আমি এসেছিলুম মজা করতে, বাজিয়ে দেখতে খাণ্ডার কি না, এখন কেঁচো খুঁড়তে সাপ।
ঘরের আসবাবপত্র, ছবি, বই– এসব টেমের-বউ যোগাড় করেছিল যৌতুকের টাকা জমাবার সময় কেমন যেন আমার কাছে হঠাৎ অত্যন্ত নিরানন্দ, নিঃসঙ্গ, নীরস বলে মনে হতে লাগল। এরই ভিতর একা একা দিন কাটায় এ রমণী। টেরমের লোক নিশ্চয় খারাপ নয়– যে দু-চারটে কথা বলেছিলুম, তার থেকে আমার মনে অতি দৃঢ় ওই প্রত্যয় হয়েছিল– এবং এখন আমার মনে হল, দু জনার ভিতরে ভালোবাসাও আছে যথেষ্ট, কিন্তু একজনকে ভালোবাসা দেওয়া এক জিনিস, আর সঙ্গ দেওয়া অন্য জিনিস। এ-মেয়ে শান্ত গম্ভীর। খুব সম্ভব, স্বামী বাচ্চা নিয়ে নির্জনে থাকতে চায়, আর ওদিকে টেরমের ইয়ার-দোস্তের সঙ্গে বসে পাঁচজনের পাঁচ রকমের সুখ-দুঃখের কথা না শুনলে, না বললে, তার মনে হয় তার জীবনটা যেন সর্বক্ষণ অসম্পূর্ণ রয়ে গেল।
এসব কথা বৃথা, টেরমের গিন্নি কি অন্য কিছু দিয়ে জীবন ভরে তুলতে পারে না? কেউ কেউ পারে, কিন্তু অনেকেই পারে না। এ মেয়ে যেন গ্রামোফোন রেকর্ডের কাটা লাইনের ভিতরে পড়ে গিয়েছে সাউন্ড বক্সটা– আছে ঠায় দাঁড়িয়ে, রেকর্ড ঘুরেই যাচ্ছে, ঘুরেই যাচ্ছে, সে কিন্তু আর এগুতে পারছে না। আমার অনেক সময় মনে হয়, এই একঘেয়ে নীরস জীবনের চেয়ে অনটনের জীবন, সঙ্কটের জীবন কাম্যতম। সেখানে অন্তত সেই অনটন, সেই সঙ্কটের দিকে সর্বক্ষণ মনঃসংযোগ করতে হয় বলে মনটা কিছু-না কিছু একটা নিয়ে থাকে। বেদনার শেষ আছে কিন্তু শূন্যতার তো নেই।
আমার বড় লজ্জা বোধ হল। ঠাট্টাছলে, মস্করা করতে এখানে এসেছিলুম বলে। স্থির করলুম, সব কথা খুলে বলব, নিদেন এটা বলব যে, তার স্বামীকে আমি চিনি, সে আমাকে নিমন্ত্রণ করতে চেয়েছিল।
আমি ভয়ে ভয়ে আরম্ভ করলুম, আপনার স্বামী—
আমার কথা আর শেষ করতে হল না। এই শান্ত– এমনকি, গুরুগম্ভীরও বলা যেতে পারে– মেয়ে হঠাৎ হোহো করে অট্টহাস্য হেসে উঠল। কিন্তু ভারি মধুর। বিশেষ করে ঝকঝকে সাদা দু পাটি দাঁত আর চোখ দুটি যা জ্বলজ্বল করে উঠল, সে যেন অন্ধকার রাত্রে আকাশের কোণে বিদ্যুল্লেখা। কতদিন পরে এ-রমণী এভাবে প্রাণ খুলে হাসলে, কে জানে। কত তপ্ত নিদাঘ দিনের পর নামল এ-বারিধারা। তাই হঠাৎ যেন চতুর্দিকের শুষ্কভূমি হয়ে গেল সবুজ। দেয়ালের ছবিগুলোর গুমড়ো কাঁচের মুখের উপর দিয়ে যেন খেলে গেল এক পশলা আলোর ঝলমলানি।
আমার স্বামী– বার বার হাসে আর বলে আমার স্বামী-। শেষটায় কোনও গতিকে হাসি চেপে বললে, আমার স্বামী আপনাকে পেলে হাল্লেলুইয়া রব ছেড়ে আপনাকে ধরে নাচতে আরম্ভ করত। এ-গ্রামের যে-কোনও একজনকে পেলেই তার ক্রিসমাস। আপনি কত দূর দেশের লোক। আপনাকে পেলেই এখুনি নিয়ে যেত পাবে। আবার হাসতে হাসতে বললে, আপনি বুঝি ভয় পেয়েছেন, ও যদি হঠাৎ বাড়ি ফিরে দেখে আমি একটা ট্রাম্পকে অবশ্য আপনি ট্রাম্প নন–যত্ন করে সুপ খাওয়াচ্ছি তা হলে সে চটে গিয়ে তুলকালাম কাণ্ড করবে! হোলি মেরি! যান না আপনি একবার পাবে। ও গিয়েছিল শহরে। এতক্ষণে ফিরেছে নিশ্চয়ই, এবং বাড়ি না এসে গেছে সোজা পাবে। শহরে কী কী দেখে এল তার গরমাগরম একটা রগরগে বর্ণনা তো দেওয়া চাই। যান না একবার সেখানে। নরক গুলজার। তার পর আবার হাসি। শেষটায় বললে, আমি যদি ওকে বলি যে, সে যখন শহরে কিংবা পাবে, তখন এক বিদেশি তা-ও সেই সুদূর ইন্ডিয়া থেকে, ফ্রান্স কিংবা পর্তুগাল থেকে নয়– আমাদের বাড়িতে এসেছিল তা হলে সে দুঃখে ক্ষোভে বোধহয় দেয়ালে মাথা ঠুকবে। তাই বলছি যান একবার পাবে। খরচার কথা ভাবছেন? আমার স্বামী যতক্ষণ ওখানে রয়েছে।
আমি ইচ্ছে করেই বেশ শান্ত কণ্ঠে বললুম, আমি তো শুনেছি, আপনি চান না, আপনার স্বামী বেশি লোকের সঙ্গে মেলামেশা করুক।
হঠাৎ তার মুখের হাসি শুকিয়ে গেল। আমার মনে দুঃখ হল। কিন্তু যখন মনস্থির করেছি, সবকথা বলবই তখন আর উপায় কী? গোড়ার থেকে সবকিছু বলে গেলুম, অবশ্য তাঁর স্বামীর ভাষাটাকে একটু মোলায়েম করে, এবং লড়াই-ফেরতা চাষা কী বলেছিল তার অভিমতও।
নাঃ! বিধাতা আমার প্রতি সুপ্রসন্ন। টেরমেরিনীর মুখে ফের মৃদু হাস্য দেখা দিল। তা হলে বোধহয়, একবার গাম্ভীর্যের বাঁধন ভাঙলে সেটাকে আর চট করে মেরামত করা যায় না। হাসিমুখেই বললে, সে এক দীর্ঘ কাহিনী। আপনি বরঞ্চ পাবে যান। আমি বললুম, আপনি যদি সঙ্গে চলেন, তবে যেতে রাজি আছি। স্তম্ভিত হয়ে বললে, আমি? আমি যাব পাবে? আমি বললুম, দোষটা কী? আপনার স্বামী যখন সেখানে রয়েছেন। তাড়াতাড়ি বললে, না, না। সে হয় না। তার পর আমাকে যেন খুশি করার জন্য বললে, আরেক দিন যাব।
আমি বললুম, সেই ভালো, মাদাম। ফেরার মুখে যখন এ গা দিয়ে যাব তখন তিনজনাতে একসঙ্গে যাব।
রাস্তায় নেমে শেষ কথা বললুম, ওই কথাই রইল।
.
১৩.
বিচক্ষণ লোক ঠিক জানে, এই শেষবার, এর পর দোকানি আর ধার দেবে না। হুঁশিয়ার লোক দোকানির সামান্যতম চোখের পাতার কাঁপন কিংবা তার নিশ্বাসের গতিবেগ থেকে এই তত্ত্বটি জেনে যায়, এবং তার পর আর ওপাড়া মাড়ায় না। নৈসর্গিক পরিবর্তন সম্বন্ধেও সে কিছু কম ওয়াকিফহাল নয়। মাঠ দিয়ে যেতে যেতে দিব্য আপনার সঙ্গে নিবিষ্ট মনে কথা বলে যাচ্ছে, যেন অন্য কোনও দিকে তার কোনও খেয়াল নেই, অথচ আকাশের কোন কোণে কখন সামান্য এক রত্তি মেঘ জমেছে, কখন একটুখানি হাওয়া কোন দিক থেকে এসে তার টাকের উপর মোলায়েমসে হাত বুলিয়ে গিয়েছে সেটা লক্ষ করেছে ঠিকই, এবং হঠাৎ কথা বন্ধ করে বলবে, চল দাদা, একটু পা চালিয়ে। ওই মুদির দোকানে একটুখানি মুড়ি খাব। দোকানে ঢোকামাত্রই কক্কড় করে বাজ আর টিনের ছাতের উপর চচ্চড় করে গামলা-ঢালা বৃষ্টি। তখন আপনার কানেও জল গেল, আপনার হুঁশিয়ার ইয়ার কোন মুড়ির সন্ধানে মুদির দোকানে ঢুকেছিলেন।