ট্রাম্প মাত্রেরই এ-দুটি কিছু কিছু দরকার। তালেবর ট্রাম্পরা তো কান্টের ভাষায় বলি– মানুষের হৃদয় থেকে আরম্ভ করে আকাশের তারার গতিবিধি নখাগ-দর্পণে ধরে। তারই একজনের সঙ্গে আমার একবার সাক্ষাৎ হয়েছিল; অনুকূল লগ্নে সেসব কথা হবে।
ওয়াকিফহাল তো নই-ই, দু ব্যাপারেই আমি বে-খেয়াল। কাজেই কখন যে শান্তাকাশের আস্যদেশে কুটির কটা ফেটে উঠেছে সেটা মোটেই লক্ষ করিনি। হঠাৎ ঘোরঘুট্টি অন্ধকার হয়ে গেল– আশ্চর্য। এরকম তো হওয়ার কথা ছিল না এবং সঙ্গে সঙ্গে–
কণ্ঠের বরণ যাঁর
শ্যাম-জলধরোপম,
গৌরী-ভুজলতা যাহে
রাজে বিদ্যুল্লতা সম
নীলকণ্ঠ প্রভু সেই
করুন সবে রক্ষণ–
আমাকে রক্ষণ না করে রুদ্রের অট্টহাস্য হেসে বৃষ্টি নামলেন আমার মস্তকে মুষল ধারে। এরকম হঠাৎ, আচমকা, ঘনধারা বৃষ্টি আমি আমার আপন দেশেও কখনও দেখিনি।
তবে এটা ঠিক কালো মেঘের উপর সাদা বিদ্যুৎ খেললে কেন সেটা নীলকণ্ঠের নীল-গলার উপর গৌরীর গোরা হাতের জড়িয়ে ধরার মতো দেখায় সেটা সম্পূর্ণ হৃদয়ঙ্গম হল। বিস্তর বিদ্যুৎ চমকাল বটে।
আর সে কী অসম্ভব বিদ্যুৎ কনকনে সুচিভেদ্য ঠাণ্ডা।
এতদিনে বুঝতে পারলুম, ইউরোপীয় লেখকরা ভারত, মালয়, বর্ষার মৌসুমি বৃষ্টিতে ভিজে কেন লিখেছেন, ওয়ার্ম ট্রপিকাল রেস্। জ্যৈষ্ঠের খরদাহের পর আষাঢ়ের নবধারা নামলে আমরা শীতল হই, সে-বৃষ্টি হাড়ে কাঁপন ধরিয়ে দেয় না। তাই ইংরেজের কাছে এ বৃষ্টি ওয়োর্ম এবং আনন্দদায়ক। কারণ একে অন্যকে স্বাগত অভ্যর্থনা জানালে সায়েব বলে, আমি তার কাছ থেকে ওয়োর্ম রিসেপশন পেলুম। আর আমরা যদি বলি, আমাকে দেখেই উনি গরম হয়ে উঠলেন তবে অন্য মানে হয়।
যাক এসব আত্মচিন্তা। বাঙলা দেশে মানুষ বহুকাল ধরে তর্ক করেছে, মিষ্টি কথা দিয়ে কোনও জিনিস ভেজানো যায় কি না? কিন্তু উল্টোটা কখনও ভাবেনি–অর্থাৎ মিষ্টি কথা, এ-স্থলে আত্মচিন্তা দিয়ে সেলিকাজেলের মতো ভিজে জিনিস শুকনো করা যায় কি না? আবার এ-বৃষ্টি আসছে চতুর্দিক থেকে, নাগাড়ে এবং ধরণী অবলুপ্ত।
অবশ্য দশ মিনিট যেতে না যেতেই আমার ভিজে যাওয়া ভাবনা লোপ পেল। অল্প ভেজা থেকে মানুষ আত্মরক্ষা করার চেষ্টা করে কিন্তু ভিজে ঢোল হয়ে যাওয়ার পর তার সেই উদ্বেগ কেটে যায়। মড়ার উপর এক মণও মাটি, একশো মণও মাটি। কিংবা সেই পুরনো দোহা,
অল্প শোকে কাতর।
অধিক শোকে পাথর—
হোঁচট খেয়ে খেয়ে চলেছি। একটা গাড়ি কিংবা মানুষের সঙ্গেও দেখা হল না। গৌরী ও নীলকণ্ঠেও বোধহয় দু-লোকের পিকনিক সমাপন করে কৈলাসে ফিরে গিয়েছেন। বিদ্যুৎ আর চমকাচ্ছে না। ঘোরঘুট্টি অন্ধকার।
অনেকক্ষণ পরে আমার বাঁ দিকে দিক বলতে পারব না– অতি দূরের আকাশে একটা আলোর আভা পেলুম। প্রায় হাতড়ে হাতড়ে সামনে বাঁয়ে মোড় নিলুম। আভাটা কখনও দেখতে পাচ্ছি, কখনও না। যখন আলোটা বেশকিছু পরিষ্কার হয়েছে তখন সামনের কয়েকটা গাছের আড়াল থেকে হঠাৎ বেরিয়ে এল একটা জোরদার বাড়ির আলো! বাঁচলুম।
কই বাঁচলুম? বাড়ির সামনের সাইনবোর্ডে আলোতে আলোতে লেখা তিন সিংহ! বলে কী? ঘরে ঢুকে তিনটে সিঙির মুখোমুখি হতে হবে নাকি?
নাঃ। অতখানি জর্মন ভাষা আমি জানি। এরা এদের বার হোটেল পাব-এর বিদঘুঁটে বিদঘুঁটে নাম দেয়। তিন সিংহ, সোনালি হাঁস– আরও কত কী।
দরজা খুলেই দেখি, আমি একটা খাঁচা কিংবা লিফটের মতো বাক্সে দাঁড়িয়ে আছি। আমি আমার ভেজা জামাকাপড় নিয়ে কী করে ঢুকব সে সম্বন্ধে সচেতন ছিলুম বলে লক্ষ করলুম, পায়ের তলায় জাফরির ফুটোওলা পুরো রবারের শিট। ভয়ে ভয়ে সামনের দরজা খুলে দেখি বিরাট এক নাচের ঘর পাস বার-পাব। অথচ একটিমাত্র খদ্দের নেই। এক প্রান্তে বার। পিছনে একটি তরুণী। সাদামাটা কাপড়েই অতি সুন্দর দেখাচ্ছে। আমি মুখ ঢুকিয়ে দাঁড়িয়ে আছি দেখে বেশ একটু চেঁচিয়ে বললে, ভিতরে আসুন না? আমি আমার জামাকাপড় দেখিয়ে বললুম, আমি যে জলভরা বালটির মতো। বললে, তা হোক। তার পর আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলে, একটা জাফরির রবারের পর্দা চলে গিয়েছে ঘরের অন্য প্রান্তের বাথরুম অবধি। আমি ওইটে ধরে ধরে বেবাক ঘর না ভিজিয়ে যখন প্রায় বাথরুমের কাছে পৌঁছেছি তখন মেয়েটি কাউন্টার ঘুরে পার হয়ে আমার কাছে এসে বললে, আপনি ভিতরে ঢুকুন। আমি আপনাকে তোয়ালে আর শুকনো কাপড় এনে দিচ্ছি।
গ্রামাঞ্চলে এরা এসব আকছারই করে থাকে, না আমি বিদেশি বলে? কী জানি? শহরে এরকম ঢোল আপন বাড়ি ছাড়া অন্য কোথাও ঢুকতে কখনও দেখিনি।
শার্ট সুয়েটার, প্যান্ট আর মোজা দিয়ে গেল। অবশ্য বাহারে নয়। বাহার! :! আমি তখন গজাসুর বা ব্যাঘ্রচর্ম পরে কৃত্তিবাস হতে রাজি আছি!
চার সাইজের বড় রবারের জুতা টানতে টানতে বার-এর নিকটতম সোফায় এসে হেলান দিয়ে এলিয়ে পড়লুম। মেয়েটি শুধালে, আপনি কী খাবেন? আমি ক্লান্ত কণ্ঠে বললুম, যাচ্ছেতাই।
এবার যেন কিঞ্চিৎ দরদ-ভরা সুরে বললে, গরম ব্র্যান্ডি খান। আপনি যা ভিজেছেন তাতে অসুখ-বিসুখ করা বিচিত্র নয়। আমার কথা শুনুন। আমি সবাইকে ড্রিঙ্ক দি। জানি, কখন কী খেতে হয়।
আমি তখন ট্র্যাম্পিঙের অন্নপ্রাশনের দিনেই নিমতলাগমন ঠেকাতে ব্যস্ত। পূর্বোল্লিখিত গজাসুরের গজ-বসাও খেতে প্রস্তুত। বললুম, তাই দিন।