ক্যেটে অনেকক্ষণ ধরে বিয়ারে চুমুক দেয়নি, সিগারেটও ধরায়নি। প্রেমে তো নেশা আছে বটেই, প্রেমের স্মরণেও নেশা– অন্য নেশার প্রয়োজন হয় না।
ক্যেটে বললে, আশ্চর্য এবং তুমিও বিশ্বাস করবে না, আমি তখনও বুঝতে পারিনি, কবিরা একেই নাম দিয়েছেন প্রেম। প্রেমের যা বর্ণনা কবিরা দিয়েছেন তাতে আছে, মানুষের সর্বসত্তা নাকি তখন বিরাটতম চৈতন্যলোকে নিমজ্জিত হয় এবং পরমুহূর্তেই সে নাকি নভোমণ্ডলে উড্ডীয়মান হতে হতে দ্যুলোক সুরলোক হয়ে হয়ে ব্রহ্মাণ্ডাতীত লোকে লীন হয়ে যায়; আর আমি ভাবছি, কাল যদি ঝড় হয় তবে আমি ইস্কুলে যাব কী করে! দুটো যে একই জিনিস জানব কী করে?
পরদিন দেখি, আকাশ বাতাস সুপ্রসন্ন! আসন্ন বর্ষণেরও কোনও আভাস নেই।
অন্য দিন মায়ের তাড়া খেতে খেতে হন্তদন্ত হয়ে শেষ মুহূর্তে বাড়ি থেকে বেরুতুম, ইস্কুল যাবার জন্যে ছোট বোন বিরক্ত হয়ে আগেই বেরিয়ে যেত; আজ আমি একঘণ্টা আগে থেকেই তৈরি। অন্যদিন জুতোতে কালি বুরুশ লাগাবার ফুরসত কোথায়? আজ ফিটফাট। আমি জামা-কাপড় সম্বন্ধে চিরকালই একটু উদাসীন– অন্য মেয়েদের মতো নই আজ ওয়ার্ডরোবের সামনে দাঁড়িয়ে মনে হল এ যেন সার্কাসের সঙের ওয়ার্ডরোব খুলেছি।
আমি বললুম, তোমাকে সাদা-মাটা কাপড়েই এত সুন্দর দেখায় যে বাহারে জামা কাপড় পরলে যে আরও শ্রীবৃদ্ধি হবে তা আমার মনে হয় না। এক লিটার বিয়ারের মগে এক লিটারই ধরে। সস্তা বিয়ার দিয়ে না ভরে দামি শ্যাম্পেন দিয়ে ভরলেও তাই।
ক্যেটে বললে, থ্যাঙ্কস্। সুন্দরী বলাতে ইতোমধ্যে দু বার তাড়া খেয়েছি। এবারে দেখি, সে মোলায়েম হয়ে গিয়েছে।
বললে, অটোও এখন বলে আমাকে সাদা-মাটাতেই ভালো দেখায়। একটু করুণ হাসি হাসলে।
ক্যেটে যে এখন কথাটাতে বেশ জোর দিয়েছে সেটা আমায় এড়িয়ে যায়নি। তাই শুধালুম, অটো এখন বলে, কিন্তু আগে কি অন্য কথা বলত?
সেই তখন আর এখনের কথাই তো হচ্ছে। সেটাই প্রায় শেষ কথা। একটু সবুর কর। না, তাড়াতাড়ি শেষ করে দেব?
আমি বললুম, দোহাই তোমার, সেটি কোরো না। পরের দিন সকালবেলা কী হল, তাই বল।
এক ঘণ্টা আগে থেকে তৈরি অথচ বেরুবার সময় যতই এগিয়ে আসতে লাগল, আমার পা যেন আর নড়তে চায় না। এদিকে বোন খুশি হয়েছিল, আজ আমার সঙ্গ পাবে বলে। সে বার বার বলে, চল, চল আর আমি তখন বুঝতে পেরেছি, কী ভুলটাই না করেছি। বোন সঙ্গে থাকবে– ওদিকে অটোকে একা পেলেই ভালো হত না? অত সাত তাড়াতাড়ি তৈরি না হলে বোন বেরিয়ে গেলে অটোতে-আমাতে, শুধু আমরা দু জনাতে একসঙ্গে যেতে পারতুম। অবশ্য এমনটাও আগে হয়েছে যে আমার দেরি দেখে বোন বেরিয়ে গিয়েছে, এবং তার পর আরও দেরি হওয়াতে অটোও আমার জন্য অপেক্ষা করেনি। কিন্তু তখন তো আমি অটোর জন্য হোড়াই পরোয়া করতুম!
শেষটায় বোনের সঙ্গেই বেরুতে হল। ঘরে বসে থাকবার তো আর কোনও অছিলা নেই। ওদিকে আবার ভয়, বেশি দেরি দেখে অটো যদি একা চলে যায়।
দূর থেকে দেখি, অটো রাস্তায় দাঁড়িয়ে।
এবং আশ্চর্য! পরেছে রবিবারে গির্জে যাবার তার বু সার্জের পোশাকি স্যুট! এতই অস্বাভাবিক যে, বোন পর্যন্ত উঁচিয়ে শুধোল, এ কী অটো, রোববারের স্যুট কেন?
অটোর রোববারের স্যুট পরা নিয়ে সেদিন কী হাসাহাসি। অটোটাও আকাট। কাউকে বলে ইস্কুল ছুটির সঙ্গে সঙ্গে সোজা মামাবাড়ি যাবে, কাউকে বলে পাদ্রিসায়েবের কাছে যাবে। আরে বাপু, যা বলবি একবার ভেবে-চিন্তে বলে নে না।
আমি কিন্তু হাসিনি। অটো রাজবেশে সেজেছিল, তার রাজরানির সঙ্গে দেখা করার জন্যে আর আমি রাজরানি সেজেছিলুম, আমার রাজার সঙ্গে দেখা হবে বলে।
আমি বললুম, কেটে, এটা ভারি সুন্দর বলেছ।
ক্যেটে বললে, শীতকালে যখন দিনের পর দিন অনবরত বরফ পড়ে, রাইনেও জাহাজ আঁধা-বোটের চলাচল কমে যায়, খদ্দের প্রায় থাকেই না, তখন ঘণ্টার পর ঘন্টা দিনের পর দিন কাটে পাবের কাউন্টারের পিছনে বসে বসে। তখন মন যে কত আকাশ-পাতাল হাতড়ায়, কত অসম্ভব অসম্ভব স্বপ্ন দেখে, অটোকে বলার জন্য সুন্দর সুন্দর নতুন নতুন তুলনা ছলনা খোঁজে, সেটা বলতে গেলে দশ মিনিটের ভিতরই শেষ হয়ে যাবে, অথচ আমি ভেবেছি, দুই-আড়াই-তিন বছর ধরে।
আমি বললুম,
কেটেছে একেলা বিরহের বেলা
আকাশ কুসুম চয়নে
সব পথে এসে মিলে গেল শেষে
তোমার দু খানি নয়নে –
ক্যেটে পড়াশোনায় বোধহয় এককালে ভালোই ছিল, অন্তত লিরিকে যে তার স্পর্শকাতরতা আছে সে-বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। আর এ জিনিসটা তো লেখাপড়া শেখার ওপর খুব একটা নির্ভর করে না। রাগ-রাগিণী-বোধ, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে সাড়া দেওয়া এসব তো ইস্কুল শিখিয়ে দিতে পারে না, যার গোড়ার থেকে কিছু আছে তারই খানিকটে মেজেঘষে দিতে পারে মাত্র।
সবচেয়ে তার ভালো লাগল ওই আকাশ-কুসুম-চয়ন ব্যাপারটা।
আমি বললুম, জানো ওই সমাসটা আমার মাতৃভাষায় এমনই চালু যে ওটা দিয়ে নতুন করে রসসৃষ্টি করা যায়। এরকম আকাশ-কুসুম-চয়ন মহৎ কবিই করতে পারেন এই যেরকম সকলের কাছে সাদামাটা অটো হঠাৎ একদিন তোমার কাছে নবরূপে এসে ধরা দিল।
তার পর?
ইস্কুল ছাড়ি আমরা দু জনাতে একসঙ্গেই। আমি পাবে ঢুকলুম। অটো রেমাগেনে এপ্রেন্টিসিতে।