অটোর আঁতে খানিকটে লেগেছে। তাই শুষ্ক কণ্ঠে বললে, মিথ্যা প্রতিমা (ফলস আইডলস্) যতদূর সম্ভব শীঘ্ন বর্জন করে সত্যধর্মে আশ্রয় নেওয়া উচিত।
আমি রীতিমতো রাগত কণ্ঠে বললুম, মিথ্যা প্রতিমা! নরনারীর প্রেম মিথ্যা, আর কোথায় কোন আফ্রিকার জঙ্গলে পড়ে আছে নিগ্রো তারা মাম্বো জাম্বো নিয়ে হয়তো সুখেই আছে, শান্তিতেই আছে– তাকে তার অজ্ঞতা, কুসংস্কার, পাপ সম্বন্ধে সচেতন করাই সবচেয়ে বড় সত্য!
শুনুন হ্যের অটো। আমার মনে কোনও সন্দেহ নেই, যে লোক ঐশীবাণীর স্পন্দন তার হৃৎপিণ্ডে অনুভব করেছে তার কিছু বাকি থাকে না–আমাদের দেশের গ্রাম্য সাধক পর্যন্ত গেয়েছে, যে জন ডুবল সখী তার কী আছে বাকি গো?
কিন্তু ধর্মের দোহাই, নরনারীর প্রেম অবহেলার জিনিস নয়, আপনি রাগ করবেন না, আমি জিগ্যেস করি, আজ যে আপনি প্রভু যিশুকে ভালোবাসতে শিখেছেন, তার গোড়াপত্তন কি ক্যেটের প্রতি আপনার প্রথম প্রেমের ওপর নয়?
টায় টায় মিলবে না, তবু একটি উদাহরণ দি। আমার একজন আত্মীয় উনিশ-বিশ বৎসর অবধি তার মাকে বড্ড অবহেলা এমনকি তাচ্ছিল্য করত। তার পর তার বিয়ে হল, বাচ্চা হল। তখন সে জীবনে প্রথম বুঝতে পারল বাচ্চার প্রতি মার ভালোবাসা কী বস্তু। তখন সে ভালোবাসতে শিখল আপন মাকে।
বৌদ্ধধর্মের সঙ্গে আপনাদের ধর্মের অনেকখানি মিল আছে। সংসারাশ্রম ত্যাগ করে, সন্ন্যাসী হয়ে বৌদ্ধধর্ম প্রচার করা সে ধর্মের অনুশাসন। অথচ জানেন, সে ধর্মেও মায়ের আসন অতি উচ্চ। বুদ্ধদেব যখন তাঁর প্রধান প্রধান শিষ্যদের নিয়ে ধর্মালোচনা করতেন তখন তাঁর একমাত্র কিশোর পুত্র রাহুল অত্যন্ত বিমর্ষ বদনে এককোণে বসে থাকত– সে তো শ্ৰমণ নয়, তার তো কোনও আসন নেই সেখানে। আপন পিতা বুদ্ধদেব পর্যন্ত শিষ্য মহামৌদগল্যায়ন, সারিপুত্তের সঙ্গে যেরকম সানন্দে কথা বললেন, তার সঙ্গে সেরকম ব্যবহার করেন না। তখন রাহুল স্থির করলেন, সন্ন্যাস নেবেন বলে। সেকথা শুনতে পেয়ে রাহুল-জননী যশোধারা নিরাশকণ্ঠে বলেছিলেন, আর্যপুত্র আমাকে বর্জন করেছেন, আমি তাঁকে পেলুম না। তিনি সিংহাসন গ্রহণ করলেন না, আমিও পট্ট-মহিষী হওয়ার গৌরব থেকে বঞ্চিত হলুম। এখন বুঝি তিনি আমার শেষ আশ্রয়ের স্থল যুবরাজ রাহুলকেও আমার কোল থেকে কেড়ে নিতে চান? একথা শুনতে পেয়ে বুদ্ধদেব অনুশাসন করেন, মাতার অনুমতি ভিন্ন কেউ শ্রমণ হতে পারবে না। আড়াই হাজার বছর হয়ে গেছে– এখনও সে অনুশাসন বলবৎ। আমার আশ্চর্য বোধ হয়, হ্যের অটো! মাতা হয়তো নিরক্ষরা, কুসংস্কারাচ্ছন্না। কিন্তু তারই ওপর নির্ভর করছে পুত্রের আদর্শবাদ, সদ্ধর্ম গ্রহণ, সবকিছু। সেই মূর্খা মাতা অনুমতি না দিলে সে সবচেয়ে মহৎ কর্ম প্রব্রজ্যা গ্রহণ করতে পারবে না– আজ আপনি যেরকম করতে পারছেন। আর এ তো আবার প্রেম।
ভগবান কোথায়?–নাস্তিক জিগ্যেস করেছিল সাধুকে, আমার যতদূর মনে পড়ছে, খৃস্টান সাধুকেই। কৃ-সাধনাসক্ত, দীর্ঘ তপস্যারত, চিরকুমার সাধু বলেছিলেন, তরুণ-তরুণীর চুম্বনের মাঝখানে থাকেন ভগবান।
.
১৯.
আমি বললুম, শ্রীমতী কেটে, কাল ভোরে আমি বেরুব।
ইতোমধ্যে তিনটি দিন কেটে গিয়েছে। ফিল্মস্টারের আদরে কদরে। শরীর একটু সুস্থ বোধ হলেই নিচের পাবে এসে বসেছি, ক্যেটের কাউন্টারের নিকটতম সোফায়। তার বোধহয় মনে রঙ ধরেছে। কিংবা তার কপাল ভালো– কী করে যেন বারের একটা ঠিকে জুটে গিয়েছে বলে অধিকাংশ সময় তার বিয়ারের মগসহ আমার সামনে বসে। আর যখন মৌজে ওঠে তখন সোফায় এসে আমার গা ঘেঁষে। অটোও প্রতি রাত্রে এসেছে। আমাদের ভিতর যতখানি ভাব জমেছে কেটে সেটা অটোর কাছ থেকে লুকোবার চেষ্টা করেনি। অটোর হাব-ভাব দেখে অনুমান করলুম, সে পড়েছে দ্বন্দ্বে। অস্কার ওয়াইল্ড় বলেছেন, আমাদের প্রত্যেকের কাছে এমন একাধিক জিনিস আছে আমরা স্বাচ্ছন্দ্যে পথের ধুলোয় ছুঁড়ে ফেলে দিতুম, যদি না জানতুম, অন্যলোকে সেগুলো তৎক্ষণাৎ কুড়িয়ে নেবে। অটো ভাবছে সে ক্যেটেকে কবুল জবাব দেওয়ামাত্রই আমি তাকে লুফে নিয়ে বটন-হোলে বসরাই গোলাপের মতো খুঁজে নেব।
একবার শুধু অটোকে বলেছিলুম, আপনাদের কবি গ্যোটে অতুলনীয়। সুদূর ভারতের আমরা যে হিদেন, আমরাও তাকে সম্মান করি। তিনি বলেছেন–
দূরে দূরে তুমি কেন খুঁজে মরো
হেরো প্রেম সে তো হাতের কাছে
শিখে নাও শুধু তারে ধরিবারে।
সে তো নিশিদিন হেথায় আছে।
Willst du immer weiter schweifen?
Sieh, das Gute liegt so nah.
Lerne nur das Glueck ergreifen.
Denn das Glueck ist immer da.
অটো এর উত্তরে কিছু না বলে শুধু অন্য কথা পেড়ে আমাকে বলেছিল, আপনি এখানে আরও কিছুদিন থাকুন। আস্তে আস্তে সব কথাই বুঝতে পারবেন।
এ আরেক প্রহেলিকা।
ক্যেটে চালাক মেয়ে। আমার উড়ন্টু ভাব বুঝতে পেরে আমাকে কিছুতেই বিদায় নেবার প্রস্তাব পাড়তে দেয় না। কী করে যে বুঝে যায়, কথার গতি ওই দিকে মোড় নিচ্ছে আর অমনি দুম করে ভারতবর্ষের ফকিরদের কাহিনী শুনতে চায়, আমার মা বছরে কবার তার বাপের বাড়ি যায়– অতিশয় ধূর্ত মেয়ে, কী করে যে বুঝে গেছে আমি আমার মায়ের গল্প বলতে সবসময়ই ভালোবাসি, আমিও একবার মূখের মতো বলেছিলুম, মায়ের গল্প সব গল্পের মামা চলে গেলে বাড়ি চালায় কে, আরও কত কী।