকে তাকালে। আমি যতই আপত্তি জানাই সে ততই একগুঁয়েমির ভাব দেখান। শেষটায় ভাবলুম, ভালোই, ক্যেটের থেকে যত তাড়াতাড়ি দূরে চলে যাওয়া যায় ততই ভালো। গাড়িতে বসে বললুম, ধন্যবাদ। ভদ্রলোক বললেন, মোটেই না। এই হল বুদ্ধিমানের কাজ। তার পর শুধোলে, ইডার?