এইসব জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা করার সময় তেজেশচন্দ্রের সম্মুখে অহরহ থাকত তার ছাত্রসমাজ। সাধকমাত্রই চারুসৰ্বাঙ্গ অমূর্ত জ্ঞানের সন্ধান করেন– তেজেশচন্দ্রও তাই করতেন কিন্তু তিনি বার বার সেই ছাত্রসমাজকে স্মরণ করে তাদের যা দরকার, তার বাইরে সহজে যেতে চাইতেন না। তিনি তাঁর জীবনসাধনা দিয়ে প্রমাণ করেছেন, মানুষের শক্তি অসীম নয়, ছাত্রসেবাই যদি করতে হয়, তবে তার সঙ্গে খাপ খাইয়ে অন্য জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা করবে।
তাঁর বহু শিষ্যই জানত, তিনি বিজ্ঞানের গভীর থেকে মুক্তা আহরণ করে তাদের সামনে ধরেছেন– পরবর্তীকালে ভালো ভালো বিজ্ঞানাগার থেকে এমএসসি পাস করার পর অনেকেই সেটা আরও পূর্ণরূপে হৃদয়ঙ্গম করেছে। তাদের কেউ কেউ যখন সাংবাদিক জগতে প্রবেশ করল, তখন তাদের অনুরোধের তাড়নায় তিনি সেগুলো প্রবন্ধাকারে লিখে দেন। আনন্দবাজার, দেশে তাঁর প্রচুর লেখা বেরিয়েছে। এই তো সেদিন মাত্র কলকাতা থেকে আমার ওপর তাগিদ এল, তেজেশবাবুর পিছনে লেগে থাক, যতক্ষণ না তাঁর লেখাটি শেষ হয়।
ছেলেবেলায় আমরা এই শান্তিনিকেতনে দেখেছি, ছাতিমফুল, শালফুল আর বকুল। খোয়াই ডাঙাতে আকন্দ। তাই এই তিনটি প্রথমোক্ত কবিজনবল্লভ পুষ্প-বন্দনা যখন নিতান্তই শেষ হয়ে গেল, তখন রবীন্দ্রনাথ লিখলেন–
যেদিন প্রথম কবি-গান
বসন্তের জাগাল আহ্বান
ছন্দের উৎসব সভাতলে,
সেদিন মালতী যূথী জাতি
কৌতূহলে উঠেছিল মাতি
ছুটে এসেছিল দলে দলে।
আসিল মল্লিকা চম্পা কুরুবক
কাঞ্চন করবী
সুরের বরণমাল্যে সবারে
বরিয়া নিল কবি।
কী সংকোচে এলে না যে,
সভার দুয়ার হল বন্ধ
সব পিছে রহিল আকন্দ।
মোটামুটি ওই সময়ে হঠাৎ দেখা গেল, তেজেশচন্দ্র সেন মাথায় সাঁওতালি টোকা, হাতে নিড়েন নিয়ে ১১৪ ডিগ্রি গরমে আশ্রমের সর্বত্র খোঁচাখুঁচি আরম্ভ করেছেন। কী ব্যাপার? তিনি তার ষোল বৎসরের সঞ্চিত উদ্ভিদবিদ্যা কাজে লাগিয়ে হাতে-নিড়েনে দেখিয়ে দেবেন, সেই কাঁকর-বালি-উঁই-পাথর, ক্ষণে জলাভাব ক্ষণে অতিবৃষ্টির খোয়াই ডাঙাতেও মরসুমি ফুল ফোঁটানো যায়। বাধ্য হয়ে আকন্দে যাবার প্রয়োজন নেই।
আজকের লোক এসব সহজে বিশ্বাস করবেন না। এখানে এখন ভারতের সব ফুল তো ফোটেই, তার ওপর ফোটে নানা বিদেশি ফুল, এমনকি অযত্নে আগাছার মতো–রবীন্দ্রনাথের বহু বিদেশি শিষ্য-সখা এগুলো নানা দেশ থেকে তেজেশচন্দ্রের কৃতকার্যতার পর এখানে পাঠাতে আরম্ভ করেন। রবীন্দ্রনাথের বনবাণীতে তার অনেকখানি ইতিহাস আছে। আজ যে উত্তরায়ণে এত ফুলের বাহার, সেটা সম্ভব হল তেজেশচন্দ্রের পরীক্ষা সফল হল বলে।
বোধহয় এই সফলতা জানিয়েই তিনি রবীন্দ্রনাথকে চিঠি লেখেন। প্রভাত মুখোপাধ্যায় রবীন্দ্র-জীবনীতে লিখেছেন, ভিয়েনা প্রবাসকালে কবিকে শান্তিনিকেতন হইতে তথাকার পুরাতন শিক্ষক তেজেশচন্দ্র সেন গাছপালা সম্বন্ধে কতকগুলি রচনা পাঠাইয়া দেন। তাহার উত্তরে (২৩শে অক্টোবর, ১৯২৬) কবি লিখিতেছেন, তোমার লেখাগুলির মধ্যে শান্তিনিকেতনের গাছপালাগুলি মর্মরধ্বনি করে উঠছে। তাতেই আমার মন পুলকিত করে দিল। পরবর্তীকালে তার উদ্দেশে আবার লিখেছেন–
একথা কারও মনে রবে কি কালি,
মাটির পরে গেলে হৃদয় ঢালি!
কার্তিকের বউ কলাগাছ। অকৃতদার তেজেশচন্দ্র বরণ করেছিলেন একটি তালগাছকে। আমার মনে হয় শান্তিনিকেতনের প্রতীক সপ্তপর্ণী না হয়ে তালগাছ হওয়া উচিত। এখানকার আদিম ছাতিমগাছটি খুঁজে বের করতে হয়। অথচ এখানে পৌঁছবার বহু পূর্বেই দূর থেকে দেখা যায়, আশ্রমের এদিকে-ওদিকে সারি সারি তালগাছ প্রহরীর মতো দাঁড়িয়ে দিগন্তের পানে তাকিয়ে আছে অপ্রত্যাশিত মিত্রের আগমন আশঙ্কায়। তালগাছগুলো যে যুগের, তখন বীরভূমে ডাকাতের অনটন ছিল না। দ্বিজেন্দ্রনাথকে বলতে শুনেছি (১৯২৫), তিনি যখন চল্লিশ বৎসর পূর্বে এদেশে প্রথম আসেন, তখনও ওই তালগাছগুলোর ওই উচ্চতাই ছিল।
শান্তিনিকেতনে বোধহয় এমন কেউ আসেননি যিনি, একটি তালগাছকে ঘিরে গোল একখানা কুটির দেখেননি। মন্দিরের উত্তর-পূর্ব-কোণে, ডাকঘরের প্রায় মুখোমুখি। এটি তেজেশচন্দ্রের নীড়।
রবীন্দ্রনাথের বনবাণীতে একটি কবিতা আছে কুটিরবাসী। কবিতাটির ভূমিকাস্বরূপ তিনি লেখেন,
তরুবিলাসী আমাদের এক তরুণ বন্ধু এই আশ্রমের কোণে পথের ধারে একখানা গোলাকার কুটির রচনা (এখানে লক্ষণীয় নির্মাণ নয়- রচনা) করেছেন। সেটি আছে একটি পুরাতন তালগাছের চরণ বেষ্টন করে। তাই তার নাম হয়েছে তালধ্বজ। এটি যেন মৌচাকের মতো নিভৃতবাসের মধু দিয়ে ভরা। লোভনীয় বলেই মনে করি, সেইসঙ্গে এও মনে হয়, বাসস্থান সম্বন্ধে অধিকার-ভেদ আছে : যেখানে আশ্রয় নেবার ইচ্ছা থাকে সেখানে হয়তো আশ্রয় নেবার যোগ্যতা থাকে না।
তেজেশ-শিষ্যমণ্ডলীর কাছে কুটিরবাসী কবিতাটি সুপরিচিত। এর দুটি পাঠ আছে। পাঠকমাত্রকেই এ-দুটি মর্মস্পর্শী কবিতা পড়তে অনুরোধ করি। আমি মাত্র কয়েকটি ছত্র তুলে দিচ্ছি–
তোমারি মতো তব
কুটিরখানি
স্নিগ্ধ ছায়া তার
বলে না বাণী।
তাহার শিয়রেতে তালের গাছে
বিরল পাতা কটি আলোয় নাচে,
সম্মুখে খোলা মাঠ
করিছে ধূ-ধূ
দাঁড়ায়ে দূরে দূরে
খেজুর শুধু।
কীর্তিজালে ঘেরা আমি তো ভাবি
তোমার ঘরে ছিল আমারো দাবি;
হারায়ে ফেলেছি সে।
ঘূর্ণিবায়ে,
অনেক কাজে আর,
অনেক দায়ে।