- বইয়ের নামঃ ভবঘুরে ও অন্যান্য
- লেখকের নামঃ সৈয়দ মুজতবা আলী
- প্রকাশনাঃ স্টুডেন্ট ওয়েজ
- বিভাগসমূহঃ প্রবন্ধ
আচার্য তেজেশচন্দ্র সেন
রবীন্দ্রনাথ গত হলে বোম্বায়ে তাঁর স্মরণে সম্মিলিত এক শোকসভায় শুনতে পাই, আসুন আমরা রবীন্দ্রনাথের অকালমৃত্যুতে–
সেই সর্বব্যাপী শোকের মাঝখানে ওই, অকালমৃত্যু কথাটি শুনে কারও কারও অধরপ্রান্তে ম্লান হাসির সামান্যতম রেখাঁটি ফুটে উঠেছিল। সকলেই বোধহয় ভেবেছিলেন, আশিতে পরলোকগমন ঠিক অকালমৃত্যু নয়!
আমি কিন্তু সচেতন হলুম- সত্যই তো, যদিও মহিলা হয়তো চিন্তা করে অকালমৃত্যু বাক্যটি ব্যবহার করেননি, কথাটি অতিশয় সত্য। যে-কবি প্রতিদিন নিত্য নবীনের সন্ধানে তরুণের ন্যায় উগ্রীব, তাকে নব নব রূপে-রসে পরিবেশন করার সময় যাঁর লেখনীতে নবীন অভিজ্ঞতা ও প্রাচীন প্রকাশ-দক্ষতা সমন্বিত হয়, চৈতন্যহীন হওয়ার কয়েক দণ্ড পূর্বেও যিনি অধ্যাত্মলোকে এক নবীন জ্যোতির সন্ধান পেয়ে সে-জ্যোতি কখনও ছন্দ মেনে, কখনও মিল না মেনে তারই উপযোগী ভাষায় প্রকাশ করার সময় কঠিন রোগপীড়ন সম্বন্ধে সম্পূর্ণ অচেতন, যিনি আরও দীর্ঘ সুদীর্ঘকাল অবধি আরও নবীন নবীন অভিজ্ঞতার জন্য প্রস্তুত— আশি কেন দুই শতেও তাঁর লেখনী স্তব্ধ হলে সে মৃত্যু অকালমৃত্যু। পক্ষান্তরে সাহিত্যের ইতিহাসে এমন বহু কবির উল্লেখ পাই, যাদের সৃষ্টিসত্তার মৃত্যু হয়েছে চল্লিশে দেহত্যাগ যদিও তারা করেছেন নব্বইয়ে।
আচার্য তেজেশচন্দ্রের দেহত্যাগ একাত্তরে হয়েও সেটা অকাল দেহত্যাগ। তিনি রবীন্দ্রনাথের ন্যায় বিধিদত্ত অদ্ভুত ক্ষমতা নিয়ে জন্মাননি, কিন্তু এ কথা কেউ অস্বীকার করবেন না, সৃষ্টিকর্তা এই সংসার রঙ্গমঞ্চে যে পার্টে তাঁকে পাঠিয়েছিলেন, সেটি তিনি প্রতিদিন অতিশয় নিষ্ঠার সঙ্গে উদযাপন করার পর প্রতি রাত্রে প্রস্তুত হতেন, আগামী প্রাতে সেই অভিনয় সর্বাঙ্গসুন্দর করার জন্য।
তেজেশচন্দ্রের সহকর্মী মৌলানা জিয়াউদ্দিনের স্মরণে উভয়ের গুরু রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন–
কারও কবিত্ব, কারও বীরত্ব,
কারও অর্থের খ্যাতি
কেহ-বা প্রজার সুহৃদ্ সহায়।
কেহ-বা রাজার জ্ঞাতি
এবং তার পর সামান্য একটু পরিবর্তন করে কবির ভাষাতেই তেজেশচন্দ্রের উদ্দেশে বলি–
তুমি আপনার শিষ্যজনের
প্রশ্নেতে দিতে সাড়া,
ফুরাতে ফুরাতে রবে তবু তাহা
সকল খ্যাতির বাড়া
বাস্তবিক এই একটি লোক তেজেশচন্দ্র, যাকে স্বভাব-কবির মতো স্বভাব-গুরু বা জন্ম-গুরু বলা যেতে পারে। সত্তরেও তাঁর মৃত্যু অকালমৃত্যু।
পঞ্চাশ বত্সর পূর্বে ষোল-সতের বৎসর বয়সে তিনি শান্তিনিকেতন ব্রহ্মচর্য বিদ্যালয়ে আসেন। আশ্রম স্থবিররা কেউই ঠিক বলতে পারেন না, তিনি এখানে গুরুরূপে না শিষ্যরূপে এসেছিলেন। তবে একথা সত্য, অল্পদিনের ভিতরই তিনি শিক্ষকতা আরম্ভ করে দেন।
প্রশ্ন উঠতে পারে, ষোল বত্সরের বালক জানেই-বা কী– কটা পাস দিয়েছে, সেটা না-হয় বাদই দেওয়া গেল– পড়াবেই-বা কী?
এ-প্রথা এদেশে অপ্রচলিত নয়। গুরুগৃহে বিদ্যাসঞ্চয় করার সময় কনিষ্ঠকে বিদ্যাদান করার প্রথা এদেশের আবহমানকাল থেকে চলে আসছে। গ্রামের পাঠশালাতে এখনও সর্দার পড়ুয়া নিচের শ্রেণিতে পড়ায়।
তার পর তিনি দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর অধ্যয়ন-অধ্যাপনা করেছেন। এত দীর্ঘকালব্যাপী অধ্যাপনা নাকি পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল।
শুনেছি, শান্তিনিকেতন বিহঙ্গশাবক যখন একদিন পক্ষবিস্তার করে মহানগরীর আকাশের দিকে তাকালে– অর্থাৎ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপন করতে চাইলে তখন তেজেশচন্দ্র নাকি কুণ্ঠিতস্বরে রবীন্দ্রনাথকে বলেছিলেন, আমি তা হলে প্রাইভেট পরীক্ষা দিয়ে পাসটাসগুলো করি। রবীন্দ্রনাথ নাকি হেসে বলেছিলেন, ওসব তোমাকে করতে হবে না।
কিন্তু এই পঞ্চাশ বৎসরের স্বাধ্যায়লব্ধ বিষয়বস্তু কী?
সঙ্গীতে তাঁর বিধিদত্ত প্রতিভা ছিল। তিনি বেহালা বাজাতে পারতেন। ওদিকে শেষ বয়সে রবীন্দ্রনাথ বিলাতিবাদ্যযন্ত্র বর্জন করেছিলেন। একমাত্র তেজেশচন্দ্রকেই দেখেছি রবীন্দ্রনাথের সামনে যখন দিনেন্দ্রনাথ বর্ষামঙ্গল বসন্তোৎসব ও অন্যান্য অনুষ্ঠানের সমবেত সঙ্গীত পরিচালনা করতেন, তখন তেজেশচন্দ্র বেহালা বাজাতেন। রবীন্দ্রসঙ্গীতের স্বরলিপির গায়নপদ্ধতি গায়কি ঘরানা নিয়ে কিছুদিন ধরে যে ভূতের নৃত্য আরম্ভ হয়েছে, তার ভিতরে তিনিই ছিলেন বিজ্ঞ রবীন্দ্র-সঙ্গীতসুরজ্ঞ। তাঁর নাম কেউ করেননি তিনিও তৃপ্তির নিশ্বাস ছেড়ে বেঁচেছিলেন।
সাহিত্যে তার প্রচুর রসবোধ ছিল। ১৯১৯-২০ সালে যখন শান্তিনিকেতনে ফরাসি ভাষা শিক্ষার সূত্রপাত হয় তখন তিনি অগ্রণী হয়ে, ফরাসি শিখে আনাতোল ফ্রাঁসের রচনা বাঙলায় অনুবাদ করেন ও তখনকার শান্তিনিকেতন মাসিক পত্রিকায় পরপর প্রবন্ধ লেখেন। সুদূর শ্রীহট্টে বসে সেগুলো পড়ে আমি বড়ই উপকৃত হই। এই তাঁর সঙ্গে আমার প্রথম চিন্ময় এবং বাঅয় পরিচয়।
শান্তিনিকেতন প্রধানত সাহিত্য, সঙ্গীত, নৃত্য, চিত্রকলার পীঠভূমি। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ প্রকাশ্যে একাধিকবার ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন যে, তিনি অর্থাভাবে এখানে সামান্যতম লেবরেটরি নির্মাণ করে বিজ্ঞানচর্চার কোনও ব্যবস্থা করতে পারেননি। তাঁর সে শোক কথঞ্চিৎ প্রশমিত করেছিলেন, জগদানন্দ রায় ও তেজেশচন্দ্র সেন। বিজ্ঞানাগার ছাড়াও কোনও কোনও বিজ্ঞান অন্তত কিছুটা শেখা যায়। উদ্ভিদবিদ্যা ও বিহঙ্গজ্ঞান! আর একাধিক সম্পূর্ণ বিজ্ঞান তিনি আয়ত্ত করেছিলেন, কিন্তু ওইসব বিষয়ে আমার কণামাত্র সঞ্চয় নেই বলে, তেজেশচন্দ্রের প্রতি অবিচার করার ভয়ে নিরস্ত হতে হল।