হাইনের জীবনীকার বলেন, কোনও সুরা তরুণ হাইনেকে এতখানি উত্তেজিত করতে পারেনি সে যুগের আলঙ্কারিক-শ্রেষ্ঠের কয়েকটি কথায় তাকে যতখানি সোমাচ্ছন্ন করেছিল। রসরাজ শ্লেগেল স্বহস্তে হাইনের মস্তকে কবির রাজমুকুট পরিয়ে দিয়েছেন।
এর কিছুদিন পরে হাইনে তখনও কলেজের ছাত্র বেরল তার কবিতার বই, বুখ ড্যার লিডার, গানের বই, কিন্তু এর অনুবাদ গীতাঞ্জলি করলেই ঠিক হয়। আমরা অঞ্জলি বলতে যা বুঝি সেটা ইয়োরোপেও আছে, কিন্তু ঠিক শব্দটি নেই। গানের বইখানা পড়ার পর স্পষ্টই বোঝা যায়, অঞ্জলি শব্দটি ইয়োরোপে থাকলে হাইনে অতি নিশ্চয় ওইটেই ব্যবহার করতেন- কারণ এর অনেকগুলিই তাঁর প্রথমা প্রিয়ার পদপঙ্কজে অর্পিত প্রণয়প্রসূনাঞ্জলি।
সমস্ত জৰ্মনি সাত দিনের ভিতর এই কলেজের ছোকরার জয়ধ্বনি গেয়ে উঠল। হাইনে জর্মন কাব্যে আনলেন এক নতুন সুর। অথচ সত্য বলতে কী, এ সুরে কিছুমাত্র নতুনত্ব নেই, কারণ গীতিগুলো সরলতম ভাষায় রচিত। সরল ভাষা ব্যবহার করা তো আর বিশ্ব-সাহিত্যে কিছু নতুন নয়। কিন্তু জর্মন কাব্যে ওইটেই হল এক সম্পূর্ণ নবীন সুর কারণ জর্মনদের বিশ্বাস তাদের ঐতিহ্য তাদের সংস্কৃতি এমনই এক অবর্ণনীয় কুহেলিকাঘন আত্মোপলব্ধি প্রচেষ্টা এবং অর্ধ-সফলতা-অর্ধনৈরাশ্যে আচ্ছাদিত যে সেটা সরল ভাষায় কিছুতেই প্রকাশ করা যায় না। হাইনে দেখিয়ে দিলেন সেটা যায়। যেরকম সবাই যখন বলেছিল, অসম্ভব, তখন মধুসূদন দেখিয়ে দিয়েছিলেন, অমিত্রাক্ষরে বাঙলা কাব্য সৃষ্টি করা যায়!
হাইনের কবিতা সরল। সকলেই জানেন সরল ভাষায় লেখা কঠিন। সে-ও আয়ত্ত করা যায়। আয়ত্ত করা যায় না– সরল কিন্তু অসাধারণ হওয়া। সুখের লাগিয়া এ ঘর বাঁধিনু অনলে পুড়িয়া গেল–সরল অথচ বিরল লেখা।
ইংরেজিতে হাউসমানের সঙ্গে হাইনের তুলনা করা হয়। শুনতে পাই, হাউসমানের এপ শা ল্যাডের মতো কোনও ইংরেজি কবিতার বই এত বেশি বিক্রয় হয়নি– প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে। সাধারণ জন পড়েছে বইখানা সরল বলে, গুণীরা কিনেছেন বিরল বলে। পাঠককে অনুরোধ করি, দু জনারই লেখা তলিয়ে পড়তে। হাইনে অনেক উঁচুতে।*[*Edmund Wilson মার্কিন সমালোচক। আমি যে তাকে শ্রদ্ধা করি তার প্রধান কারণ তিনি এলিয়েটকে অপ্রিয় সত্য বলতে জানেন। হাইনে-হাউসমান সম্বন্ধে তিনি বলেন, There is immediate emotional experience in Housman of the same kind that there is in Heine, whom he imitated and to whom he has been compared. But Heine, for all his misfortunes, moves at ease in a large world. There is in his work an exhilaration of adventures, in travel, in love etc. Doleful his accents may sometimes be, he always lets in air and light to the mind. But Housman is closed from the beginning. His world has no opening horizons etc. The Triple Thinkers. p. 71.]
হাইনের কবিতা বাঙলায় অনুবাদ করেছেন প্রধানত সত্যেন্দ্র দত্ত তীর্থ সলিল ও তীর্থ রেণুতে এবং হয়তো অন্যান্য পুস্তকেও কিছু কিছু আছে। আর করেছেন যতীন্দ্রমোহন বাগচী।*[* ২. পরে জানতে পারি, বাঙলায় সর্বপ্রথম অনুবাদ করেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ প্রথম যৌবনে।]
এর বই যোগাড় করতে পারিনি, আমি ১৩১৭ সনের প্রবাসীতে পড়েছি। ডি রোজে, ডি লিলিয়ে, টাউবে দি রোজ, দি লিলি, দি ডাভের অনুবাদ করেছেন :
গোলাপ, কমল, কপোত, প্রভাত রবি
ভালোবাসিতাম কত যে এসবে আগে,
সেসব গিয়েছে, এখন কেবল তুমি,
তোমার মূর্তি পরাণে কেবল জাগে।
নিখিল প্রেমের নিঝর তুমি সে সবি
তুমিই গোলাপ, কমল, কপোত, রবি।
—(বাগচী, প্রবাসী, আশ্বিন ১৩১৭)
এবারে সত্যেন দত্তের একটি :
জাগিনু যখন উষা হাসে নাই,
শুধানু, সে আসিবে কি?
চলে যায় সাঁঝ আর আশা নাই,
সে ত আসিল না হয়, সখি?
নিশীথে রাতে ক্ষুব্ধ হৃদয়ে
জাগিয়া লুটাই বিছানায়;
আপন রচন ব্যর্থ স্বপন
দুখ ভারে নুয়ে ডুবে যায়।
ভারতবর্ষের প্রভাব হাইনের কবিতায় খুব বেশি আছে বলা যায় না। তার পূর্ববর্তী হিমালয় গ্যোটেই যখন হাইনের ওপর বিশেষ প্রভাব বিস্তার করতে পারেননি চণ্ডীদাসের উপর কার প্রভাব! তখন সে আশা দুরাশা। তবু একটি কবিতার উল্লেখ করি
গঙ্গার পার- মধুর গন্ধ ত্রিভুবন
আলো—ভরা
কত না বিরাট বনস্পতিরে ধরে
পুরুষ রমণী সুন্দর আর শান্ত প্রকৃতি-ধরা
নতজানু হয়ে শতদলে পূজা করে।
—(লেখকের অনুবাদ)
একদিক দিয়ে হাইনে গীতিকাব্য রচয়িতা, অন্যদিক দিয়ে তিনি সমস্ত জীবন লড়েছেন জর্মনির সাধারণ জনের ব্যক্তিস্বাধীনতার জন্য। সেই দোষে তাঁকে যৌবনেই নির্বাসন বরণ করতে হয়। জীবনের বেশিরভাগ তিনি কাটান প্যারিসে। সেখানে তিনি কী রাজার সম্মান পেয়েছিলেন, সে কথা লিখেছেন ভিক্টর হুগোর গুরু ফরাসি সাহিত্যের তখনকার দিনের গ্র্যান্ডমাস্টার গোতিয়ের। আর হাইনের সখা ও সহচর ছিলেন সঙ্গীতের গ্র্যান্ডমাস্টার রসৃসিনি। যদিও পরের কথা, তবু এই সুবাদে একটি মধুর গল্প মনে পড়ল।
জীবনের শেষ আট বছর হাইনের কাটে ওই প্যারিসেই, রোগশয্যায়, অবশ অথর্ব হয়ে অসহ্য যন্ত্রণায়। কার্লমার্কস যখন তাকে শ্রদ্ধা জানাতে আসেন তখন হাইনের চোখের পাতা আঙুল দিয়ে তুলে ধরতে হয়েছিল যাতে করে তিনি মার্কসকে দেখতে পান। এর কিছুদিন পর হাইনের বাড়িতে আগুন লাগে। বিরাট বপু দরওয়ান রোগজীর্ণ হাইনেকে কোলে করে নিয়ে গেল নিরাপদ জায়গায়। আগুন নেভানোর প্র যখন তাকে দরওয়ান আবার কোলে তুলে নিয়ে এল তখন হাইনে মৃদুহাসি হেসে তার এক সখাকে বললেন, হামবুর্গে মাকে লিখে দাও, প্যারিসের লোক আমাকে এত ভালোবাসে যে কোলে নিয়ে ঘুরে বেড়ায়।