কিন্তু এই গ্রামের ছেলে অটো এসব জানবে কোথা থেকে? সে কখনও নিগ্রোদের নিন্দা করে, কখনও পলিনেশিয়াবাসীর, কখনও-বা হিন্দু-মুসলমানের। এ সবই তার কাছে বরাবর।
আমি এক জায়গায় বাধা দিয়ে বললুম, হ্যের অটো। অন্যের পিতার নিন্দা না করে কি আপন পিতার সুখ্যাতি পাওয়া যায়?
বেশ গরম সুরে বললে, আমি অসত্যের নিন্দা করছি।
আমি বিনীত কণ্ঠে বললুম, প্রভু যিশু বলেছেন, ভালোবাসা দিয়ে পাপীতাপীর চিত্ত জয় করবে।
ক্যেটে লম্বা এক ঢোক বিয়ার গিলে, গেলাসটা ঠক করে টেবিলে রেখে বললে, হককথা।
.
১৮.
স্বার্থে স্বার্থে বেধেছে সংঘাত, লোভে লোভে ঘটেছে সংগ্রাম- কিন্তু যখন সংগ্রামটা স্বার্থে স্বার্থে না হয়ে আদর্শে আদর্শে হয় তখন সেটা হয় আরও দীর্ঘস্থায়ী এবং প্রাণঘাতী। কারণ খাঁটি মানুষ অনায়াসে স্বার্থ ত্যাগ করতে রাজি হয় কিন্তু আদর্শ বর্জন করতে রাজি হয় না।
অটোকে যদিও প্রথম দর্শনে আমার ভালো লাগেনি, তবু তর্ক করতে করতে স্পষ্ট বুঝতে পারলুম, সে খাঁটি। সে স্থির করেছে, সর্বস্ব ত্যাগ করে ধর্মপ্রচার করবে। সেটা যে ক্যেটের স্বার্থের সঙ্গে সংঘাতে এসেছে তা নয়– কেটেও খাঁটি মেয়ে, স্বার্থত্যাগ করতে প্রস্তুত ক্যেটে দেখছে, তার মার বয়েস হয়েছে, তার ছোট বোনকে ভালো যৌতুক দিয়ে বিয়ে দিতে হবে, পরিবারের মঙ্গল কামনা তার আদর্শ। দুই আদর্শ-সংঘাত! এ সংগ্রামে সন্ধি নেই, কম্প্রমাইস হতেই পারে না।
অটোকে বোঝানো অসম্ভব, খৃস্টধর্মের প্রতি তার যেরকম অবিচল নিষ্ঠা, দৃঢ় বিশ্বাস ঠিক তেমনি বৌদ্ধ শ্রমণ রয়েছেন, মুসলমান মিশনারি আছেন– আপন আপন ধর্মের প্রতি এঁদের বিশ্বাস কিছুমাত্র কম নয়। আর কেমন যেন একটা আবছা আবছা বিশ্বাস, এরা সব কেমন যেন একটা মোহাচ্ছন্ন অবস্থায়, একটা মায়ার ঘোরে আছে– খৃস্টের বাণী তাদের সামনে একবার ভালো করে তুলে ধরতে পারলেই ওরা তৎক্ষণাৎ সত্য ধর্মে আশ্রয় নেবে।
ততক্ষণে আমি বিলক্ষণ বুঝে গিয়েছি, অটোর সঙ্গে তর্কাতর্কি বা আলোচনা করা নিষ্ফল। সে তার পথ ভালো করেই ঠিক করে নিয়েছে। এবং সেটা যখন খৃস্টের পথ, তবে চলুক না সে সেই পথে।
আমি বললুম, হ্যের অটো। আমার একটি নিবেদন শুনুন। আমি ছেলেবেলায় গিয়েছি পাদ্রি ইস্কুলে, আমার প্রতিবেশীরা ছিল সব হিন্দু। ভিন্ন ধর্মের খুব কাছে আপনি কখনও আসেননি– কাজেই আমার মনের ভাব আপনি বুঝতে পারবেন না, আপনারটাও আমি বুঝতে পারব না। আমার শুধু একটি অনুরোধ– যেখানেই ধর্মপ্রচার করতে যান না কেন, প্রথম বেশ কিছুদিন সে দেশবাসীর শাস্ত্র, আচার-ব্যবহার, সামাজিক প্যাটার্ন ভালো করে দেখে নেবেন, শিখে নেবেন, তার পর যা করবার হয় করবেন।
অটোর চোখ-মুখের ভাব থেকে অনুমান করতে পারলুম না, আমার পরামর্শটা তার মনে গেঁথেছে কি না। এতক্ষণ আমি তক্কে তক্কে ছিলুম, কী করে এ আলোচনার মোড় ঘুরিয়ে অন্যদিকে চলে যাওয়া যায়। তাই শুধালুম, আপনি কোন দেশে ধর্ম প্রচার করতে যাবেন?
অটো বললে, এখনও ঠিক করিনি।
আমি তৎক্ষণাৎ আলোচনার মোড় নেবার সুযোগ পেয়ে গেলুম বললুম, ভারতবর্ষ, ইরান, আরব এসবের কোনও একটা দেশে যাবেন। অর্থাৎ যেখানকার লোকের রঙ আমার মতো বাদামি। এরাই ভগবানের সর্বোত্তম সৃষ্টি।
অটো বুঝতে না পেরে বললে, কেন? ক্যেটে বললে, আমরা জর্মনরা চামড়ার বাদামি রঙ পছন্দ করি বলে? অটো কেমন যেন একটু ঈর্ষার নয়নে আমার দিকে তাকালে। বাঁচালে। ক্যেটের প্রতি তার সর্ব দুর্বলতা তা হলে এখনও যায়নি।
আমি বললুম, বুঝিয়ে বলি। সৃষ্টিকর্তা যখন মানুষ গড়তে প্রথম বসলেন, তখন এ বাবদে তাঁর বিলকুল কোনও অভিজ্ঞতাই ছিল না। প্রথম সেট বানানোর পর সেটা বেক করবার জন্য ঢোকালেন বেকিং বক্সে। যতখানি সময় বে করার প্রয়োজন তার আগেই বাক্স খোলার ফলে সেগুলো বেরল আন্ডার-বেট, সাদা সাদা। অর্থাৎ তোমরা, ইয়োরোপের লোক। পরের বার করলেন ফের ভুল। এবারে রাখলেন অনেক বেশি সময়। ফলে বেরোল পুড়ে-যাওয়া কালো কালো। এরা নিগ্রো। ততক্ষণে তিনি টাইমিংটি ঠিক বুঝে গেছেন। এবার বেরুল উত্তম বে-করা সুন্দর ব্রাউন-ব্রেড। অর্থাৎ আমরা, ইরানি, আরব জাত।
ক্যেটে হাসতে হাসতে তখন পুনরায় আরম্ভ করল ভারতীয় নর্তকী-সৌন্দর্য-কীর্তন। এবারে অটোর হিংসা করার কিছু নেই– কারণ প্রশংসাটা হচ্ছে মেয়েদের। কিন্তু মানবসৃষ্টি রহস্যের গল্পটা শুনে সে প্রাণভরে হাসলে না। নিছক ভদ্রতা রক্ষা করার জন্য কেমন যেন শুকনো শুকনো।
আমি বললুম, আর প্রভু খৃস্টও তো ছিলেন বাদামি। তার আমলের কিছু কিছু ইহুদি এখনও প্যালেস্টাইনে আছে। তাদের বর্ণসঙ্কর দোষ নেই। এখনও ঠিক সেই সুন্দর বাদামি রঙ, মিশমিশে কালো নীল চুল। ইন্ডিয়া যাবার পথে প্যালেস্টাইন দেখে নেবেন।
ক্যেটে অভিমানভরা সুরে বললে, তুমি দেখি অটোকে দেশছাড়া করার জন্য সাত-তাড়াতাড়ি উঠে পড়ে লেগেছ!
আমি সপ্রতিভ কণ্ঠে উত্তর দিলুম, কেন, তুমি ওর সঙ্গে যাচ্ছ না?
অটো বললে, ওর অভাব কী? সৌন্দর্যদানে তো ভগবান ওর প্রতি কার্পণ্য করেননি।
ক্যেটে রোষ-কষায়িত লোচনে অটোর দিকে তাকাল। মন্তব্যটা আমারও মনে বিরক্তির সঞ্চার করল। এতক্ষণ ধর্ম নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল বলে ওকে কোনও প্রকারে আঘাত না দেবার জন্য টাপেটোপে কথা বলছিলুম, এখন আর সে পরোয়া নেই। বাঁকা হাসিটাকে প্রায় চক্রাকারে পরিবর্তিত করে বললুম, আপনি বুঝি ধরে নিয়েছেন, প্রত্যেক পরিবর্তনই প্রগতি, এবং পরিবর্তনটা করা হবে ঝটপট! আজ আছ মুসলমান, কাল হয়ে যাও খৃস্টান; আজ ভালোবাসো অটোকে, কাল ভালোবেসে ফেল ডাভিড় কিংবা ফ্রিডরিষকে! যেমন এখন খাচ্ছ বিয়ার, পরের গেলাস ভরে নাও লেমনেড দিয়ে! না?