প্লেন আবার গঙ্গা ডিঙোল। ওকে তো আর খেয়ার পয়সা দিতে হয় না। কে বলেছে,
ভাগ্যিস আছিল নদী জগৎ-সংসারে
তাই লোকে কড়ি দিয়ে যেতে পারে ও-পারে।
কুট্টি
পুব-বাঙলার বিস্তর নরনারী চিরকালই কলকাতায় ছিলেন; কিন্তু এবারে কলকাতায় এসে দেখি তাদের সংখ্যা একলপতে শুয়াগাছের ডগায় উঠে গেছে। কিছুদিন পূর্বেও পুব-বাঙলার উপভাষা শুধু দক্ষিণ কলকাতাতেই শোনা যেত, এখন দেখি তামাম কলকাতায় বাঙাল ভাষার (আমি কোনও কটু অর্থে শব্দটি ব্যবহার করছিনে–শব্দটি সংক্ষিপ্ত এবং মধুর) ছয়লাপ।
বাঙাল ভাষা মিষ্ট এবং তার এমন সব গুণ আছে যার পুরো ফায়দা এখনও কোনও লেখক ওঠাননি। পুব-বাঙলার লেখকেরা ভাবেন করে শব্দ কইরা এবং অন্যান্য ক্রিয়া সম্প্রসারিত করলেই বুঝি বাঙাল ভাষার প্রতি সুবিচার হয়ে গেল। বাঙাল ভাষার আসল জোর তার নিজস্ব বাক্যভঙ্গিতে বা ইডিয়মে–অবশ্য সেগুলো ভেবে-চিন্তে ব্যবহার করতে হয়, যাতে করে সে ইডিয়ম পশ্চিমবঙ্গ তথা পুব-বাঙলার সাধারণ পাঠক পড়ে বুঝতে পারে। যেমন মনে করুন, বড়লোকের সঙ্গে টক্কর দিতে গিয়ে যদি গরিব মার খায় তবে সিলেট অঞ্চলে বলে, হাতির লগে পাতি খেলতায় গেছলায় কেনে? অর্থাৎ হাতির সঙ্গে পাতি খেলতে গিয়েছিলে কেন? কিন্তু পাতি খেলা যে polo খেলা সেকথা বাঙলা দেশের কম লোকই জানেন; (চলন্তিকা এবং জ্ঞানেন্দ্রমোহনে শব্দটি নেই। কাজেই এ ইডিয়ম ব্যবহার করলে রস ওত্রাবে না। আবার
দুষ্টু লোকের মিষ্টকথা
দিঘল ঘোমটা নারী
পানার তলার শীতল জল
তিন-ই মন্দকারী।
কামুফ্লাজ বোঝাবার উত্তম ইডিয়ম। পুব, পশ্চিম কোনও বাঙলার লোকের বুঝতে কিছুমাত্র অসুবিধে হবে না।
ইডিয়ম, প্রবাদ, নিজস্ব শব্দ ছাড়া বাঙাল সভ্যতায় আরেকটি মহগুণ আছে এবং গুণটি ঢাকা শহরের কুট্টি সম্প্রদায়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ– যদিও তার রস তাবৎ পুব-বাঙলা এবং পশ্চিম বাঙলারও কেউ কেউ চেখেছেন। কুট্টির রসপটুতা বা wit সম্পূর্ণ শহুরে বা নাগরিক–এস্থলে আমি নাগরিক শব্দটি প্রাচীন সংস্কৃত অর্থে ব্যবহার করলুম অর্থাৎ চটুল, শৌখিন, হয়তো-বা কিঞ্চিৎ ডেকাডেন্ট।
কলকাতা, লখনউ, দিল্লি, আগ্রা বহু শহরে আমি বহু বত্সর কাটিয়েছি এবং স্বীকার করি লখনউ, দিল্লিতে (ভারত বিভাগের পূর্বে) গাড়োয়ান সম্প্রদায় বেশ সুরসিক কিন্তু এদের সব্বাইকে হার মানতে হয় ঢাকার কুষ্টির কাছে। তার উইট, তার রিপার্টি (মুখে মুখে উত্তর দিয়ে বিপক্ষকে বাকশূন্য করা, ফারসি এবং উর্দুতে যাকে বলে হাজির-জবাব) এমনই তীক্ষ্ণ এবং ক্ষুরস্য ধারার ন্যায় নির্মম যে আমার সলা যদি নেন তবে বলব, কুট্টির সঙ্গে ফস করে মশকরা না-করতে যাওয়াটাই বিবেচকের কর্ম। খুলে কই।
প্রথম তা হলে একটি সর্বজনপরিচিত রসিকতা দিয়েই আরম্ভ করি। শাস্ত্রও বলেন, অরুন্ধতী-ন্যায় সর্বশ্রেষ্ঠ ন্যায়, অর্থাৎ পাঠকের চেনা জিনিস থেকে ধীরে ধীরে অচেনা জিনিসে গেলেই পাঠক অনায়াসে নতুন বস্তুটি চিনতে পারে–ইংরেজিতে এই পন্থাকেই ফ্রম সুল রুম টু দি ওয়ার্লড ওয়াইড বলে।
আমি কুট্টি ভাষা বুঝি কিন্তু বলতে পারিনে। তাই পশ্চিম-বাংলার ভাষাতেই নিবেদন করি
যাত্রী : রমনা যেতে কত নেবে?
কুট্টি গাড়োয়ান : এমনিতে তো দেড় টাকা; কিন্তু কর্তার জন্য এক টাকাতেই হবে।
যাত্রী : বল কী হে? ছ আনায় হবে না?
কুট্টি : আস্তে কন কর্তা, ঘোড়ায় শুনলে হাসবে।
এর যুতসই উত্তর আমি এখনও খুঁজে পাইনি।
মোটেই ভাববেন না যে, এ-জাতীয় রসিকতা মান্ধাতার আমলে একসঙ্গে নির্মিত হয়েছিল এবং আজও কুট্টিরা সেগুলো ভাঙিয়ে খাচ্ছে।
ঘোড়ার হাসির মতো কতকগুলি গল্প অবশ্যই কালাতীত, অজরামর, কিন্তু কুট্টি হামেশাই চেষ্টা করে নতুন নতুন পরিবেশে নতুন নতুন রসিকতা তৈরি করার।
প্রথম যখন ঢাকাতে ঘোড়দৌড় চালু হল তখন এক কুটি গিয়ে যে-ঘোড়াটাকে ব্যাক করল সেটা এল সর্বশেষে। বাবু বললেন, এ কী ঘোড়াকে ব্যাক করলে হে সক্কলের শেষে এল?
কুট্টি হেসে বলল, কন্ কী কর্তা, দেখলেন না, ঘোড়া তো নয়, বাঘের বাচ্চা; বেবাকগুলোকে খেদিয়ে নিয়ে গেল।
আমি যদি নীতি-কবি ঈসপ কিংবা সাদি হতুম, তবে নিশ্চয়ই এর থেকে মরাল ড্র করে বলতুম, একেই বলে রিয়েল, হেলথি, অপটিমিজম।
কিংবা, আরেকটি গল্প নিন, এটা একেবারে নিতান্ত এ-যুগের।
পাকিস্তান হওয়ার পর বিদেশিদের পাল্লায় পড়ে ঢাকার লোকও মর্নিং সুট, ডিনার জ্যাকেট পরতে শিখেছেন। হাঙ্গামা বাঁচাবার জন্য এক ভদ্রলোক গেছেন একটি কালো রঙ কোট বা প্রিন্সকোট বানাতে। ভদ্রলোকের রঙ মিশকালো, তদুপরি তিনি হাড়কিপটে। কালো বনাত দেখলেন, সার্জ দেখলেন, আশপাশ দেখলেন, কোনও কাপড়ই তার পছন্দ হয় না, অর্থাৎ দাম পছন্দ হয় না। যে-কুটি কোচম্যান সঙ্গে ছিল সে শেষটায় বিরক্ত হয়ে ভদ্রলোককে সদুপদেশ দিল, কর্তা, আপনি কালো কোটের জন্য খামকা পয়সা খরচা করতে যাবেন কেন? খোলা গায়ে বুকের উপর ছটা বোম, আর দু হাতে কব্জির কাছে তিনটে তিনটে করে ছটা বোতাম লাগিয়ে নিন! খাসা প্রিন্সকোট হয়ে যাবে।
তিন বৎসর পূর্বেও কলকাতায় মেলা অনুসন্ধান না করে বাখরখানি (বাকিরখানি) রুটি পাওয়া যেত না; আজ এই আমির আলি এভিতেই অন্তত আধাডজন দোকানে সাইনবোর্ডে বাখরখানি লেখা রয়েছে। তাই বিবেচনা করি, কুট্টির সব গল্পই ক্রমে ক্রমে বাখরখানির মতোই পশ্চিম-বাংলায় ছড়িয়ে পড়বে এবং তার নতুনত্বে মুগ্ধ হয়ে কোনও কৃতী লেখক সেগুলোকে আপন লেখাতে মিশিয়ে নিয়ে সাহিত্যের পর্যায়ে তুলে দেবেন– পরশুরাম যেরকম পশ্চিমবাংলার নানা হাল্কা রসিকতা ব্যবহার করে সাহিত্য সৃষ্টি করেছেন, হুতোম একদা কলকাতার নিতান্ত কনিকে সাহিত্যের সিংহাসনে বসাতে সমর্থ হয়েছিলেন।