গরম ব্র্যান্ডি টেবিলের উপর রেখে বললে, ‘ৎসুম ভোল জাইন’। এটা এরা সবসময়ই বলে থাকে। অর্থ বোধহয় অনেকটা এটা দ্বারা আপনার মঙ্গল হোক।
আমি বললুম, ধন্যবাদ। আপনি কিছু একটা নিন। বললে, আমার রয়েছে।
আমি এক চুমুক খাওযার বেশ কিছুক্ষণ পরে মেয়েটি বার-এর পিছন থেকে শুধোল, আপনি যদি নিতান্ত একা বসে না থাকতে চান তবে আমি সঙ্গ দিতে পারি। আমি খাড়া হয়ে উঠে বসে বললুম, নিশ্চয় নিশ্চয়। আস্তেজ্ঞা থোক, বোস্তেজ্ঞা হোক। মেয়েটি এসে একটি চেয়ার একটুখানি দূরে টেনে নিয়ে এক জানুর উপর আরেক জানু তুলে বসল।
কী সুন্দর সুডৌল পা দুটি!
.
১৪.
হিটলার যখন মস্কোর চৌকাঠে তখন তিনি তার খ্যাতির মধ্যগগনে। ওই সময় লাঞ্চ-ডিনার খাওয়ার পর তিনি যেসব বিশ্রম্ভালাপ করতেন সেগুলো তার সেক্রেটারি বরমানের আদেশে লিখে রাখা হয়। তারই একাধিক জায়গায় হিটলার রমণীদের সম্বন্ধে নিজের অভিজ্ঞতা ও মতামত প্রকাশ করেছেন। তাঁর মতে, আমরা শহরের রঙচঙা সুন্দরীদের দেখে এতই অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি যে, গ্রামের সুন্দরীরা আর আমাদের চোখে পড়ে না। অথচ তার মতে,সিনেমাওয়ালাদের সুন্দরীর সন্ধানে বেরোতে হলে যাওয়া উচিত গ্রামাঞ্চলে– সৌন্দর্যের খনি সেখানে।
লেখাটি পড়েছি আমি অনেক পরে, কিন্তু সেই অঝোরে ঝরার রাত্রে কেটে কির্ষনারকে দেখে আমার মনে এই তত্ত্বটির আবছা আবছা উদয় হয়েছিল। তার দেহটি তো স্বাস্থ্যে পরিপূর্ণ ছিলই, তদুপরি চোখে ছিল একটি অবর্ণনীয় শান্ত মধুর ভাব। চুল ছিল চেনাট ব্লন্ড এবং এমনি অদ্ভুত ঝিলিক মারত যে মনে হত যেন তেল ঝরে পড়ছে, যদিও জানি ইয়োরোপের মেয়েরা চুলে তেল মাখে না।
আমার টেবিলে আসার সময় সে তার অর্ধসমাপ্ত বিয়ারের গেলাস সঙ্গে এনেছিল। ঢাউস হাফ-লিটারের পুরু কাঁচের মগ। ক্যেটের চোখ দুটি ঈষৎ রক্তাভ। সেটা বিয়ার খেয়ে হয়েছে, না, চোখের জল ফেলে হয়েছে বুঝতে পারলুম না। আবার এটাও তো হতে পারে যে কেঁদে কেঁদে যখন সান্তনা পায়নি তখন শোক ভোলার জন্য বিয়ার খেয়েছে। কিন্তু আমিই-বা এত সেন্টিমেন্টাল কেন? পৃথিবীটা কি শুধু কান্নাতেই ভরা?
ইতোমধ্যে প্রাথমিক আলাপচারী হয়ে গিয়েছে।
আমি বার দুই বিয়ার-মগের দিকে তাকিয়ে বললুম, আমাদের দেশে প্রবাদ আছে ময়রা সন্দেশ খায় না।
কেটে হেসে বললে, এ-দেশেও মোটামুটি তাই। তবে আমি খাচ্ছি অন্য কারণে। তা-ও সমস্ত দিন, এবং জালা জালা।
এদেশে বিয়ার খাওয়াটা নিন্দনীয় নয় বরঞ্চ সেইটেই স্বাভাবিক কিন্তু পিপে পিপে খাওয়াটা নিন্দনীয়, আর মাতলামোটা তো রীতিমতো অভদ্র, অন্যায় আচরণ বলে স্বীকৃত হয়েছে। আমাদের দেশে যেরকম একটু-আধটু তাস খেলা লোকে মেনে নেয় কিন্তু জুয়ো খেলে সর্বস্ব উড়িয়ে দেওয়া পাপ বলে ধরা হয়।
কেটে কেন জালা জালা খায় সেটা যখন নিজের থেকে বললে না, তখন আমিও আর খোঁচাখুঁচি করলুম না। শুধালুম, আমি এখানে আসার সময় আকাশে একটা আলোর আভা দেখতে পেয়েছিলুম। সেটা কিসের?
ও, সে তো রাইন নদীর ঘাট আর জাহাজগুলো।
আমি অবাক হয়ে বললুম, আমি কি রাইনের পারে এসে পৌঁছে গিয়েছি।
হেসে বললে, যা বৃষ্টি হচ্ছে তাতে আপনি যে আপন অজানাতে পায়ে হেঁটেই রাইন পেরিয়ে ওপারে চলে যাননি সে-ই তো আশ্চর্য! আমাদের পাবৃ থেকে রাইন তো অতি কাছে। আসলে আমাদের খদ্দেরও অধিকাংশ রাইনের মাঝি-মাল্লারা। সন্ধ্যার সময় নোঙর ফেলে এখানে এসে বিয়ার খায়, নাচানাচি করে এবং মাঝে মাঝে মাতলামোও! সেলার কি না! আজ জোর বৃষ্টি নেমেছে বলে পাব একেবারে ফাঁকা। আমার আজ বড্ড ক্ষতি হল।
আপনার ক্ষতি? আমি তো ভেবেছিলুম, আপনি এখানে কাজ করেন।
ক্ষণতরে শ্রীমতীর মুখ একটু গম্ভীর হল। মুনিবকে চাকর বললে তাঁর যে ভাব পরিবর্তন হওয়ায় কথা। তার পর ফের একটু হাসলে। বোধহয় ভাবল, বিদেশি আর বুঝবেই-বা কী? বললে, না। এটা আমার পাব। অর্থাৎ মায়ের পাব। আমরা দুই বোন। ছোট বোন ইস্কুলে যায় আর পাব চালাবার মতো গায়ের জোর মার নেই। তাই আমি এই জোয়ালে বাঁধা। অবশ্য আমি কাজ করতে ভালোবাসি। কিন্তু সকাল আটটা-ন টা থেকে রাত একটা অবধি কাজ করা চাট্টিখানি কথা নয়। ছোট বোনটা ইস্কুল থেকে ফিরে এসে মাঝে মাঝে আমাকে জোর করে ঘরে নিয়ে শুইয়ে দেয়। অবশ্য একটা ঠিকে আছে। কিন্তু সে বেচারির আবার শিগগির বাচ্চা হবে।
কেটে যেভাবে সব কথা নিঃসঙ্কোচে খোলাখুলি বলে যাচ্ছিল তাতে আমি ভরসা পেয়ে হেসে বললুম, তা আপনি একটা বিয়ে করলেই পারেন, এত বড় ব্যবসা তায় আপনি সুন্দরী।
চুপ করো– হঠাৎ কেটে আপনি থেকে তুমিতে চলে এল। বললে, চুপ কর। আমি গায়ে থাকি বলে কী গাইয়া? আমি কী জানিনে ইন্ডিয়ান নর্তকীরা কী অদ্ভুত সুন্দরী হয়? বর্ণটি সুন্দর শ্যাম, মিশমিশে কুচকুচে কালো চুল, লম্বা লম্বা জোড়া চোখ, চমৎকার বাস্ট আর হিপ।
আমি গলা খাকারি দিয়ে বললুম, তুমি অত শত জানলে কোত্থেকে?
বললে, এইসব মাঝি-মাল্লারা এখানে বিয়ার খেতে আসে তাদের অনেকেই ভাটি রাইনে হল্যান্ড অবধি যায়। সেখানে সমুদ্রের জাহাজে কাজ নিয়ে কেউ কেউ তামাম দুনিয়া ঘুরে বেড়ায়। তাদেরই দু-একজন মাঝে মাঝে আমাকে ভিন্ন ভিন্ন দেশের ছবির পোস্টকার্ড পাঠায়। বিশেষ করে যারা আমার সঙ্গে প্রেম করতে গিয়ে খানিকটে হতাশ হয়েছে তারা ইন্ডিয়া, ঈজিপ্ট থেকে খুবসুরত মেয়েদের ছবি পাঠিয়ে জানাতে চায়, তুমি তো আমাকে পাত্তা দিলে না; এখন দেখ, আমি কী পেয়েছি।