আমি করুণ কণ্ঠে বললুম, আর কত খাবে?
বিরক্তির সুরে বললে, তুমিও ওর সঙ্গে ভিড়লে নাকি?
আমি বললুম, না, বাপু, আমি আর কিছু বলব না। একদিন, না হয় দু দিনের চিড়িয়া, আমার কোথায়-বা সুযোগ, কীই-বা শক্তি। কিন্তু এবারে তুমি ওর সঙ্গে ভিড়লে নাকি? বললে। সেই ও-টি কে?
অটো। যাকে ভালোবাসি, না বাসিনে বুঝতে পারছিনে, তাই বলেছিলুম, সে আছে কি নেই জানিনে।
আমি বললুম, তুমি বড় হেঁয়ালিতে হেঁয়ালিতে কথা বল।
আদপেই না। আসলে তুমি বিদেশি বলে আমাদের আচার-ব্যবহার সামাজিকতা লৌকিকতা জানো না। তাই তোমার অনেক জিনিস বুঝতে অসুবিধে হয়, যেগুলো আমাদের দশ বছরের বাচ্চার কাছেও জলের মতো তরল। যেমন তুমি হয়তো মনে করছ আমি বার-এর পিছনে দাঁড়িয়ে বিয়ার বিক্রি করি বলে আমি বার-মেড়। এবং বারমেডরা যে সচরাচর খদ্দেরকে একাধিক প্রকারে তুষ্ট করতে চায়– প্রধানত অর্থের বিনিময়ে সেটাও কিছু গোপন কথা নয়। বিশেষত শহরে। গ্রামে ঠিক ততখানি নয়। আমি যদি এখানে কাজের সাহায্যের জন্য ঠিকে নি, তবে সে আমাদের চেনা-শোনারই ভিতরে বলে ততখানি বে-এক্তেয়ার হতে সাহস পাবে না। আর আমি, আমার মা-বোন, দাদামশাই আমরা পাব-এর মালিক। আমরা যদি মুদি, দরজি বা গারাজের মালিক হতুম তা হলে আমাদের সমাজ আমার কাছ থেকে যতখানি সংযম আশা করত এখনও তাই করে। অবশ্য বাড়িতে ব্যাটাছেলে থাকলে সে-ই বার-এর কাজ করত, ভিড়ের সময় মা-বোনেরা একটু-আধটু সাহায্য করত। মুদি কিংবা কসাইকে যেমন তার বউ-বেটি সাহায্য করে থাকে। তার পর হঠাৎ এক ঝলক হেসে নিয়ে বললে, তুমি ভাবছ, আমি মব, না? জাতের দেমাক করছি। আমি বার-মেডের মতো ফ্যালনা নই –রীতিমতো খানদানি মনিষ্যি, না?
.
১৬.
আমি চুপ। যে-মেয়ে মাতাল সেলারদের সামলায় আমি তার সঙ্গে পারব কেন?
ক্যেটে বললে, তবে শোন–
আচ্ছা বল তো, তোমার কখনও এমনধারা হয়েছে, যে-জিনিস দেখে দেখে সম্পূর্ণ অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলে সে হঠাৎ একদিন দেখা দিল অপরূপ নবরূপ নিয়ে? এই যে দিক্ধেড়েঙ্গে অটো-টা, চুল ছাঁটা যেমন পিনকুশনের মাথাটা, হাত দু খানা যেমন বেঢপ বেঁটে থাকগে, বর্ণনা দিয়ে কী হবে– একে দেখে আসছি যবে থেকে জ্ঞান হয়েছে, ইস্কুল গিয়েছি ফিরেছি একসঙ্গে, কখনও মনে হয়নি পাড়ার আর পাঁচটা বাঁদর আর এ বাঁদরে কোনও তফাত আছে, অথচ হঠাৎ একদিন তার দিকে তাকিয়ে আমার মনে হল, এ কাকে দেখছি? সে সুন্দর কি না, কুশ্রী কি না, কিছুই মনে হল না, শুধু মনটা যেন মধুতে ভরে উঠল আর মনে হল, এ আমার অটো, একে আরও আমার করতে হবে।
তুমি বিশ্বাস করবে না, ঠিক সেই মুহূর্তেই সে-ও আমার দিকে এমনভাবে তাকাল যে আমি নিঃসন্দেহে বুঝতে পারলুম, সে-ও ঠিক ওই কথাটিই ভেবেছে।
আর এমন এক নতুনভাবে তাকাল যে আমার লজ্জা পেল। আমার মনে হল, পুলওভারটার উপর কোটটা থাকলে ভালো হত।
আচ্ছা, বল তো, এ কি একটা রহস্য নয়! যেমন মনে কর, তুমি আমার একখানা বই দেখে মুগ্ধ হয়ে বললে, চমৎকার বই! আমি কি তখন তোমাকে সেটি এগিয়ে দেব না, যাতে করে তুমি আরও ভালো করে দেখতে পার?
চুপ করে উত্তরের প্রতীক্ষা করছে বলে বললুম, আমি কী করে বলব? আমি তো ব্যাটাছেলে।
বললে, অন্য দিন ইস্কুল থেকে ফিরে বাড়ির কাজে লেগে যাই, আজ বার বার মনে হতে লাগল, যাই একবার অটোকে দেখে আসি। যাওয়া অত্যন্ত সোজা। কোনও অছিলারও প্রয়োজন নেই। তার দু দিন আগেই তো এক বিকেলের ভিতর মা আমায় অটোদের বাড়ি পাঠিয়েছে তিন-তিনবার– এটা আনতে, সেটা দিতে। তাছাড়া ইস্কুলের লেখাপড়া নিয়ে যাওয়া-আসা তো আছেই। কিন্তু তবু কেন, জানো, যেতে পারলুম না। প্রতিবারে বাড়িয়েই লজ্জা পেল। খুব ভালো করেই জানি, মা কিছু জিগ্যেস করবে না, তবু মনে হল, মা বুঝি শুধোবে, এই! কোথা যাচ্ছিস? আর জিগ্যেস করলেই-বা কী? কতবার বেরুবার সময় নিজের থেকেই তো বলেছি, মা, আমি ঝপ করে এই অটোদের বাড়ি একটুখানি হয়ে আসছি। মা হয়তো শুনতেই পেত না।
তবু যেতে পারলুম না। আর সর্বক্ষণ মনে হল, মা যেন কেমন এক অদ্ভুত নতুন ধরনে আমার দিকে তাকাচ্ছে।
অন্য দিন বালিশে মাথা দিতে না দিতে আমার ঘুম ঘোর। আজ প্রহরের পর প্রহর গির্জে-ঘড়ির ঘণ্টা শুনে যেতে লাগলুম রাত বারোটা পর্যন্ত। আর মনে হল সুস্থ মানুষ বিদ্রিদের কথা চিন্তা করে ঘড়ির ঘণ্টা বানায়নি! সন্ধ্যাটা ছটা ঘণ্টা দিয়ে শুরু না করে যদি একটা ঘণ্টা দিয়ে শুরু করত তবে রাত বারোটায় তাকে শুনতে হত মাত্র ছটা ঘণ্টা। এখন পৃথিবীতে যা ব্যবস্থা তাতে যাদের চোখে ঘুম নেই তাদের সেই ঠ্যাং-ঠ্যাং করে বারোটার ঘন্টা না শোনা অবধি নিষ্কৃতি নেই।
তার পর আরম্ভ হল জোর ঝড়-বৃষ্টি। ঝড়ের শো-শোঁ আওয়াজ আর খড়খড়ি জানালার ঝড়ঝড়ানি আমার শুয়ে শুয়ে শুনতে বড় ভালো লাগে, কিন্তু আজ হল ভয়, কাল যদি এরকম ঝড় থাকে তবে মা তো আমাকে ইস্কুল যেতে দেবে না। অটোকে দেখতে পাব না। পরখ করে নিতে পারব না, সে আবার তার পুরনো চেহারায় ফিরে গিয়েছে, না আজ যে-রকম দেখতে পেলুম সেইরকমই আছে।
সব মনে আছে, সব মনে আছে, প্রত্যেকটি কথা আমার মনে আছে।
ক্যেটে বোধহয় আমার মুখে কোনও অবিশ্বাসের চিহ্ন দেখতে পেয়েছিল তাই এ-কথা বলল। আমি ভাবছিলুম, বেশি বিয়ার খেলে মানুষের স্মৃতিশক্তি তো দুর্বল হয়ে যায়, এর বেলা উল্টোটা হল কী করে? হবেও-বা! পায়ে কাঁটা ফুটলে বড় লাগে, কিন্তু পাকা ফোঁড়াতে সেই কাঁটা ফুটিয়ে দিয়েই তো মানুষ আরাম পায়। বললুম, তুমি বলে যাও। প্রেম বড় অদ্ভুত জিনিস।