যার সরল, নিষ্কাম জীবন দেখে বিশ্বকবি পর্যন্ত মুগ্ধ হয়ে আপন মনে নিজের সম্বন্ধে জমা-খরচ নিতে গিয়ে ক্ষুব্ধ হয়েছেন, তাঁর সম্বন্ধে আমাদের আর বেশি কিছু বলার কী থাকতে পারে?
শুধু এইটুকু বলি– তেজেশচন্দ্র নির্জন লোকচক্ষুর অগোচরে থাকতে ভালোবাসতেন। তাই যাবার সময়ও তিনি সকলের অগোচরে চলে গেলেন। ভোরবেলা জাগাতে গিয়ে দেখা গেল, লোকচক্ষুর অগোচরে তিনি চলে গিয়েছেন ॥
কই সে?
রবীন্দ্রনাথের বিশ্বাত্মবোধ, গ্যোটের ভূয়োদর্শন, শেপিয়রের মানব-চরিত্রজ্ঞতা সামান্য জনও কিছু না কিছু উপলব্ধি করতে পারে। সৃষ্টিকর্তা পৃথিবীকে দিয়েছেন মাত্র একটি হিমালয়; আমাদের মানস-লোকে এই তিনজনই তিনটি হিমালয়। সাধারণ জন দূরে থেকেও এদের গাম্ভীর্য-মাধুর্য দেখে বিস্ময় বোধ করে চূড়ান্তে অধিরোহণ করেন অল্প মহাত্মাই। আরও হয়তো একাধিক হিমালয় এ-ভূমিতে, অন্যান্য ভূমিতে আছেন– ভাষা ও দূরত্বের কুহেলিকায় আজও তাঁরা লুক্কায়িত।
এছাড়া প্রত্যেক পাঠকেরই আপন আপন অতি আপন প্রিয় কবি আছেন। তাঁদের কেউ কেউ হয়তো বিশ্বজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেননি হয়তো তাদের সে মেধা নেই; এদের স্বীকার করে নিয়েও আমরা এদের নাম বিশ্বকবিদের সঙ্গে এক নিশ্বাসে বলি না।
আমি দু জন কবিকে বড় প্রাণ দিয়ে ভালোবাসি। আমারই সৌভাগ্য, এদের একজন বাঙালি- চণ্ডীদাস, অন্যজন জর্মন, নাম হাইনে। প্রশ্ন উঠতে পারে, বড় বড় কবিদের ছেড়ে এঁদের প্রিয় বলে বরণ করেছি কেন? কারণটা তুলনা দিয়ে বোঝালে সরল হয়। রাজবাড়ির ঐশ্বর্য দেখে বিমোহিত হই, বিনোবাজির ব্যক্তিত্ব দেখে বাক্যস্ফূর্তি হয় না, কিন্তু রাজবাড়িতে তথা বিনোবাজির সাহচর্যে থাকবার মতো কৌতূহল যদি-বা দু-একদিনের জন্য হয়, তাঁদের সঙ্গে অহরহ বাস করতে হলে আমার মতো সাধারণ জনের নিশ্বাস রুদ্ধ হয়ে আসবে।
চণ্ডীদাসকে নিয়ে মোল, আর হাইনেকে নিয়ে সতের বছর বয়েস থেকে ঘর করেছি। একদিনের তরে কোনও প্রকার অস্বস্তি বোধ করিনি। আমি জানি, এ-বিষয়টি আরও সরল করে বুঝিয়ে বলা যায়, কিন্তু তার প্রয়োজন নেই। কারণ প্রত্যেকেরই আপন আপন প্রাণপ্রিয় ঘরোয়া কবি আছেন- শেকসপিয়র গ্যোটে নিয়ে ঘর করেন অল্প লোকই তারা এতক্ষণে আমার বক্তব্যটি পরিষ্কার বুঝে গিয়েছেন। নিজের পিঠ নিজে কখনও দেখিনি, কিন্তু সেটা যে আছে সে-কথা অন্য লোককে যুক্তিতর্ক দিয়ে সপ্রমাণ করতে হয় না।
চণ্ডীদাস ও হাইনের মতো সরল ভাষায় হৃদয়ের গভীরতম বেদনা কেউ বলতে পারেনি। রবীন্দ্রনাথ আর গ্যোটেও অতি সরল ভাষায় কথা বলতে জানতেন, কিন্তু তারা সৃষ্টিরহস্যের এমন সব কঠিন জিনিস নিয়ে আপন আপন কাব্যলোক রচনা করেছেন যে সেখানে তাঁদের ভাষা বিষয়বস্তুর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে দুয়ে হতে বাধ্য। চণ্ডীদাস, হাইনে তাদের, আমাদের হৃদয়-বেদনালোকের বাইরে কখনও যেতে চাননি। তাঁরা গান গেয়েছেন, আমাদের আঙিনায় তেঁতুলের ছায়ায় বসে– তারা-ঝরা-নিঝরের ছায়াপথ ধরে ধরে তারা সপ্তর্ষির গগনাঙ্গন পৌঁছে সেখানকার অমর্ত্য গান গাননি।
চণ্ডীদাসকে সব বাঙালিই চেনে, হাইনের পরিচয় দি।
আমাদের পরিচিত জনের মাধ্যমেই আরম্ভ করি।
যারা গত শতাব্দীতে ইয়োরোপে সংস্কৃতচর্চা নিয়ে কিঞ্চিত্র আলোচনা করেছেন তারাই আউগুস্টু ভিলহেলম ফন শ্লেগেলের সঙ্গে পরিচিত।
জর্মনির বন্ বিশ্ববিদ্যালয়েই সর্বপ্রথম সংস্কৃতচর্চার জন্য আসন প্রস্তুত করা হয়। ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি আসনে অধ্যাপকরূপে বিরাজ করতেন। একদিকে তিনি সংস্কৃতের নাট্যকাব্যের সঙ্গে পরিচিত, অন্যদিক দিয়ে তখনকার গৌরবভাস্কর ফরাসি সাহিত্যের বিপুল ঐশ্বর্য ভোগ করেছিলেন বিখ্যাত ফরাসি সাহিত্যসম্রাজ্ঞী মাদাম দ্য স্তালের সখা ও উপদেষ্টারূপে। তাই তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে সংস্কৃত ছাড়াও পড়াতেন নন্দনশাস্ত্র বা অলঙ্কার। এক বৎসর যেতে না যেতে হাইনে বন এলেন আইন পড়তে। শ্লেগেলের বক্তৃতা শুনে তিনি এমনই অভিভূত হয়ে গেলেন যে আইনকে তিনি নির্বাসনে পাঠালেন।
শ্লেগেল অলঙ্কার পড়াবার সময় নিজেকে গ্রিক লাতিন ফরাসি জর্মনের ভিতর সীমাবদ্ধ করে রাখতেন না। ঘন ঘন সংস্কৃত কাব্যোপবনে প্রবেশ করে গুচ্ছ গুচ্ছ গীতাঞ্জলির সঞ্চয়িতা তাঁর শিষ্যদের সামনে তুলে ধরতেন। হাইনের বয়স তখন একুশ বাইশ। সেই সর্বজনমান্য প্রবীণ জ্ঞানবৃদ্ধ রসিকজননমস্য শ্লেগেলের কাছে হাইনে একদিন নিয়ে গেলেন তার একগুচ্ছ সরল কবিতা।
উত্তম, উত্তম কবিতা, কিন্তু তোমাকে প্রচুর পরিশ্রম করতে হবে। বড়বেশি পুরনো অলঙ্কারের ছড়াছড়ি, নিজের কথার আড় কবিতাকে কৃত্রিম করে ফেলেছ। দুরুদুরু বুকে হাইনে মৃদু আপত্তি জানালেন। শ্লেগেল নির্দয় সমালোচক। বললেন, বুঝেছি, বুঝেছি। কিন্তু তোমার কাব্যরানি এখনও পরে আছেন জবরজঙ্গ জামাকাপড়, তার মুখে বড্ডবেশি কালো তিল, তার ক্ষীণ কটি আর কত ক্ষীণ করবে, তার খোঁপা যে আকাশে উঠে গেছে। একে ভালোবাসার যুগ তোমার পেরিয়ে গিয়েছে।
কিন্তু বন্ধু, তোমার ভাস্কর কাব্যলক্ষ্মী ঘুমিয়ে আছেন কে জানে কোন ইন্দ্রজালের মোহাচ্ছ মায়ায় উত্তর দেশে। নিভৃতে নির্জনে। প্রেমাতুর, বিরহবেদনায় বিবর্ণ কত না তরুণ রাজপুত্র বেরিয়েছেন তার সন্ধানে। হয়তো তুমিই, তুমিই বন্ধু সেই ভানুমতী মন্ত্র পড়ে তাঁকে দীর্ঘ শর্বরীর, দীর্ঘতর নিদ্রা থেকে জাগরিত করবে। ঘণ্টাধ্বনি বেজে উঠবে। চতুর্দিকে বনস্পতি গান গেয়ে উঠবে, প্রকৃতিও জেগে উঠবে আপন জডুনিদ্রা থেকে। জর্মন কাব্যলক্ষ্মীর চতুর্দিকের প্রাকার ধ্বংসাবশেষ রূপান্তরিত হবে স্বর্ণোজ্জ্বল রাজপ্রাসাদে। গ্রিসের সুরপুত্রগণ আবার এসে অবতীর্ণ হবেন তাদের চিরনবীন দেবসজ্জার মহিমায়…প্রার্থনা করি আপোল্লো দেব তোমার প্রতি পদক্ষেপের দিকে অবিচল দৃষ্টি রাখুন।