বছর-পঞ্চাশেক পূর্বে ঢাকার এই কুট্টি ভাষা সম্বন্ধে একটি প্রবন্ধ বেরোয়। তাতে এই আমলের কুট্টিভাষার উদাহরণস্বরূপ বলা হয়।
করিম বক্সকা মা নে আর রহিম বকা জরুনে এয়সা লাগিস লাগিস্তা কে এ ভি উসকা বালমে ধরি টানিস্তা, উ ভী ইসকা বামে ধরি টানিস্তা।
অর্থাৎ করিম বশের মা আর রহিম বখশের স্ত্রীতে এমন লাগাই লাগল (কোদল) যে, এ ওর চুল ধরে টানে, ও এর চুল ধরে টানে।
(কুট্টি ভাষার উদ্ধৃতিতে কোনও ভুল থাকলে যেন কুট্রিভাষাভাষী আমার ওপর বিরক্ত না হন– কারণ কুটি গাড়োয়ান ছাড়া অন্য অনেক লোক এ-ভাষা বলে থাকেন এবং বাঙলা সাহিত্যের চর্চাতে আনন্দ পান। পূর্বে এরা সকলেই উঁচু সাহিত্যপ্রেমিক ছিলেন। শুনতে পাই এদের কেউ কেউ নাকি ভাষা-আন্দোলনে বাঙলা ভাষার পক্ষ নেন।)
***
হাওয়া গাড়ি চইলা গেল গো।
(আমার) বন্ধু আইল না।
গানটি পুব-বাঙলায় রূপকার্থেও নেওয়া হয়। রবীন্দ্রনাথ যে হাসন রাজার—
মম আঁখি হইতে পয়দা আসমান জমিন।
কানেতে করিল পয়দা মুসলমানি দীন (ধর্ম)–
নাকে পয়দা করিয়াছে খুশবয় বদ্বয় (সুগন্ধ, দুর্গন্ধ)
আমা হইতে সব উৎপত্তি হাসন রাজায় কয়।
এ ছত্রগুলো ব্যবহার করেন, সেই হাসন রাজারই একটি গান আছে, হাওয়ার গাড়ি ধু ধা করে চলেছে। (নিশ্বাস প্রশ্বাসের হাওয়ায় যে গাড়ি চলে অর্থাৎ শরীর) তার ভিতর সায়েব সোয়ারি (পরমাত্মা, আল্লা) বসে আছেন। হাসন রাজা (অর্থাৎ ব্যষ্টি পুরুষ) সেই সায়েবকে সেলাম করাতে (মর্মে মর্মে তাকে ভক্তিতরে অনুভব করাতে) তিনি হাসনকে আদর করে পাশে বসালেন।
পুরো গানটি আমার স্মরণে নেই; তবে শেষের দু ছত্র আছে–
হাসন রাজা, নচিতে আছে, আল্লা আল্লা ধরি।
পবনের গাড়ি চলতে আছে ধু ধু ধা ধা করি।
এখানে পবনের গাড়ি, হাওয়া গাড়ি, শ্রদ্ধেয় বসু মশায়েরও হাওয়া গাড়ি মোটামুটি একই। তাই অর্থ দাঁড়ায়, পবনের গাড়ি অর্থাৎ আমার প্রাণবায়ু চলে গেল, তবু আমার বন্ধু এল না। বলাবাহুল্য পুব-বাঙলার ভাটিয়ালি গীত রচয়িতা এবং পশ্চিম বাঙলার বাউল উভয়ই কিছুদিন আগে পর্যন্তও অত্যন্ত সজীব, প্রাণবন্ত স্রষ্টা ছিলেন বলে নতুন নতুন জিনিস আমদানি হলেও তাকে সিমবল, রূপক রূপে, এলেগরি করে মরমিয়া মিস্টিক) গান রচনা করতেন। যেমন রেলগাড়ির ঘণ্টা বেজেছে (আসন্ন মৃত্যুর ধ্বনি বেজেছে), আমি যাত্রী ঘুমে অচৈতন্য (তমোঋণে আচ্ছন্ন) ইত্যাদি। বিজলিবাতি নিয়ে একটি গান আমার আবছা আবছা মনে পড়ছে। হাওয়া গাড়ি প্রবর্তিত হলে এ শতাব্দীর গোড়ার দিকে ওই মোতিফ নিয়ে একাধিক গীত রচিত হয়।
***
প্রধানত রিকশার চাপে কুট্টি গাড়োয়ান সম্প্রদায় ঢাকার রাস্তা থেকে প্রায় অন্তর্ধান করেছে। কিন্তু শেষদিন পর্যন্ত এরা নতুন নতুন অবস্থায় নতুন নতুন রসিকতা তৈরি করে গিয়েছে– অনেকেরই ভুল বিশ্বাস, এদের রসিকতার একটি প্রাচীন ভাণ্ডার ছিল এবং তারা শুধু সেগুলো ভাঙিয়েই খায়, আমি যে শেষ রসিকতাটি শুনেছি, সেটি ১৯৪৭-৪৮ সালে নির্মিত।
আমি ১৯৪৮ সালে ঢাকার এক আত্মীয়কে শুধোই, মুসলিম লীগ কীরকম রাজত্ব চালাচ্ছেন?
তিনি বললেন, সে সম্বন্ধে একটি কুঠি রসিকতা বাজারে চালু হয়েছে। অত্যন্ত ক্যারাটিরিসটি–অর্থাৎ লীগের ক্যারাটার প্রকাশ করে। যদিও গল্পটি একটু রিসূকে– অর্থাৎ গলা খাকরি দিয়ে বলতে হয়।
মুসলিম লীগ শাসনভার হাতে নিয়ে এক কুটি গাড়োয়ানকে কিঞ্চিৎ দক্ষিণা দিলেন, সে যেন তার জাতভাইদের মধ্যে তাদের জন্য প্রচারকার্য বা প্রোপাগান্ডা করে। সে তাদের ডেকে বক্তৃতা আরম্ভ করলে, ভাই সকল, শোনো (আমি এস্থলে কুট্টি ভাষার পরিবর্তে সাধুই ব্যবহার করছি–লেখক)। আমাদের রাষ্ট্র আমাদের মায়ের মতো! মাকে যদি খাওয়া-পরাও তবে মায়ের দুধ তুমি-ই পাবে। খাজনাটা ট্যাক্সোটা ঠিকমতো দাও; মায়ের দুধ তুমিই পাবে। তখন এক ব্যাকবেঞ্চার (হেকলার) বলে উঠল, কইছ ঠিকই, লেকিন বাবা হালায় যে খাইয়া ফুরাইয়া দিল। অর্থাৎ মিনিস্টার, পলিটিশিয়ানের দলই সব লুটে নিচ্ছে।… মুসলিম লীগ, আওয়ামী লীগ কারও প্রতিই আমাদের কোনও বৈরী ভাব নেই, তবে মনে হয়, গল্পটি বহু দেশ-প্রদেশের শাসনকর্তাদের সম্বন্ধে খাটে।
***
এই কুট্টি গাড়োয়ানদের সম্বন্ধে শেষ একটি কথা বলা প্রয়োজন মনে করি।
পার্টিশনের, পূর্বে ও পরে, কি হিন্দু, কি মুসলমান সর্ব পিতামাতা নির্ভয়ে তাদের কন্যাদের কুটির গাড়িতে তুলে দিতেন। ঝড় হোক, বৃষ্টি হোক, ভূমিকম্প হোক এরা ঠিক সময়ে মেয়েদের ফের স্কুল-কলেজ থেকে ফিরিয়ে আনত। হঠাৎ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামা লেগে গেলেও এবং শুনেছি, কোনও কোনও স্থানে দাঙ্গার ফলে বাপ-মা উধাও জানতে পেরে ভালো জায়গায় তাদের পৌঁছে দিয়েছে। কুষ্টিরা এ জিম্মাদারিতে কখনও গাফিলি করেছে বলে শোনা যায়নি। এরা সত্যই শিভারাস।
আর ওই শিভালুস কথাটা এসেছে ফরাসি শেভালিয়ের থেকে। শেভাল মানে ঘোড়া!
শেভালিয়ের অর্থাৎ ঘোড়সওয়ার। একদা খানদানি ফরাসিদের ছেলেরা এই ক্যাভালরি বা অশ্ববাহিনীর সদস্য ছিল। তাই বলছিলুম, কুট্টিরা আসলে মোগল বাহিনীর ঘোড়সওয়ার ছিল।
গান্ধীজির দেশে ফেরা
১৯৩২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ইতালি থেকে জাহাজে ফিরছিলুম; ঝকঝকে চকচকে নতুন জাহাজ, তিলটি পড়লে কুড়িয়ে তোলা যায়। যাত্রী-পালের সুখ-সুবিধার তদারক করনেওয়ালা স্টুয়ার্ডের সঙ্গে আমার বেশ ভাব হয়ে গিয়েছিল। তাকে বললুম, এরকম সাফা জাহাজ কখনও দেখিনি।