আহা, সেসব শ্লো টেম্পোর টিমে তেতালার দিনগুলো সব গেল কোথায়? এখন সকালে বিয়ে ঠিক, সন্ধের ভিতরই ডেকরেটররা এসে সবকিছু ছিমছাম ফিটফাট করে দিলে। তবে হ্যাঁ, তখন বাড়ি পাওয়া যেত সহজেই; এখন আর সে সুখটি নেই। কিছুদিন পূর্বেই ইয়োরোপের কোন এক দেশে নাকি কাগজে বিজ্ঞাপন বেরিয়েছিল :
পাত্রী চাই! পাত্রী চাই!! পাত্রী চাই!!! আপন নিজস্ব সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত বাড়ি যার আছে। এমন পাত্রী চাই। বাড়ির ফোটোগ্রাফ পাঠান।
***
কোথা থেকে কোথা এসে পড়লুম। ট্রাম্পকে নিয়ে এই তো বিপদ। সে যেরকম সোজা রাস্তায় নাক-বরাবর চলতে জানে না, তার কাহিনীও ঠিক তেমনই পারলেই সদর রাস্তা ছেড়ে এর খিড়কির দরজা দিয়ে তাকায়। ঝোঁপের আড়াল থেকে ওর পিছনের পুকুরের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।
আমি আমার ম্যাপ খুলে অনেকক্ষণ ধরে সেটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখার ভান করলুম। তার পর দাঁড়িয়ে উঠে বললুম, অনেক ধন্যবাদ, মাদাম? আপনাকে অযথা বিরক্ত করলুম।
এইবারে মাদামের অগ্নিপরীক্ষা।…মাদাম পাস! টেরমের ফে।
অবশ্য কিছুটা কিন্তু কিন্তু করেই বলেছিল–কিছু বলেছিল তো ঠিকই এখন তো রাত নটা। ভিন গায়ে পৌঁছতে–
আমি বাধা দিয়ে এক গাল হেসে বললুম, আদপেই না, মাদাম! আপনাকে সবকিছু খুলে কই।
বসুন না। মাদাম শুধু পাস না; একেবারে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট।
আমি শুনেছি, আপনাদের দেশে গরমের সময়ে দিনগুলো এত লম্বা হয় যে একটা দিনের আলো নাকি পরের দিনের ভোরকে গুড় মর্নিং বলার সুযোগ পায়। ঠিকমতো অন্ধকার নাকি আদপেই হয় না। এখানে আমি থাকি শহরে। ছটা সাতটা বাজতে না বাজতেই সব কড়া কড়া বিজলি বাতি দেয় জ্বালিয়ে। কিচ্ছুটি বোঝবার উপায় নেই, আলো, না অন্ধকার। ফিকে অন্ধকার, তরল অন্ধকার, ঘোরঘুট্টি অন্ধকার শুনেছি মিমারে নাকি গ্রামাঞ্চলে এর সব কটাই দেখা যায়। আমি হাঁটতে হাঁটতে দিব্য এগুতে থাকব আর অন্ধকারের গোড়াপত্তন থেকে তার নিকুচি পর্যন্ত রসিয়ে রসিয়ে চেখে চেখে যাব। এবং–
কিন্তু আপনার আহারাদি?
কে বলে এ রমণী খাণ্ডার।
মারিয়ানার ঠাকুরমাই তাকে বলেছিল, দেখ, দিকিনি, ও যে হাইকিঙে বেরিয়েছে, সঙ্গে স্যান্ডউইচ আছে কি না। আমার কোনও আপত্তি না শুনে মারিয়ানা আমার আধা-বাসি সাদামাটা স্যান্ডউইচগুলো তুলে নিয়ে আমার ব্যাগটা ভরতি করে দিয়েছিল গাদাগাদা রকম-বেরকমের স্যান্ডউইচে। সঙ্গে আবার টুথপেস্ট টুবের মতো একটা টুবও দিয়েছিল। ওর ভিতরে নাকি মাস্টার্ড আছে। বলেছিল স্যান্ডউইচে মাষ্টার্ড মাখিয়ে দিলে ওগুলো খুব তাড়াতাড়ি মিইয়ে যায়। যখন খাবে, তখন রাইটা মাখিয়ে নিও। আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিল, তোমারগুলো কাল সকালে আমি খাব।
তাই আমার ব্যাগটাকে আদর করতে করতে তাড়াতাড়ি বললুম, কী আর বলব, মাদাম, আমার সঙ্গে যা স্যান্ডউইচ আছে, তার জোরে আমি আপনাকে পর্যন্ত রুপালি বোর্ডারওয়ালা সোনালি চিঠি ছাপিয়ে নিমন্ত্রণ করতে পারি। কিন্তু সেটা আসল কথা নয়। আমি খাই অনেক দেরিতে। রাত এগারোটার সময়।
বললে, সে তো ঠাণ্ডা। গরম সুপ আছে।
আমি অনেক-কিছু এক ঝটকায় বুঝে গেলুম। সখা টেরমের প্রতি রাত্রে না হোক রোববার রাত্রে ইয়ার-দোস্তের সঙ্গে পাবে (মদের দোকান, ক্লাব এবং আড্ডার সমন্বয়) গুলতানি করে বাড়ি ফেরেন অনেক রাত্রিতে। পৃথিবীর কোনও জায়গাতেই গিন্নি-মা-রা এ অভ্যাসটি নেকনজরে দেখেন না। তাই সৃষ্টির আদিম যুগ থেকে একটা ভীষণ লড়াই চলেছে খরবেগে, একদিকে পাবওয়ালা, অন্যদি গৃহিণীর দল। গ্রামের কোনও কোনও পাবে তাই দেখেছি, পাব-ওয়ালা বেশ পয়সা খরচ করে বড় বড় হরফে দেয়ালে নিম্নেক্ত কবিতাটি পেন্ট করে নিয়েছে–
ফ্রাগে নিষট ডি উর ভি স্পেট এস সাই
ডাইনে ফ্রাই শিমফট উম সেন
গেনাও ভি উম ড্রাই।
ঘড়িটাকে শুধিয়ো না, কটা বেজেছে।
তোমার বউ তোমাকে দশটার সময় সেই বকাই বকবে, যেটা তিনটের সময় বকে!
মানুষ করেই-বা কী? জর্মনরা কারও বাড়িতে বসে আড্ডা জমানোটা আদপেই পছন্দ করে না। ডিনার-লাঞ্চে নিমন্ত্রণ করলে অবশ্য অন্য কথা। কিন্তু সে তো সম্পূর্ণ ভিন্ন বস্তু। এ-দেশেও এরকম লোক আছে, যাদের পেতে হলে চায়ের দোকানে যেতে হয়। পরের বাড়িতে যায় না, নিজের বাড়িতেও থাকে না।
এ অবস্থায় মেয়েরা কী করে?
কাচ্চা-বাচ্চা সামলায়। খামখা তিনবার বাচ্চাটার ফ্রক বদলিয়ে দেয়, চারবার পাউডার মাখায়, হাতের কাজ ক্ষান্ত দিয়ে ঘড়ি ঘড়ি টু মেরে যায় বাচ্চা ঠিকমতো ঘুমুচ্ছে কি না।
সেইখানে, যেখানে থাকবার কথা, ভরা গাঙ্গের তরতর স্রোত, যার উপর দিয়ে কলরব করে ধেয়ে চলবে ভরা পাল তুলে টেমের গিন্নির যৌবনতরী– হায়, সেখানে বালুচড়া। নৌকাটি যে মোক্ষম আটকা আটকেছে, তার থেকে তার নিষ্কৃতি নেই– কী করে জানিনে কথায় কথায় বেরিয়ে গিয়েছে, বেচারি সন্তানহীনা।
সমস্ত পৃথিবীটা নিষ্ফল সাহারায় পরিণত হোক, কিন্তু একটি রমণীও যেন সন্তানহীনা না হয়, মা হওয়ার আনন্দ থেকে বঞ্চিত না হয়।
তাই কি এ রমণীর হৃদয় থেকে সর্বরস বাষ্প হয়ে নক্ষত্রলোকে চলে গিয়েছে?– কেউ বলে খাণ্ডার, কেউ বলে হিসেবি? কিন্তু কই, ঠিক জায়গায় সামান্যতম খোঁচা লাগামাত্রই তো তার নৌকা চলুক আর না চলুক, পালে তো হাওয়া লাগল– স্বামীর জন্য তৈরি সুপ বাউণ্ডুলের সামনে তুলে ধরতে চায়।