সেই সরল দরওয়ান কথাটির গভীর অর্থ বুঝেছিল কি না জানিনে। শুনতে পেয়ে সে বলেছিল, হা, মঁসিয়ে, তাই লিখে দিন।
ঘটনাটির ভিতর অনেকখানি বেদনা লুকনো আছে। নির্বাসিত হাইনে যতদিন পারেন তাদের কাছ থেকে লুকিয়ে রেখেছিলেন যে তিনি আর নড়া-চড়া করতে পারেন না।
পাশ্চাত্য কবিরা মায়ের উদ্দেশে বা স্মরণে বড় একটা কবিতা লেখেন না। ইহুদি হাইনের গায়ে প্রাচ্যদেশীয় রক্ত ছিল বলে তিনি ব্যত্যয়। অল্প লোকই হাইনের মতো মাকে ভালোবেসেছে। প্যারিসে থাকাকালীন মাত্র দু বার তিনি গোপনে জর্মনি যান। দুবারই মাকে দেখবার জন্য। আমার নিজের মনে সন্দেহ আছে, পুলিশ জানতে পেরেও বোধহয় সাধারণের কবি হাইনেকে ধরিয়ে দেয়নি। পুলিশ কবিতা না লিখতে পারে, কিন্তু পুলিশেরও তো মা থাকে।
মাতার উদ্দেশে লেখা হাইনের কবিতা অদ্বিতীয় বলার সাহস আমি না পেলেও বলব অতুলনীয়। এবং আশ্চর্য, কবিতাটি করুণ এবং মধুর সুরে রচা নয়। ভাষা অবশ্য অত্যন্ত সরল, কিন্তু মূল সুরে আছে দার্ট এবং দম্ভ। কাইজারের সঙ্গে প্রজা-মিত্র হাইনের ছিল কলহ- আমার মনে প্রশ্ন জাগে হাইনের সখা রজকিনী-সাধক চণ্ডীদাসকে কি মুকুটহীন কাইজার ব্রাহ্মণদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে হয়নি এবং তাই তিনি কবিতা আরম্ভ করেছেন,
উচ্চশির উচ্চে রাখা অভ্যাস আমার
আমার প্রকৃতি জেনো অতীব কঠোর
রাজারো অবজ্ঞা দৃষ্টি পারে না তো মোর
দৃষ্টি কভু নত করে। কিন্তু মাগো—
আর তার পর কী আকুলি-বিকুলি! তোমার সামনে, মা, আপনার থেকে মাথা নিচু হয়ে আসে। স্মরণে আসে, কত না অপরাধ করেছি, কত কিছু না করে তোমার পুণ্য হৃদয়কে বেদনা দিয়েছি বার বার। তার স্মৃতি আমাকে যে কী পীড়া দেয়, জানো মা?
সত্যেন দত্তের অনুবাদ তুলে দিতে ইচ্ছে করছে না, প্রত্যেক অনুতপ্ত জনের মতো আমারও মন আঁকুবাকু করে, হাইনে মাতৃমন্ত্র উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে আমিও আমার মাতৃমন্ত্র উচ্চারণ করে যাই।
কবিতাটির দ্বিতীয় ভাগে অন্য সুর।
তোমাকে ছেড়ে মা, মূর্খের মতো আমি গিয়েছি পৃথিবীর অন্য প্রান্তে ভালোবাসার সন্ধানে। দোরে দোরে ভিখিরির মতো ভালোবাসার জন্য করেছি করাঘাত। আর পেয়েছি শুধু নিদারুণ ঘৃণা। তার পর যখন ক্ষত-বিক্ষত শ্লথ চরণে বাড়ি ফিরেছি তখন দোরের সামনে তুমি মা এগিয়ে এসেছ আমার দিকে
হার মানলুম। সত্যেন দত্তের অনুবাদটিই পড়ুন।
আশ্চর্য লাগে, এই হাইনে লোকটি সরল ভাষায় কী করে রুদ্র করুণ উভয় রসই তৈরি করতে জানতেন। আর আমার সবচেয়ে ভালো লাগে তার হাসি-কান্নায় মেলানো লেখাগুলো। তারই হ্রস্ব একটি শোনাবার জন্য দীর্ঘ এই ভূমিকা। আমি নিরুপায়। হায়, আমার তো সে শক্তি নেই যার কৃপায় লেখক মহাত্মাজনকেও স্বল্পে প্রকাশ করতে পারে।
সম্রাট ম্যাকসিমিলিয়নের কাহিনী বলতে গিয়ে হাইনে অনুতাপ করছেন, যে কাহিনীটি তার ভালো করে মনে নেই- অনেককালের কথা কি-না। আপসোস করে বলছেন, এসব জিনিস মানুষ সহজেই ভুলে যায় বিশেষ করে যখন তাকে প্রতি মাসে প্রফেসরের রোকা মাইনে দেওয়া হয় না, আপন ক্লাস-লেকচারের নোটবই থেকে মাঝে-মধ্যে পড়ে নিয়ে স্মৃতিটা ঝালিয়ে নেবার জন্য।
ম্যাকসিমিলিয়ন পাষাণ প্রাচীরের কঠিন কারাগারে। তাঁর আমীর-ওমরাহ, উজির-নাজির সবাই তাকে বর্জন করেছে। কেউ সামান্যতম চেষ্টা করছে না, তার সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপন করার। কী ঘেন্নায়ই না ম্যাকসিমিলিয়ন তার গৌরবদিনের সেই পা-চাটা দলের কথা মাঝে মাঝে স্মরণ করেছিলেন।
এমন সময় সর্বাঙ্গ কম্বলে ঢেকে এসে ঢুকল কারাগারের নির্জন কক্ষে একটা লোক। কে এ? এক ঝটকায় কম্বল ছুঁড়ে ফেলে দিতেই সম্রাট দেখেন, এ যে রাজসভার ভাড়, সঙ, বিশ্বাসী কুন্স্ ফন্ ড্যার রোজেন। আশার বাণী, আত্মবিশ্বাসের মন্ত্র নিয়ে এল শেষটায় রাজসভার মূৰ্থ– সঙ কুনত্স!
ওঠো, মহারাজ, তোমার শৃখল ভাঙবার দিন এল। কারামুক্তির সময় এসেছে। নব-জীবন আরম্ভ হল। অমানিশি অতীত– ওই হেরো, বাইরে প্রথম ঊষার উদয়।
ওরে মূর্খ, ওরে আমার হাবা কুনৎস্! ভুল করেছিস রে, ভুল করেছিস। উজ্জ্বল খড়গ দেখে তুই ভেবেছিস সূর্য, আর যেটাকে তুই উষার লালিমা মনে করেছিস সে রক্ত।
না, মহারাজ, ওটা সূর্যই বটে, যদিও অসম্ভব সম্ভব হয়েছে– ওটা উদয় হচ্ছে পশ্চিমাকাশে–ছ হাজার বছর ধরে মানুষ এটাকে পুব দিকেই উঠতে দেখেছে–এখনও কি ওর সময় হয়নি যে একবার রাস্তা বদলে পশ্চিম দিকে উঠে দেখে কীরকম লাগে!
কুনৎস্ ফন্ ড্যার রোজেন, বল দেখি তো হাবা আমার, তোর টুপিতে যে ছোট ছোট ঘুঙুর বাঁধা থাকত সেগুলো গেল কোথায়?
দুঃখের কথা তোলেন কেন, মহারাজ! আপনার দুর্দিনের কথা ভেবে ভেবে মাথা নাড়াতে নাড়াতে ঘুঙুরগুলো খসে গেল; কিন্তু তাতে টুপির কোনও ক্ষতি হয়নি।
কুনৎস্ ফন্ ড্যার রোজেন, ওরে মূর্খ, বল তো রে, বাইরে ও কিসের শব্দ? আস্তে, মহারাজ। কামার কারাগারের দরজা ভাঙছে। শীঘই আপনি আবার মুক্ত স্বাধীন হবেন– সম্রাট।
আমি কি সত্যই সম্রাট? হায়, শুধু রাজসভার মূর্খের মুখেই আমি এ-কথা শুনলুম।
ওরকম করে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলবেন না প্রভু! কারাগারের বিষের হাওয়া আপনাকে নির্জীব করে ফেলেছে। আপনি যখন আবার ম্রাট হবেন তখন ধমনিতে ধমনিতে অনুভব করবেন সেই বীর রাজ-রক্ত, আপনি আবার হবেন গর্বিত সম্রাট, দম্ভী সম্রাট। আবার হবেন দাক্ষিণ্যময় এবং আবার করবেন অন্যায় অবিচার, হাসিমুখে, এবং আবার হবেন নেমকহারাম রাজাবাদশাদের যা স্বভাব।