হঠাৎ চেয়ারটা কাছে টেনে এনে আমার দিকে ঝুঁকে বললে, তুমি ভাবছ, আমি আমার হৃদয়টাকে জামার আস্তিনে বয়ে বয়ে বেড়াই না? আর যে কেউ একজনকে পেলেই তার কাঁধে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে তার কোটের পিছন দিকটা ভিজিয়ে দিই– না?
আমি অনিচ্ছায় বললুম, আর বললেই-বা কী? আমরা প্রায় একয়েসী, তায় আমি বিদেশি, কাল চলে যাব আপন পথে–
কী বললে? কাল চলে যাবে? কী করে যাবে শুনি? আমি কি লক্ষ করিনি যে তোমার জ্বর চড়ছে? এখন তোমাকে শুতে দেওয়াই আমার উচিত। কিন্তু তাতে কোনও লাভ নেই। জ্বর তার চরমে না ওঠা পর্যন্ত এখন তুমি শুধু এপাশ-ওপাশ করবে, আর মাথা বনবন করে ঘুরবে। তাই কথাবার্তাই বলি। জ্বরের পর অবসাদ যখন আসবে তখন উঠব।
আমি এতক্ষণ একটা সুযোগ খুঁজছিলুম আমার এখানে থাকা-খাওয়ার দক্ষিণার কথাটা তুলতে। মোকা পেয়ে বললুম, দেখো লাইন কেটে
ফ্রলাইন বলতে হবে না।
আমি বললুম, সুন্দরী কেটে, কাটেরিয়া, অর্থাৎ ক্যারিন, আমি বেরিয়েছি হাইকিঙে। তুমি আমার কাছ থেকে যত কমই নাও না কেন ইন, হোটেল ক্লাইপেতে থাকবার মতো রেস্ত আমার পকেটে নেই। কালই আমাকে যেতে হবে।
ক্যেটে আপন মনে একটু হাসলে। তার পর বললে, তুমি বিদেশি, তদুপরি গ্রামাঞ্চলে কখনও বেরোওনি। না হলে বুঝতে এটা হোটেল নয়, এখানে রাত্রিবাসের কোনও ব্যবস্থা নেই। এ ঘরটা আমাদের আপন আত্মীয়-স্বজনের জন্য গেস্টরুম, এরকম আরও দু তিনটে আছে। প্রায় সংবৎসরই ফাঁকা পড়ে থাকে। কিন্তু সেটা আসল কথা নয়। আসল কথা হচ্ছে, তুমি ভাবছ আমরা পাব চালাই বলে আমাদের আর কোনও লৌকিকতা, সামাজিকতা নেই– দয়া-মায়া, দোস্তি-মহব্বতের কথা না হয় বাদই দিলুম। ভালোই হল। এবার থেকে যখন আমার গড়-ফাদার ও ঘরটায় শোবে, সকালবেলা ব্রেকফাস্টের সঙ্গে তাকে একটা বিল দেব?
আমি আর ঘাঁটালুম না। আমি অপরিচিত, অনাত্মীয় এসব কথা রাত তিনটের সময় সুন্দরী তরুণীর সামনে তা-ও নির্জন ঘরে তুলে কোনও লাভ নেই। আমার শুধু আবছা-আবছা মনে পড়ল, আফ্রিকা না কোথায়, মার্কো পোলো গাছতলায় বসে ভিজছেন আর একটি নিগ্রো তরুণী গম না ভুট্টা কী যেন পিষতে পিষতে মাকে গান গেয়ে গেয়ে বলছে, মা, ওই বিদেশিকে বাড়ি ডেকে এনে আশ্রয় দি। সত্যেন দত্ত গানটির অনুবাদ করেছেন। এবং এ-কথাটাও এ-প্রসঙ্গে মনে রাখা উচিত, খাস নিগ্রোরা সাদা চামড়ার লোককে বড় তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে দেখে আমাদের মতো সাদা-পাগলা নয়।
নিগ্রো তরুণীর মায়ের কথায় আমাদের কথা মোড় ঘোরাবার সুযোগ পেলুম। বললুম, হোটেল যদি না হয়, তবে এরকম অপরিচিতকে ঘরে আনাতে তোমার মা কী ভাববে?
পাছে বাড়ির লোক ডিস্টার্বড় হয় তাই রুমাল দিয়ে মুখ চেপে কেটে তার খলখলানি হাসি থামাবার চেষ্টা করলে, কিন্তু হাসি আর থামতেই চায় না। আমি বেকুবের মতো তাকিয়ে রইলুম।
অনেকক্ষণ পরে গুমরানো হাসি চেপে-ছেড়ে বললে, তোমার মতো সরল লোক আমি সত্যই কখনও দেখিনি। তোমার কল্পনাশক্তিও একেবারেই নেই। আচ্ছা ভাবো তো, রাত বারোটার সময় তিনটে আধা-মাতাল মাল্লা যদি আমার পাবে ঢুকে বিয়ার চায়, তখন কি
আমি তাদের তাড়িয়ে দিই? সেলার মানে বাপের সুপুতুর নয়। আমি দেখতে মন্দ না। পাবও নির্জন। ওরা বারে দাঁড়িয়ে গাল-গল্প এমনকি ফষ্টি-নষ্টির কথা বলবেই বলবে। তখন কি মা এসে আমার চরিত্র রক্ষা করে?
আমি আমতা আমতা করে বললুম, তা বটে, তা বটেই তো। কিন্তু বল তো, ওরা যদি বিয়ার খেয়ে পয়সা না দিয়ে চলে যেতে চায় তখন তুমি কী করো?
হেসে বললে, দেখবে? তার পর উঠে গিয়ে ঘরের দরজা একটুখানি ফাঁক করে আস্তে আস্তে মাত্র একবার শিস দিলে। অমনি কাঠের সিঁড়িতে কিসের যেন শব্দ শুনতে পেলুম। আর সঙ্গে সঙ্গে দরজা ধাক্কা দিয়ে ঘরে ঢুকল ভীষণদর্শন বিকটের চেয়েও বিকট ইয়া বিশাল এক আলসেশিয়ান। আমার দিকে যেভাবে তাকালে তাতে আমি লাফ দিয়ে জুতোসুদ্ধ উঠে দাঁড়াই খাটের উপর। ভয়ে আমার মুখ দিয়ে কথা ফুটছে না যে বলব, ওকে দয়া করে বের কর। ক্যেটের তবু দয়া হল। কুকুরটাকে আদর করতে করতে বললে, না, ব্রুনো, ইনি আমাদের আত্মীয়। বুঝলি? এবার আরও বিপদ। ব্রুনো ন্যাজ নাড়তে নাড়তে আমার দিকে এগিয়ে আসছেন আমার প্যারে নেবার জন্য। আমি হাত জোড় করে বললুম, রক্ষে কর, নিষ্কৃতি দাও।
ক্যেটে বললে, কিচ্ছু না। শুধু ব্রুনোকে বলতে হয়, ওই তিনটে লোককে ঠেকা তো। ব্যস! সে তখন দরজায় দাঁড়িয়ে তিনটে বেহেড সেলারকে ঠেকাতে পারে। অবশ্য এরকম ঘটনা অতিশয় কালে-কম্মিনে ঘটে। বাপের সুপুতুররা তখন সুড়সুড় করে পয়সা দিয়ে পালাবার পথ পায় না। অবশ্য রাইন নদীর প্রায় সব সেলারই পুরুষানুক্রমে এ পাব চেনে। নিতান্ত ডাচম্যান কিংবা ওই ধরনের বিদেশি হলে পরে আলাদা কথা– তা-ও তখন ‘পাবে’ অন্য খদ্দের থাকলে কেউ ওসব করতে যায় না।
তার পর বললে, তুমি এখন একটু ঘুমাবার চেষ্টা কর। আমি তোমাকে একটা নাইট-শার্ট দিচ্ছি। ঘরের আলমারিতেই ছিল। বললে, আমি এখনি আসছি। আমি আর লৌকিকতা না করে কোট-পাতলুন ছেড়ে সেই শেমিজ-পারা নাইট শার্ট পরে লেপের ভিতর গা-ঢাকা দিলুম।
হে মা মেরি! এ কী? কেটে আরেক জাগ বিয়ার নিয়ে এসেছে!