কুনৎস্ ফন্ ড্যার রোজেন, বল তো হাবা, আমি যখন আবার স্বাধীন হব, তখন তুই
কী করবি?
আমি আমার টুপিতে ফের ঘুঙুর সেলাই করব।
আর তোর বিশ্বস্ততা প্রভুভক্তির বদলে তোকে কী প্রতিদান, কী পুরস্কার দেব?
আঃ। আমার দিলের বাদশাকে কী বলব! দয়া করে আমার ফাঁসির হুকুমটা দেবেন না।
এইখানে হাইনে তার গল্পটি শেষ করেছেন।
আমরা বলি হা হতোস্মি, হা হতোস্মি! রাজসভার ভাড়ই হোক, আর সঙই হোক, সভা-মূর্খ হোক আর পুণ্যশ্লোক গর্দভই হোক, কুনৎস্ বিলক্ষণ জানত, রাজারাজড়ার কৃতজ্ঞতাবোধ কতখানি!
কিন্তু কাহিনীর তাৎপর্য কী?
হাইনে সেটি গল্পের মাঝখানেই বুনে দিয়েছেন। সে যুগের গল্পে দুটো ক্লাইমেকস চলত না বলে আমি সেটি শেষের-কবিতারূপে রেখে দিয়েছি।
হে পিতৃভূমি জর্মনি! হে আমার প্রিয় জর্মন জনগণ! আমি তোমাদের কুনস্ ফন ড্যার রোজেন। তার একমাত্র ধর্ম ছিল আনন্দ, যার কর্ম ছিল তোমাদের মঙ্গলদিনে তোমাদের আনন্দবর্ধন করা, তোমাদের দুর্দিনে কারা-প্রাচীর উল্লম্বন করে তোমাদের জন্য অভয়বাণী নিয়ে আসা। এই দেখ, আমার দীর্ঘ আচ্ছাদনের ভিতর লুকিয়ে এনেছি তোমার সুদৃঢ় রাজদণ্ড, তোমার সুন্দর রাজমুকুট- আমাকে স্মরণ করতে পারছ না, তুমি মহারাজ? আমি যদি তোমাকে মুক্ত না-ও করতে পারি। সান্ত্বনা তো অন্তত দিতে পারব। অন্তত তো তোমার কাছে এমন একজন আপন-জন রইল যে তোমার সঙ্গে তোমার দুঃখ-বেদনার কথা কইবে; তোমাকে আশার বাণী শোনাবে; যে তোমাকে ভালোবাসে; যার সর্বশেষ রসের কথা সর্বশেষ রক্তবিন্দু তোমারই সেবার জন্য। হে, আমার দেশবাসীগণ, তোমরাই তো প্রকৃত সম্রাট, তোমরাই তো দেশের প্রকৃত প্রভু। তোমাদের ইচ্ছা, এমনকি তোমাদের খেয়াল-খুশিই তো দেশের প্রকৃত শক্তি এ শক্তি বিধি-দত্ত রাজদণ্ডকে অনায়াসে পদদলিত করে! হতে পারে আজ তোমরা পদশৃঙ্খলিত, কারাগারে নিক্ষিপ্ত কিন্তু আর কত দিন? ওই হেরো, মুক্তির নব অৰুণোদয়!
***
হে বাঙালি, আজ তুমি দুর্দশার চরমে পৌঁছেছে।
কোথায় তোমার কুৎত্স ফ ড্যার রোজেন? যে তোমাকে আশার বাণী শোনাবে?
খৃষ্ট
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বানান মেরামতির সময় অন্যতম আইন করলেন যেসব শব্দ বাঙলায় অত্যধিক প্রচলিত হয়ে গিয়েছে সেগুলোকে বদলাবার প্রয়োজন নেই। তবে কি খৃষ্ট এবং খৃষ্টাব্দ যথেষ্ট প্রচলিত ছিল না যে ওগুলোকে খ্রীষ্ট ও খ্রীষ্টাব্দ করা হল? এবং এই নতুন বানান কি খুব শুদ্ধ? প্রথমত, খ্রী-তে দীর্ঘ ঈকার কেন? আমার কান তো বলছে, আমিই শুনেছি; দ্বিতীয়ত, গ্রিকরা তো ষ্ট বলে না বলে স্ত। অতএব অতি বিশুদ্ধ যদি লিখতেই হয় তবে লেখা উচিত খ্রিস্ত। খৃষ্ট লেখার সপক্ষে আমার অন্য যুক্তি, কথাটা সংস্কৃত সৃষ ধাতু ঘর্ষিত, মর্দিত অর্থেই গ্রিকে ব্যবহৃত হয় (এনয়েনটেড)- অর্থাৎ স্নেহাসিক্ত-স্নেহঘর্ষিত। দৃষ্ট এবং খৃষ্ট তাই হুবহু একই শব্দ (Thou anointest my head with oil; Paslms No. 23. v5–এখনও পূর্ব বাঙলার গ্রামাঞ্চলে বিয়েবাড়িতে নিমন্ত্রিত রবাহত রমণীদের মাথা তৈল ঘৃষ্ট করা হয়; আমি কারসিক নই, হলে পদে তৈলমর্দন করে যে পদোন্নতি হয়, সেদিকে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতুম; মার্কিনি ভাষাতেও to buter up কথাটা আছে)। খ্রী-এর চেয়ে খৃ লেখাতে ছাপাখানারও বোধহয় সুবিধা বেশি এবং সর্বশেষ যুক্তি, খৃষ্টানরা যেরকম এক্স অক্ষর ও ক্রুশচিহ্ন প্রভু যিশুর সম্মানার্থে আলাদা করে রেখেছেন, আমরাও না-হয় খৃ-টি তারই জন্য রেখে দিলুম।
***
ধর্মের ইতিহাস পড়ার সময় আমার সবসময়ই আশ্চর্য বোধ হয়েছে যে, বুদ্ধ, খৃষ্ট, মুহম্মদ (স.) যখন যুগ-পরিবর্তক মহান বাণী প্রচার করেছেন, তখন গুণী-জ্ঞানী যত না তাঁদের চতুর্দিকে সমবেত হয়েছে, তার চেয়ে বেশি সমবেত হয়েছে সর্বহারার দল। হযরত মুহম্মদের প্রথম শিষ্যের বহুলাংশ ক্রীতদাস, দীনহীন; খৃষ্টের শিষ্যগণ জেলে (এবং জেলে যে চাষার চেয়েও গরিব হয়, সে-ও জানা কথা) এবং তিনি পাপী-তাপী, মদ্যবিক্রেতা এবং পাপিষ্ঠা রমণীকে (মেরি ম্যাগডলিন) সঙ্গ দিতে কুণ্ঠিত হতেন না বলে সে-যুগে নিন্দাভাজন হয়েছেন। এই মহাপুরুষদ্বয়ের বিনাশ কামনা করেছেন সে-যুগের পদস্থ ব্যক্তিরাই। বুদ্ধের শিষ্য মহামগগলায়ন ও সারিপুত্ত অসংখ্য দীনহীন পথের ভিখারিকে প্রব্রজ্যা দিয়ে যে শিষ্য করেছিলেন, সেকথা জাতক পড়লেই জানা যায়। বুদ্ধকে রাষ্ট্রের বিপক্ষে দাঁড়াতে হয়নি বলে তিনি রাজসম্মান ও শ্রেষ্ঠী অনাথপিদের অর্থও পেয়েছিলেন, খৃষ্ট কাউকেই পাননি, এবং নবী মুহম্মদ (স.) আবু বকর ও ওমরের মতো সামান্য দু-একটি আদর্শবাদী শিষ্য পেয়েছিলেন।
মার্কস্ ঠিক কী ভাষায় বলেছিলেন বলতে পারব না, কিন্তু তার অন্যতম মূল বক্তব্য ছিল যে, অর্থনৈতিক কারণ ভিন্ন কোনও বিরাট আন্দোলন পৃথিবীতে হয় না। বৌদ্ধ, জৈন, জরথুস্ত্র, খৃষ্ট, ইসলাম– এই পাঁচটি পৃথিবীর বড় বড় আন্দোলন হিন্দু এবং ইহুদি ধর্ম কোনও ব্যক্তিবিশেষের চতুর্দিকে গড়ে ওঠেনি বলে এগুলো উপস্থিত বাদ দেওয়া যেতে পারে। তাই মনে প্রশ্ন জাগে, এদের পিছনে অর্থনৈতিক কারণ ছিল, কি ছিল না?
মার্কস্ এই পাঁচটি আন্দোলনকে তাঁর অর্থনৈতিক ছকে ফেলে বিচার করেছিলেন কি না জানিনে, কিংবা যে-যুগে তিনি তার ছক নির্মাণ করেন, সে-যুগে হয়তো এইসব ধর্মান্দোলনের ইতিহাস ব্যাপকভাবে ইয়োরোপীয় ভাষায় লিখিত তথা অনূদিত হয়নি বলে তাকে তার মাল-মশলা জোগাতে পারেনি।