সময় পেলেই ‘পাবে’ ঢু মেরে আমাকে দেখে যেত। আর শনির সন্ধ্যা থেকে সোমের সকাল অবধি ছিল আমাদের ছুটি- মা তখন পাবের কাজ সম্পূর্ণ ছেড়ে দেয়নি। সে সময় পায়ে হেঁটে, বাইসিক্লে, ট্রেনে বাসে আমরা এদেশটা ইঞ্চি ইঞ্চি করে চষেছি। শেষটায় অটো কিনল একটা ক্যাম্বিসের পোর্টেবল, কলাপসিবল নৌকো। তাতে চড়ে উজানে লিৎস থেকে ভাটিতে কলোন পর্যন্ত কতবারই না আসা-যাওয়া করেছি। শুধু আমরা দু জনা, আর কেউ না। গরমের দুপুরে ননেবের্ট দ্বীপে ওই তো রাইন দিয়ে একটু ভাটার দিকে গাছতলায় শুয়ে শুয়ে, পোকার উৎপাতে মুখ রুমাল দিয়ে ঢেকে, জ্যোত্সারাতে নৌকো স্রোতের হাতে ছেড়ে দিয়ে, বরফের ঝড়ে আটকা পড়ে গ্রামের ঘরোয়া পাব বা ইনে কাটিয়েছি রাত। দু জনাতে নিয়েছি দুটি ছোট কামরা। শেষরাতে ঘুম ভাঙলে মাঝখানের দেয়ালে টোকা দিয়ে অটোকে জাগিয়েছি, কিংবা সে আমাকে জাগিয়েছে। জেলের কয়েদিরা যেরকম দেয়ালে টোকা দিয়ে সাঙ্কেতিক কথা কয়, আমরাও সেইরকম একটা কোড় আবিষ্কার করেছিলুম। আর সমস্তক্ষণ মনে মনে হাসতুম, সে অনায়াসে আমার ঘরে আসতে পারে, আমি তার ঘরে যেতে পারি তবু বড় ভালো লাগত এই লুকোচুরি।
ইস্কুলে থাকতে অটো কালে-কম্বিনে একটু-আধটু বিয়ার খেত– সে কিছু ধর্তব্যের মধ্যে নয়। চাকরি পেয়ে সে আস্তে আস্তে মাত্রা বাড়াল। আমিও সঙ্গে সঙ্গে খেতে লাগলুম। তার পর একদিন তার মাত্রা এমন জায়গায় গিয়ে পৌঁছল যার তুলনায় আমার আজকের বিয়ার খাওয়া নিতান্ত জলযোগই বলা যেতে পারে। অর্থাৎ শনির সন্ধ্যা থেকে সোমের সকাল অবধি সর্বদাই ঢুলুঢুলু নয়ন।
আমি মন্তব্য করিনি, বাধাও দিইনি। যতখানি পারি তাকে সঙ্গ দিতুম।
তার পর একদিন হল এক অদ্ভুত কাণ্ড। পড়ল কোন এক টেম্পারেন্স না কিসের যেন পাদ্রির পাল্লায়। তাদের নাকি সবরকম মাদকদ্রব্য বর্জন করা ধর্মেরই অঙ্গ! আমরা ক্যাথলিক। মদ খাই–বাড়াবাড়ি না করলেই হল। ফ্রান্সসকানর, বেনেডিটিনার এসব ভালো ভালো লিকোর তো আবিষ্কার করেছে পাদ্রিসায়েবরাই। আমাদের গায়ে পাদ্রি সায়েবের সেলারে যে মাল আছে তা আমার পাবের চেয়ে কোনও অংশে কম নয়।
অটো দুম করে মদ ছেড়ে দিল। আমি খেলে আমার দিকে আড় নয়নে তাকায়। এ আবার কী?
মদ সিগরেট কোনও-কিছু একটা হঠাৎ ছেড়ে দিলে মানুষ খিটখিটে হয়ে যায়। অটো আমাকে ভালোবাসত বলে সেটা যতদূর সম্ভব চাপবার চেষ্টা করত। আমি টের পেতুম।
জানিনে, পুরনো অভ্যাসবশত, না কর্তব্যজ্ঞানে সে তখনও আমার সঙ্গে শনি রবি বাইরে যায়, কিন্তু কেমন যেন তার জমতে চায় না। একদিন তো বলেই ফেললে, আমার মুখে বিয়ারের গন্ধ!
শোন কথা! দু দিন আগেও দু দণ্ড চলত না তোমার যে বিয়ার না খেয়ে, সেই বিয়ারে তুমি পাও এখন গন্ধ!
তখন– এখন না– তখন ইচ্ছে করলে আমি বোধহয় বিয়ার ছাড়তে পারতুম, কিন্তু আমার মনে হল, এ তো বড় এক অদ্ভুত ন্যাকরা। আমাকে তুমিই খেতে শেখালে বিয়ার আর এখন তুমি হঠাৎ বনে গেলে বাপের সুপত্নর। এখন বিয়ারের গন্ধে তোমার বাইবেল অশুদ্ধ হয়!
আমি বললুম,
জাতে ছিল কুমোরের ঝি,
সরা দেখে বলে এটা কী?
ক্যেটেকে প্রবাদটা বোঝাতে বেশিক্ষণ লাগেনি।
ক্যেটে বললে, ভুল করলুম না ঠিক করলুম জানিনে আমি ভাবলুম, এরকম ন্যাকামোকে আমি যদি এখন লাই দিই, তবে ভবিষ্যতে কতকিছুই না হতে পারে। একদিন সে ন্যুডিস্ট কলোনিতে মেম্বার হতে চেয়েছিল, আমি বাধা দিয়েছিলুম– কেমন যেন ও জিনিসটা আমার বাড়াবাড়ি বলে মনে হয় পরে সে বলেছিল, আমি বাধা দিয়ে ভালোই করেছিলুম। এখন যে তাই হবে না কে জানে।
ইতোমধ্যে এল আরেক গেরো।
বলা-নেই, কওয়া-নেই হঠাৎ একদিন এসে বলে, সে পাদ্রি হবে, সে নাকি ভগবানের ডাক শুনতে পেয়েছে। আমি তো গলাভর্তি বিয়ারে হাসির চোটে বিষম খেয়ে উঠেছিলাম। শেষটায় ঠাট্টা করে শুধিয়েছিলুম, পৃথিবীতে কত শত অটো আছে। তুমি কী করে জানলে, আকাশ বাণী তোমার জন্যই হয়েছে।
রাগে গরগর করতে করতে অটো চলে গেল।
অর্থাৎ তা হলে আমাদের আর বিয়ে হতে পারে না।
সেই থেকে, এই তিন মাস ধরে চলেছে টানাপড়েন। পরপর দুই শনি যখন এটা ওটা অছিলা করে আমার সঙ্গে এস্কাশনে বেরোল না, তখন আমিও আর চাপ দিলুম না। এখন মাঝে মাঝে রাত দশটা-এগারোটায় পাবে এসে এক কোণে বসে, আর বিশ্বাস করবে না, লেমনেড হ্যাঁ হ্যাঁ, লেমনেড খায়! আমি বিয়ার হাতে তার পাশে গিয়ে বসি।
ধর্ম আমি মানি। খৃস্টে আমার বিশ্বাস আছে। কিন্তু ধর্মের এ কী উৎপাত আমার ওপর আমি পাব-ওয়ালির মেয়ে। আমার ধর্ম বিয়ারে ফাঁকি না দেওয়া, যে বানচাল হবার উপক্রম করছে তাকে আর মদ না বেচে বাড়িতে পাঠিয়ে দেবার ব্যবস্থা করা, মা-বোনের দেখভাল করা– আমি না হতে যাব কোন দুঃখে।
তবু জানো, এখনও তার পদধ্বনির প্রতীক্ষা করি।
ক্যেটের গলায় কীরকম কী যেন একটা জমে গেছে। তুমি ঘুমুও বলে আলো নিভিয়ে দিয়ে হুট করে চলে গেল।
.
১৭.
পড়ল পড়ল বড় ভয়
পড়ে গেলেই সব সয়।
ভোরের দিকে ভয় হয়েছিল, বৃষ্টিতে ভেজার ফলে যদি আরও জ্বর চড়ে। চড়লও। তখন সর্ব দুর্ভাবনা কেটে গেল। এবার যা হবার হবে। আমার কিছু করবার নেই।
সকালে ঘুম ভাঙতেই কিন্তু সর্বপ্রথম লক্ষ করেছিলুম, খাটের পাশে চেয়ারে আমার সব জামা-কাপড় পরিপাটি ইস্ত্রি করে সাজানো, ড্রাইক্লিনিঙেরও পরশ আছে বোঝা গেল। ধন্যি মেয়ে? কখনই-বা শুতে গেল, আর কখনই-বা সময় পেল এসব করবার।