বিরক্তির সুরে বললে, থাক, ওসব কথা। তুমি আর পাঁচজনের সঙ্গে গলা মিলিয়ে ওই একই জিগির তুলো না। সমস্ত দিনে ভূতের মতো খাঁটি, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে! ওই বিয়ারই আমাকে দাঁড় করিয়ে রেখেছে। না হলে হুমড়ি খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে যেতুম।
আমি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললুম, কিন্তু এর তো একটা সরল সমাধানও আছে। তোমাদের পাবে বিস্তর আমদানি, তুমি দেখতে ভালো, বিয়ে করে একটা ভালো লোক এনে তাকে কাজে ঢুকিয়ে দাও না? তোমাদের দেশে তো শুনেছি, এ ব্যবস্থাটা অনেকেরই মনঃপূত।
ক্যেটের ওই চড়ুইপাখির খাওয়া ততক্ষণে শেষ হয়ে গিয়েছে। চেয়ারটা টেবিলের কাছ থেকে সরিয়ে নিয়ে, আরেকখানা চেয়ারের উপরে দু পা লম্বা করে দিয়ে ভস্ভস করে। সিগারেট টানছিল। হেসে বললে, সে এক্সপেরিমেন্ট হয়ে গিয়েছে।
আমি অবাক হয়ে শুধালাম, এই অল্প বয়সে তোমার আবার বিয়ে হল কী করে?
দূর, পাগলা। আমি না। মা করেছিল এক্সপেরিমেন্টটা। সে তার বাপের একমাত্র মেয়ে। তাই বাবাকে বিয়ে করে এনে সঁপে দিয়েছিল পাবটা তার হাতে।
আমি শুধালাম, তার পর?
চিন্তা করে বললে, সমস্তটা বলা একটু শক্ত। শুনেছি, বাবা কাজ-কারবার ভালোই করত। এ ঘরের মতো আর সব ঘরেও যেসব ভালো আসবাবপত্র আছে সেগুলো ওই সময়েই। কেনা– বাবা লোকটি শৌখিন। তার পর আমার আর আমার ছোট বোনের জন্ম হল। তার পর বাবার বয়েস যখন চল্লিশ– বাবা-মার একই বয়েস তখন সে মজে গেল এক চিংড়ি মেয়ের প্রেমে, বয়েস এই উনিশ, বিশ। তার পর কী হয়েছিল জানিনে, আমি কিছু কিছু দেখেছি, তবে তখনও বোঝবার মতো জ্ঞান-গম্যি হয়নি। শেষটায় একদিন নাকি হঠাৎ মা নিচে এসে বারের পিছনে দাঁড়াল, পাবের হিসেব-পত্র নিজেই দেখতে আরম্ভ করল। তখন বাবা নাকি বাড়ি ছেড়ে চলে গেল।
আমি শুধালাম, ডিভোর্স হয়েছিল?
বললে, না। মা চায়নি, বাবাও চায়নি। কেন চায়নি, জানিনে।
আমি শুধালুম, তার পর কী হল?
ক্যেটে বললে, ঠিক ঠিক জানিনে। তবে শুনেছি, বাবাতে আর ওই মেয়েতে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। কার নেশা আগে কেটেছিল বলতে পারব না। তার পর হয়তো বাবা-মাতে ফের বনিবনা হতে পারত, কিন্তু হয়নি। বোধহয় মা-ই চায়নি, অবশ্য আমি সঠিক বলতে পারব না, কারণ মা আমার নিদারুণ আত্মাভিমানিনী– এসব যা বললুম, এর কিছুটা আমার চোখে দেখা, আর কিছুটা পাঁচজনের কাছ থেকে শোনা– মা একদিনের তরে একটি কথাও বলেনি।
আমি শুধালুম, তোমার বাবা
বললে, বুঝেছি। মাইল তিনেক দূরে ওই বস্ ডর্ষে থাকে। অবস্থা ভালো নয়, মন্দও নয়। আমার সঙ্গে মাসে ছ মাসে রাস্তায় দেখা হলে, হ্যাট তুলে আগের থেকেই নমস্কার করে– যেন আমি তার পরিচিতা কতই না সম্মানিতা মহিলা– কাছে এসে কুশলাদিও শুধোয়। বাবার আদব-কায়দা টিপট। মায়ের সঙ্গে দেখা হলেও তাই। একবার আমি মায়ের সঙ্গে ছিলুম। রাস্তায় দাঁড়িয়ে দু জনাতে কথাবার্তাও হল, তার পর যে যার পথ ধরল। এক মগ পুরো বিয়ার শূন্য করে বললে, তোমার বোধহয় ঘুম পেয়েছে?
আমি তাড়াতাড়ি বাধা দিয়ে বললুম, না না, মোটেই না।
আসলে আমার তখন জ্বর-জ্বর ভাব আরম্ভ হয়ে গিয়েছে আর সে সময় সব রক্ত মাথায় উঠে গিয়ে ঘুম দেয় চটিয়ে।
ক্যেটে উঠে বললে, জল ধরেছে। এবারে জানালাটা খুলে দি। দেখবে বৃষ্টিশেষের কী অদ্ভুত সুন্দর ভেজা পাইন-বনের গন্ধ আসছে।
আমি বললুম, এই বিয়ার আর সিগারেটের গন্ধে তোমার তো নাক-মুখ ভরতি, এর ভিতরও সেই অতি সামান্য পাইনের খুশবাই পাও? কেটে জানালা খুলে দিয়ে, দুই কনুই কাঠের উপর রেখে নিঃশব্দে বাইরের দিকে তাকিয়ে রইল। আমি নিবিষ্ট দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইলুম, যেন আমাদের দেশের কোনও সুন্দরী নারীমূর্তি পিছন থেকে দেখছি। আমাদের দেশের নারীমূর্তি ইচ্ছে করেই বললুম, কারণ ইয়োরোপীয় ভাস্কররা তাদের নারীমূর্তির পিছনের দিকটা বড় অযত্নে খোদাই করে। নিতম্বিনীর ইংরেজি প্রতিশব্দ নেই।
ফিরে এসে বললে, কিছু মনে করো না, তোমাকে জাগিয়ে রাখছি বলে। তা আমি কী করব, বল। কাজ শেষ করে খেতে খেতে দেড়টা বেজে যায় তখন আমি কার সঙ্গে সোসাইটি করতে যাব? আমার সঙ্গে রসালাপ করার জন্য কেই-বা তখন জেগে বসে?
আমি বললুম, সেরকম প্রাণের সখা থাকলে সমস্ত রাত জানালার নিচে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে প্রহর গোনে। পড়োনি বাইবেল, তরুণী শোক করছে, তার দয়িত সমস্ত রাত হিমে দাঁড়িয়ে মাথার চুল ভিজিয়ে ফেলেছে বলে। অতখানি না থোক; একটা সাদামাটা ইয়াংম্যানই যোগাড় কর না কেন?
বুকের কালো জামায় সিগারেটের ছাই পড়েছিল। সেইটে ঠোকা দিয়ে সরাতে সরাতে বললে, আমার আছে। না, না, দাঁড়াও, ছিল। কী জানি, ছিল না আছে, কী করে বলব।
আমি অবাক হয়ে শুধালুম, সে কী? এ আবার কীরকম কথা?
বললে, প্রথম যেদিন তাকে ভালোবেসেছিলুম সেদিনকার কথার স্মরণে আজও আমার মনপ্রাণ গভীর শান্তিতে ভরে যায়। আজও যদি তাই থাকত তবে এতক্ষণে ছুটে যেতুম না তার বাড়িতে তাকে ধরে নিয়ে এসে তোমার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিতে? এই রাত তিনটেয়ও।
.
১৫.
ছেলেবেলায় শরচ্চাটুজ্যের আত্মজীবনীমূলক প্রমণ-কাহিনীতে পড়েছিলুম, একদা গভীর রাতে হৃদয়-তাপের ভাপে ভরা একখানা চিঠি লিখে সেই গভীর রাতেই সেখানা পোস্ট করতে যান, কারণ মনে মনে বিলক্ষণ জানতেন, ভোরে আলো ফুটে ওঠার পর সাদা চোখে তিনিও চিঠি ডাকে ফেলতে পারবেন না। শরচ্চাটুজ্যে কোনও প্রকারের নেশা না করে শুধু নিশীথের ভূতে পেয়েই বে-এক্তেয়ার হয়েছিলেন, আর এস্থলে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি এতক্ষণে বিয়ার এ-মেয়ের মাথায় বেশ কিছুটা চেপেছে– কাজের জিম্মাদারিতে মগ্ন সচেতন মন ওটাকে ক্যাশ না মেলানো অবধি আমল দেয়নি এবং জ্বরের তাড়সানিতে আমিও সম্পূর্ণ স্বাভাবিক নই; এবং মেয়েটি কী বলতে যে কী বলে ফেলবে আর পরে নিজের কাছে নিজেই লজ্জিত হবে সেই ভেবে আমি একটু শঙ্কিত হলুম।