কিন্তু আমার টেম্পারেচার দেখে সে যায় ভিরমি। আমি অতি কষ্টে তাকে বোঝালুম, এ-টেম্পারেচার জৰ্মনিতে অজানা, কারণ এটা খুব সম্ভব আমার বাল্য-সখা ম্যালেরিয়ার পুনরাগমন।
এবারে ক্যেটে সত্যই একদম ফ্যাকাশে হয়ে গেল। ম্যা–লে–রিয়া–? ওতে শুনি পুবের দেশে প্রতিদিন হাজার হাজার লোক মরে!
আমি ক্যেটের হাত আমার বুকের উপর রেখে বললুম, তুমি নিশ্চিন্ত থাকো, আমি মরব না। তদুপরি, আমাদের এতে কিছুই করবার নেই। বন, কলোন কোথাও কুইনিন পাওয়া যায় না। বন্-এ আমার এক ভারতীয় বন্ধুর ম্যালেরিয়া হয়েছিল; তখন হল্যান্ড থেকে কুইনিন আনাতে হয়েছিল, কারণ ডাচদের কাজ-কারবার আছে জ্বরে-ভর্তি ইভোনেশিয়ার সঙ্গে।
ক্যেটে সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল, তা হলে হল্যান্ডে লোক পাঠাই।
আমার দেখি নিষ্কৃতি নেই। বললুম, শোন, কেটে, আমার ডার্লিং, আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি, আজ না হোক, কাল সকালেই আমার জ্বর নেবে যাবে। তখন তুমি যাবে সত্যসত্যই ভিরমি। কারণ টেম্পারেচার অতখানি নামেও না এদেশে কখনও ৩৬ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। যদি না নামে তবে কথা দিচ্ছি, তুমি হল্যান্ডে লোক পাঠাতে পার।
তা হলে ওঠ, ব্রেকফাস্ট খাও।
এই জর্মনদের নিয়ে মহা বিপদ। প্রথম, এদের অসুখ-বিসুখ হয় কম। পেটের অসুখ তো প্রায় সম্পূর্ণ অজানা– যেটা কি না প্রত্যেক বাঙালির বার্থ-রাইট–। আর যদি-বা অসুখ করল, তখন তারা খায় আরও গোগ্রাসে। ডায়েটিং বলে কোনও প্রক্রিয়া ওদেশে নেই, উপোস করার কল্পনা ওদের স্বপ্নেও আসে না। ওদের দৃঢ়তম বিশ্বাস, অসুখের সময় আরও ঠেসে খেতে হয় যাতে করে রোগা গায়ে গত্তি লাগে।
একেই কোনও মেয়ে ছলছল নয়নে তাকালে আমি অস্বস্তি বোধ করি, তদুপরি এ মেয়ে অপরিচিতা, বিদেশিনী। এবং সবচেয়ে আশ্চর্য লাগল, যে মেয়ে রায়বাঘিনীর মতো মাতাল সেলারদের ভেড়ার বাচ্চার মতো গণনা করে, তার এই এত সুকোমল দিকটা এল কোত্থেকে? তখন মনে পড়ল, কে যেন বলেছিল, ফাঁসুড়ের ছেলের পায়ে কাঁটা ফুটলে সে কি বিচলিত হয় না?
ক্যেটেকে বললুম, তুমি দয়া করে তোমার পা সামলাওগে। আর শোনো, যাবার পূর্বে আমাকে একটি চুমো খাও তো।
এবারে ক্যেটের মুখে হাসি ফুটল। আমার দুই গালে বম্-শেল ফাটাবার মতো শব্দ করে দুটি চুমো খেয়ে যেন নাচতে নাচতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
রুচিবাগীশ পাঠকদের বলে রাখা ভালো, এদের গালে চুমো খাওয়া স্নেহ, হৃদ্যতার প্রতীক। ঠোঁটের ব্যাপার প্রেম-ট্রেম নিয়ে। যস্মিন দেশাচার। কেটে নিশ্চিত হয়ে কাজে গেল– আমি বিদেশি নই, আমি ওদেরই একজন। এই যেরকম কোনও সায়েব যদি আমাদের বাড়িতে খেতে খেতে হঠাৎ বলে ওঠে, দুটো কাঁচা লঙ্কা দাও তো, ঠাকুর–তা হলে আমরা যেরকম নিশ্চিন্ত হই।
***
জ্বর কমেছে। পাবে এসে বসেছি। জামাকাপড় ইস্ত্রি করা ছিল বলে ভদ্রলোকের মতোই দেখাচ্ছিল। কেটে পা-কিপারের মতো কেতাদুরস্ত কায়দায় আমাকে শুধোলে, আপনার আনন্দ কিসে? সঙ্গে আবার মৃদু হাস্য আপন-প্রিয় বান্ধবীর মতো।
আমি বললুম, বুইয়োঁ–বুইয়োঁ, ঘনচর্বির শুরুয়া। ওতে আর কিছু থাকে না। কেটে আরও পুরো পাক্কা নিশ্চিত হল- আমি আঁটি জর্মন হয়ে গিয়েছি। আশ্চর্য, সর্বত্রই মানুষের এই ইচ্ছা– বিদেশিকে ভালো লাগে, কিন্তু তার আচার-ব্যবহার যেন দিশির মতো হয়।
বুইয়োঁ দিতে দিতে বললে, অটোকে খবর দিয়েছি।
খানিকক্ষণ পরেই অটো এল।
স্বীকার করছি, প্রথম দর্শনেই ওকে আমার ভালো লাগেনি। জৰ্মনে যাকে বলে উন-আপেটিটলিষ–অর্থাৎ আন-এপিটাইজিং। পাঠক চট করে বলবেন, তা তো বটেই! এখন তুমি কেটেতে মজেছ। সপত্নকে আন-এপিটাইজিং মনে হবে বইকি। আমি সাফাই গাইব না, কিন্তু তবু বলি ওইটুকু ছোকরার মুখে ধর্ম ধর্ম ভাব আমার বেখাপ্পা বেমানান, এমনকি কোনও কোনও ক্ষেত্রে সির্ফ ভণ্ডামি বলে মনে হয়। অটো ফ্রন্টাল এটাক করলে। পাদ্রিরা যা আকছারই করে থাকে। খুব সম্ভব, আমিই তার পয়লা শিকার। অন্য জর্মন যেখানে ব্যক্তিগত প্রশ্ন শুধোয় না, সেখানে পাদ্রিদের চক্ষুলজ্জা অল্পই। পরে অবশ্য অনেকেই পোড় খেয়ে শেখে। শুধালে, আপনি খৃস্টান নন।
বললুম, আমি খৃস্টান নই, কিন্তু খৃস্টে বিশ্বাস করি।
সাত হাত পানিমেঁ। শুধালে, সে কী করে হয়?
আমি বললুম, কেন হবে না? খৃস্টান বিশ্বাস করে, প্রভু যিশুই একমাত্র ত্রাণকর্তা। সেই একমাত্র ত্রাণকর্তাকে সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ না করলে মানুষ অনন্তকাল নরকের আগুনে জ্বলবে। আমি বিশ্বাস করি, প্রভু বুদ্ধ, হজরত মুহাম্মদে বিশ্বাস করেও ত্রাণ পাওয়া যায়। এমনি কাউকে বিশ্বাস না করে আপন চেষ্টাতেও ত্রাণ পাওয়া যায়।
গিলতে তার সময় লাগল। বললে, প্রভু যিশুই একমাত্র ত্রাণকর্তা।
আমি চুপ করে রইলুম। এটা একটা বিশ্বাসের কথা। আমার আপত্তি করার কী আছে।
কিন্তু এর পর যা আরম্ভ করল সেটা পীড়াদায়ক। সর্ব ধর্মের মিশনারিই একটুখানি অসহিষ্ণু হয়। তাদের লেখা বইয়ে পরধর্মের প্রচুর নিন্দা থাকে। মিস মেয়োর বইয়ের মতো। অতি সামান্য অংশ সত্য, বেশিরভাগ বিকৃত সত্য, কেরিকেচার। গোড়ার দিকে আমি এসব জানতুম না। আমি বন্-এর যে পাড়াতে থাকি তারই গির্জাতে প্রতি রোববারে যেতুম বলে গির্জার পাদ্রি আমাকে একখানা ধর্মগ্রন্থ দেন। তাতে পরধর্ম নিন্দা এতই বেশি যে মনে হয় মিস মেয়ো এ বইখানাও লিখেছেন। অবশ্য এ কথাও সত্য মানুষের দ্ৰতাজ্ঞান যত বাড়ছে এ-সব লেখা ততই কমে আছে। একটা দৃষ্টান্ত দিতে পারি; ষাট সত্তর বছর আগে আমাদের দেশের খবরের কাগজে, মাসিকে তর্কাতর্কির সময় যে সৌজন্য দেখানো হত আজ আমরা তার চেয়ে অনেক বেশি দেখাই। এবং একথাও বলে রাখা ভালো যে এ-সংসারে হাজার হাজার মিশনারি আসছে, যারা কখনও পরনিন্দা করেন না। শত শত মিশনারি পরধর্মের উত্তম উত্তম গ্রন্থ আপন মাতৃভাষায় অনুবাদ করে আপন ভাষার শ্রীবৃদ্ধি সাধন করেছেন, দুই ধর্মকে একে অন্যের কাছে টেনে এনেছেন।