আমি রক্তের গন্ধ পেয়ে বললুম, সুন্দরী ক্যেটে, তুমি যে বললে, যারা তোমার সঙ্গে প্রেম করতে গিয়ে খানিকটে হতাশ হয়েছে– এ কথাটার প্রকৃত অর্থ আমাকে প্রাঞ্জল ভাষায় বুঝিয়ে বলবে কি?
ক্যেটে বললে, সুন্দরী! বেশ বলেছ চাঁদ! কিন্তু সেকথা থাক। রাত একটা বেজেছে! পোলিৎসাই স্টুন্ডে পুলিশ-আওয়ার্স– অর্থাৎ পাব বন্ধ করতে হবে। এই ঝড়-বৃষ্টিতে এখন তুমি যাবে কোথায়? উপরে চল
আমি বাঙলা দেশের ছেলে। অন্য কারণে যা হোক তা হোক, কিন্তু বৃষ্টির ভয়ে আমি কারও বাড়িতে করুণার অতিথি হব–সেটা আমার জাত্যাভিমানে জব্বর লাগে। অবশ্য এই পোড়ার দেশে বারান্দা, রক, ভিলিকিনি (ব্যালকনি) নেই বলে শুকনো নদীর পোলের তলা ছাড়া অন্য কোথাও বৃষ্টির সময় গা বাঁচানো যায় না। বললুম, দেখো ফ্রলাইন কেটে
ক্যেটের অল্প নেশা হয়েছে কি না জানিনে শুনেছি, অল্প নেশাতে নাকি মানুষের সাহস বেড়ে যায় কিংবা সে টেরমের-গিন্নীর মতো তথাকথিত খাণ্ডারিনী কিংবা সত্যই প্রেমদায়িনী জানিনে। আমার দিকে কটকট করে তাকিয়ে বললে, চুপ!
তার পর উঠে গিয়ে সব কটা জানালার কাঠের রেলিঙে পর্দা নামালে এতক্ষণ শুধু শার্সিগুলো বন্ধ ছিল মেন দরজা আর সেই লিফটপানা খাঁচার ডবল তালার ডবল চাবি ঘোরালে, বারের পিছনে গিয়ে দু মিনিটে ক্যাশ মেলালে, সুইচ বোর্ডের কাছে গিয়ে পটপট করে সে ঘরের চোদ্দটা আলো নেভালে, উপরে যাবার আলো জ্বালিয়ে দিয়ে আমাকে বললে, চল।
উপরে গিয়ে একটা কামরার দরজা খুলে আলো জ্বালালে। সত্যি সুন্দর ঘর। চমৎকার আসবাবপত্র। এক কোণে বাহারে কটেজ পিয়ানো। দেয়ালে নানা দেশের তীর-ধনুক ঝোলানো। একপ্রান্ত অতি সূক্ষ্ম ডাচ লেসের কাজওলা বেড-কভার দিয়ে ঢাকা বিরাট রাজসিক কালো আবলুশ কাঠের পালঙ্ক।
বললে, বস। আমি এখন দুটো গিলব। এই ঘরেই নিয়ে আসছি। রোজ রাত্রে আমাকে একা খেতে হয়, বড় কষ্ট লাগে। তোমার খাওয়া হয়ে গিয়েছে নিশ্চয়ই। তবে দাঁড়াও, এই সিগারেটটা খাও। বলে সেন্টার টেবিলের উপর থেকে একটি সিগারেট নিয়ে ধরালে। আমার হাতে দিয়ে বললে, খাও। এ রমণী সম্পূর্ণ লৌকিকতা-বর্জিতা।
দশ মিনিট পরে এল বিরাট এক ট্রে হাতে করে। তাতে দু প্লেট সুপ, দু প্লেট সার্ডিন সসিজ-অলিভ, গুচ্ছের রুটি-মাখন। টেবিলে সাজিয়ে, দু খানা চেয়ার মুখোমুখি বসিয়ে বললে, আরম্ভ করো। আমি মারিয়ানার ঠাকুরমার মতো আদেশ করলুম, কেটে, ফাঙে মাল আন– আরম্ভ কর অর্থাৎ প্রার্থনা কর। ক্যেটের হাত থেকে ঠং করে চামচ-কাটা পড়ে গেল। ফ্যাল ফ্যাল করে আমার দিকে তাকালে।
শ্ৰীমতী ক্যেটেকে লজ্জা দেবার জন্য যে আমি উপাসনার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলুম তা নয়, আসলে আমি এ বাবদে চার্লস ল্যামের শিষ্য। তিনি বলেছেন, খাবার পূর্বের এই প্রার্থনা কেমন যেন বেখাপ্পা। বরঞ্চ ভোর-বেলায় শান্ত মধুর পরিবেশে বেড়াতে বেরোবার পূর্বে, কিংবা চাঁদনী রাতে হেথা-হোথা চলতে চলতে আপন-ভোলা হয়ে যাওয়ার প্রাক্কালে, কিংবা বন্ধু-সমাগমের পূর্বমুহূর্তের প্রতীক্ষাকালে ভিন্ন ভিন্ন উপাসনার প্রয়োজন। শুধু তাই? মিলটন পঠন আরম্ভ করার সময় বিশেষ প্রার্থনা করা উচিত, শেক্সপিয়ারের জন্যে অন্য উপাসনা এবং ফেয়ারি কুইন পড়ার পূর্বে অন্য এক বিশেষ উপাসনার প্রয়োজন। ভোজনকর্মের চেয়ে এসব জিনিসের মূল্য আমাদের জীবনে অনেক বেশি। প্রার্থনা যদি করতে হয় তবে এগুলোর জন্য আলাদা আলাদা প্রার্থনা তৈরি করে রাখার প্রয়োজন।
ল্যামকে আমি শ্রদ্ধা করি অন্য কারণে। এই কার্যারম্ভের উপাসনা সম্বন্ধে বিবৃতি দেবার সময় তিনি এক জায়গায় বলেছেন, হায়! শাক-শবজির জগৎ থেকে আমি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছি– ওসব আর খেতে ভালো লাগে না, কিন্তু এখনও যখন এসপেরেগাস সামনে আসে তখন আমার মন মধুর আত্মচিন্তায় নিমগ্ন হয়। আপ্তবাক্য, আপ্তবাক্য, এ একটা আপ্তবাক্য!
আমার অনুরাগী পাঠকদের বলি, আমার লেখা যে আগের চেয়েও ক্রমাগত খারাপের দিকে যাচ্ছে তার প্রধান কারণ বহুকাল ধরে এসপেরেগাসের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ নেই। তাজাটার কথা হচ্ছে না, তিনি মাথায় থাকুন, টিনেরটার কথাই বলছি। সরকার আমদানি বন্ধ করে দিয়েছেন। সেঁকো বিষ না কি এখনও আসে।
খুব অল্প লোকই মুখের লাবণ্য জখম না করে চিবোনো কর্মটি করতে পারে। আমি একটি অপরূপ সুন্দর অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান মহিলাকে চিনতুম। চিবোবার সময় তাঁর দুই চোয়ালের উপরকার ছোট ছোট মাংসপেশিগুলো এমনই ছোট ছোট দড়ির মতো পাকিয়ে পাকিয়ে উঠত যে বোধ করি তিনি সেটা জানতেন, তাই যতদূর সম্ভব মাথা নিচু করে একদম প্লেটের কাছে ঝুঁকে পড়ে মাংস চিবোতেন। কোটের বেলা দেখলুম উল্টোটা। খাবার সময় তার মুখের হাসি হাসি ভাবটা যেন আরও বেড়ে গেল। অবশ্য সে খেল অল্পই। বিয়ার পান করল প্রচুর। উপরে আসবার সময় ঢাউস এক জাগ বিয়ার সঙ্গে এনেছিল।
আমি বললুম, অত বিয়ার খাও কেন? দিনের শেষে না হয় এক আধ-গেলাস খেলে। ওই বিয়ার খেয়ে খেয়ে খিদেটি তো একেবারে গেছে। আমার দেশে অনেকেই চা খেয়ে খেয়ে এরকম পিত্তি চটায়।
আশ্চর্য হয়ে শুধাল, চা খেয়ে খেয়ে! একজন মানুষ দিনে ককাপ চা খেতে পারে?
আমি বললুম, আমার দেশের লোকও ঠিক এইরকম অবাক মেনে শুধোবে, একজন মানুষ দিনে কগেলাস বিয়ার খেতে পারে।