এটা হল জমার দিকে কিন্তু খরচের দিকে একটা বড় লোকসান আমার কাছে ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে আসছে, নিবেদন করি।
ভদ্র এবং শিক্ষিত লোকেরই স্বভাব অপরিচিত, অর্ধপরিচিত কিংবা বিদেশির সামনে এমন ভাষা ব্যবহার না করা, যে-ভাষা বিদেশি অনায়াসে বুঝতে না পারে। তাই খাস কলকাতার শিক্ষিত লোক পুব-বাঙালির সঙ্গে কথা বলবার সময় বাস কলকাত্তাই শব্দ, মোটামুটিভাবে যেগুলোকে ঘরোয়া অথবা স্ল্যাঙ বলা যেতে পারে, ব্যবহার করেন না। তাই এন্তার, ইলাহি, বেলেল্লাবেহেড়, দোগেড়ের চ্যাং– এসব শব্দ এবং বাক্য কলকাতার ভুদ্রলোক পুব-বাঙালির সামনে সচরাচর ব্যবহার করেন না। অবশ্য যদি বক্তা সুরসিক হন এবং আসরে মাত্র একটি কিংবা দুটি ভিন্ন প্রদেশের লোক থাকেন তবে তিনি অনেক সময় আপন অজান্তেই অনেক ঝঝওলা ঘরোয়া শব্দ ব্যবহার করে ফেলেন।
ত্রিশ বৎসর পূর্বে শ্যামবাজারের ভদ্র আড়তে পুব-বাঙালির সংখ্যা থাকত অতিশয় নগণ্য। তাই শ্যামবাজারি গল্প ছোটালে এমন সব ঘরোয়া শব্দ, বাক্য, প্রবাদ ব্যবহার করতেন। এবং নয়া বাক্যভঙ্গি বানাতেন যে রসিকজনমাত্র বাহবা শাবাস না বলে থাকতে পারত না।
আজ পুব-বাংলার বহু লোক কলকাতার আসর সরগরম করে বসেছেন বলে খাঁটি কলকাত্তাই আপন ভাষা সম্বন্ধে অত্যন্ত সচেতন হয়ে গিয়েছেন এবং ঘরোয়া শব্দ-বিন্যাস ব্যবহার ক্রমেই কমিয়ে দিচ্ছেন। হয়তো এঁরা বাড়িতে এসব শব্দ এখনও ব্যবহার করেন; কিন্তু আড্ডা তো বাড়ির লোকের সঙ্গে জমজমাট হয় না– আড্ডা জমে বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে এবং সেই আড্ডাতে পুব-বাংলার সদস্যসংখ্যা ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছে বলে খাস কলকাত্তাই আপন ঘরোয়া শব্দগুলো ব্যবহার না করে করে ক্রমেই এগুলো ভুলে যাচ্ছেন। কোথায় না এসব শব্দ আস্তে আস্তে ভদ্রভাষায় স্থান পেয়ে শেষটায় অভিধানে উঠবে, উল্টো এগুলো কলকাতা থেকে অন্তর্ধান করে যাবে।
আরেক শ্রেণির খানদানি কলকাত্তাই চমৎকার বাংলা বলতেন। এঁরা ছেলেবেলায় সায়েবি ইস্কুলে পড়েছিলেন বলে বাংলা জানতেন অত্যন্ত কম এবং বাংলা সাহিত্যের সঙ্গে এদের সম্পর্ক ছিল ভাশুর-ভাদ্রবধূর। তাই এঁরা বলতেন ঠাকুরমা-দিদিমার কাছে শেখা বাঙলা এবং সে বাঙলা যে কত মধুর এবং ঝলমলে ছিল তা শুধু তারাই বলতে পারবেন যারা সে-বাংলা শুনেছেন। ক্রিক রোর মন্মথ দত্ত ছিলেন সোনার বেনে, আমার অতি অন্তরঙ্গ বন্ধু, কলকাতার অতি খানদানি ঘরে জন্ম। মন্মথদা যে-বাংলা বলতেন তার ওপর বাংলা সাহিত্যের বা পুব-বাংলার কথ্যভাষার কোনও ছাপ কখনও পড়েনি। তিনি যখনই কথা বলতে আরম্ভ করতেন, আমি মুগ্ধ হয়ে শুনতাম আর মন্মথদা উৎসাহ পেয়ে রেকাবের পর রেকাব চড়ে চড়ে একদম আসমানে উঠে যেতেন। কেউ অন্যমনস্ক হলে বলতেন, ও পরান, ঘুমুলে? মন্মথদার। কাছ থেকে এ-অধম এন্তার বাংলা শব্দ শিখেছে।
আরেকজনকে অনেক বাঙালিই চেনেন। এঁর নাম গাঙ্গুলিমশাই- ইনি ছিলেন শান্তিনিকেতনে অতিথিশালার ম্যানেজার। ইনি পিরিলি ঘরের ছেলে এবং গল্পবলার অসাধারণ অলৌকিক ক্ষমতা এর ছিল। বহুভাষাবিদ পণ্ডিত হরিনাথ দে, সুসাহিত্যিক সুরেশ সমাজপতি ছিলেন এঁর বাল্যবন্ধু এবং শুনেছি এরা এর গল্প মুগ্ধ হয়ে শুনতেন।
কলের একদিক দিয়ে গরু ঢোকানো হচ্ছে, অন্যদিক দিয়ে জলতরঙ্গের মতো ঢেউয়ে ঢেউয়ে মিলিটারি বুট বেরিয়ে আসছে, টারালাপু টারালাপ করে, গাঙ্গুলিমশাই আর অন্যান্য ক্যাডেটরা বসে আছেন পা লম্বা করে, আর জুতোগুলো ফটাফট করে ফিট হয়ে যাচ্ছে– এ গল্প শুনে শান্তিনিকেতনের কোন ছেলে হেসে কুটিপাটি হয়নি?
হায়, এ শ্রেণির লোক এখন আর দেখতে পাইনে। তবুও এখনও আমার শেষ ভরসা শ্যামবাজারের ওপর।
শ্রদ্ধেয় বসু মহাশয়ের উপাদেয় স্মৃতিমন্থন আমারও স্মৃতির ভিজে গামছাটি নিংড়ে বেশ কয়েক ফোঁটা চোখের জল বের করল।
আমিও এ বাবদ একদা একটি প্রবন্ধ লিখি। আশ্চর্য! ছাপাও হয়েছিল। এবং চাটগাঁয়ে প্রকাশিত একটি মাসিকে সেটি পুনর্মুদ্রিত হয়েছিল। আবার কোনও পুস্তকে সেটি স্থান পেয়েছে কি না, মনে পড়ছে না।
আমার মনে হয়, কুটি সম্প্রদায় (ঢাকার গাড়োয়ান শ্রেণি) একদা মোগল সৈন্যবাহিনীর ঘোড়সওয়ার সেপাই ছিল। যার ফলে তারা কুঠিবাড়ির ব্যারাকে থাকত। এবং তাই পরে এদের নাম কুট্টি হয়। পরবর্তীকালে ইংরেজবাহিনীতে এদের স্থান হয়নি বলে, কিংবা মোগলের নেমকহারামি করতে চায়নি বলে এরা ঘোড়ার গাড়ি চালাতে রু করে। কারণ ঘোড়া তাদের নিজেরই ছিল, এবং ঘোড়ার খবরদারি করতে তারা জানত। বরোদা রাজ্যেও আমি শুনতে পাই, সেখানকার কোচম্যানরাও নাকি পূর্বে মারাঠা সৈন্যবাহিনীতে ক্যালরি অঙ্গে কাজ করত। ঢাকার কুট্টিরা এককালে উর্দু বলত, পরে ঢাকা শহরের চলতি বাঙলার সঙ্গে মিশে কুট্টি ভাষার সৃষ্টি হয়। তাই তারা এখনও লেকিন, মগর এ-ধরনের শব্দ ব্যবহার করে থাকে। তবে পুব-বাঙলার মৌলবি সায়েবরাও লেকিন, মগর ছাড়া আরও বহু বহু আরবি ফারসি শব্দ বাঙাল কথা বলার সময় ব্যবহার করে থাকেন এই অঞ্চলে হিন্দু পণ্ডিতরাও যেরকম গলায় ঘা হলে বলেন, কণ্ঠদেশে ক্ষত অইছে। তাই শুনে মেডিকেল কলেজের গোরা ডাক্তার নাকি বিরক্ত হয়ে বলেছিল, চীন দেশ হ্যায়, জাপান ভি দেশ হ্যায়, ফির কণ্ঠদেশ কোন দেশ হ্যায়?