অথচ ওদিক দিব্য খোলা গেট দিয়ে তার পিছন পিছন মারিয়ানার কার্লের মতো নির্ভয়ে এগিয়ে চললুম। মনে মনে এক গাল হেসে বললুম, ট্রয়ের ঘোড়া ঢুকেছে, হুঁশিয়ার।
তবু বলতে হবে সাবধানী মেয়ে। রান্নাঘরে না নিয়ে গিয়ে, গেল ড্রয়িংরুমে।
পাঠক আমাকে বোকা ঠাউরে বলবেন, এতেই তো আমাকে সম্মান দেখানো হল বেশি; কিন্তু আমি তা পূর্বেই নিবেদন করেছি, এ দেশের গ্রামাঞ্চলে হৃদ্যতা দেখাতে হলে কিচেন, লৌকিকতা করতে হলে ড্রয়িংরুম।
আমাদের পূর্ব বাঙলায় যেরকম আত্তি করতে হলে রাত্রিবেলা লুচি, আপনজন হলে ভাত।
.
১২.
হিটলারের পিতা যখন তার মাতাকে বিয়ে করতে চান, তখন বিশেষ কোনও কারণে চার্চের অনুমতির প্রয়োজন হয়েছিল। দরখাস্তে বিবাহের পক্ষে নানা সদযুক্তি দেখানোর পর সর্বশেষে বলা হয় তদুপরি বধূ অর্থসামর্থহীন; অতএব সে যে এরকম উত্তম বিবাহের সুযোগ পুনরায় এ-জীবনে পাবে সে আশা করা যায় না।
পণপ্রথা তোলার চেষ্টা করুন আর না-ই করুন, এ জিনিসটা সমাজের বিশেষ বিশেষ শ্রেণিতে পৃথিবীর প্রায় সর্বত্রই দেখেছি। বিশেষ করে মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ে।
চাষার বাড়ির ড্রয়িংরুম প্রায় একই প্যাটার্নের। এ বাড়িতে কিন্তু দেখি, শেলফে বইয়ের সংখ্যা সচরাচর হয় তার চেয়ে বেশি, অপ্রত্যাশিত রকমের বেশি। তদুপরি দেখি, দেয়ালে বেশকিছু অত্যুত্তম ছবির ভালো ভালো প্রিন্ট, সুন্দর সুন্দর ফ্রেমে বাঁধা। আমার মুখে বোধহয় বিস্ময়ের চিহ্ন ফুটে উঠেছিল। মাদামই বললেন, বিয়ের পূর্বে আমি কিছুদিন বন্ শহরে এক প্রকাশকের ওখানে কাজ করেছিলুম।
অ। সেই কথা। অর্থাৎ এ-দেশে যা আকছারই হয়ে থাকে। কনের বিত্তসামর্থ্য না থাকলে সে চাকরি করে পয়সা কামিয়ে যৌতুক কনে। যৌতুক কথাটা ঠিক হল না। স্ত্রী-ধন কথার সঙ্গে তাল রেখে ওটাকে বর-ধন বলা যেতে পারে।
এ-দেশের নিয়ম কনেকে রান্নাঘরের বাসন-বৰ্তন, হাঁড়িকুড়ি, মায় সিক–রান্নাঘরের তাবৎ সাজ-সরঞ্জাম, যার বর্ণনা পূর্বেই এক অনুচ্ছেদে দিয়েছি শোবার ঘরের খাট-গদি-বালিশ চাদর-ওয়াড়-আলমারি, বসবার ঘরের সোফা-চেয়ার ইত্যাদি সবকিছু সঙ্গে নিয়ে আসতে হয়। শহরাঞ্চলে বর শুধু একখানি ফ্ল্যাট ভাড়া করেই খালাস। বিয়ের কয়েকদিন আগে তিনি শুধু ফ্ল্যাটের চাবিটি কনের হাতে গুঁজে দেন। কনে বেচারি সতেরো-আঠারো বছর থেকে গা-গতর খাঁটিয়ে যে পয়সা কামিয়েছে তাই দিয়ে এ-মাসে কিনেছে এটা, ও-মাসে কিনেছে সেটা বছরখানেক ধরে, দাও বুঝে–এখন কয়েকদিন ধরে আস্তে আস্তে সেগুলো সরানো হবে, বরের ফ্ল্যাটে। বিয়ের পর বর-কনে কখনও-বা সোজা চলে যায় হানিমুনে, আর কখনও-বা ফ্ল্যাটে দু চার দিন কাটিয়ে। কিন্তু একটা কথা খাঁটি; এর পর আর মেয়েকে ঘরকন্না চালাবার জন্য অন্যকিছু দিতে হয় না– জামাইষষ্ঠীর তত্ত্ব এ-দেশে নেই।
আর ট্র্যুসোর কথা পাঠিকারা নিশ্চয়ই এঁচে নিয়েছেন। সেও আরম্ভ হয়ে যায় ওই ষোল-সতেরো বছর বয়স থেকে। জামা-কাপড় ফ্রক গাউনের এমব্রয়ডারি আরম্ভ হয়ে যায় ওই সময়ের থেকেই মায়ের সাহায্যে এবং পরে কোনও পরিবারে চাকরি নিলে সে বাড়ির গিন্নিমা অবসর সময়ে কখনও-বা এমব্রয়ডারির কাজ দেখিয়ে দেন, কখনও-বা নিজেই খানিকটা করে দেন। শুনেছি, বাড়ন্ত মেয়েরা টাইট-ফিটের জামা গাউনগুলোর সবকিছু তৈরি করে রাখে– বিয়ের কয়েকদিন আগে দরজির দোকানে গিয়ে কিংবা মা-মাসি সাহসিনী হলে তাদের সাহায্যে নিজেই কেটে সেলাই করে নেয়।
ব্যাপারটা দীর্ঘদিন ধরে চলে বলে এতে একটা আনন্দও আছে। আমার এক বন্ধু পরীক্ষা পাস করে চলে যাওয়ার সময় বলে গিয়েছিল তার ফিয়াসেকে যেন মাঝে মাঝে একটুখানি বেড়াতে নিয়ে যাই। বেচারি নিতান্ত একা পড়ে যাবে বলে, এবং আমার কোনও ফিয়াসে এমনকি বান্ধবী পর্যন্ত নেই বলে।
রাস্তায় নেমে আমি হয়তো বললুম, বাসন-কোসনের আলমারি হয়েছে, উনুন হয়েছে, এইবারে সিনক না?
বললে, হ্যাঁ, গোটা তিনেক এদিক-ওদিকে দেখেছি। আমার কিন্তু এটা ভারি পছন্দ হয়েছে। শহরের ওই প্রান্তে।
আমি বললুম, আহা, চলই না, দেখে আসা যাক কীরকম।
তুমি না বলেছিলে, রাইনের ওপারে যাবে?
কী জ্বালা! রাইন তো পালিয়ে যাচ্ছে না।
ছোট্ট শহর বন্। ডাইনে মুনস্টার গির্জে রেখে, রেমিগিউস স্ট্রিট ধরে ফের ডাইনেই য়ুনিভার্সিটি পেরিয়ে ঢুকলুম মার্কেট প্লেসে। বাঁ দিকে কাফে মনোপোল, ডান দিকে মনিসিপ্যাল আপিস। মার্গারেট বললে, দাঁড়াও। এদিকেই যদি এলে তবে চল ওই গলিটার ভিতর। রিডিং ল্যাম্পের সেল হচ্ছে– সস্তায় পাওয়া যাবে আমার যদিও পছন্দ হয়নি।
দেখেই আমি বললুম, ছ্যাঃ!
মার্গারেট হেসে বললে, আমিও তাই বলছিলুম।
করে করে, অনেকক্ষণ এটা-সেটা দেখে দেখে সবাই রাস্তায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে, দোকানে ঢাকা নদারদ, এখনও পাকাপাকি কেনার কোনও কথাই ওঠে না, মার্গারেটের মা দেখবে, পিসি দেখবে, তবে তো পৌঁছলুম সেই সিন্কের সামনে। আমি পাকা জউরির মতো অনেকক্ষণ ধরে ডাইনে ঘাড় নাড়ালুম, বায়ে ঘাড় নাড়ালুম, তার পর বাঁ হাতের কড়ে আঙুল দিয়ে ডান কানের উপরটা চুলকোতে চুলকোতে বললুম, হ্যাঁ, উত্তমই বটে। শেপটি চমৎকার, সাইজটিও বঢ়িয়া–দুজন লোকের বাসন-কোসনই-বা কখানা, তবে হ্যাঁ, পরিবার বাড়লে– মার্গারেট কী একটা বলেছিল; আমি কান না দিয়ে বললুম, তবে কি না বড় ধবধবে সাদা। এটিকে পরিষ্কার রাখতে জান বেরিয়ে যাবে। একটুখানি নীল ঘেঁষা হলে কিংবা ক্রেজি চাইনার মতো হলে– মার্গারেট বললে, সেই ঘষে ঘষে সাফ যদি করতেই হয় তবে ধবধবে সাদাই ভালো। মেহনত করব, উনি নীলচেই থেকে যাবেন, লোকে ভাববে হাড়-আলসে বলে নীল রঙের কিনেছি– কী দরকার?