তবে এ পুস্তিকায় মৌলিকতা কোথায়? ছত্রে ছত্রে পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায়। তিন দর্শন এক করে (প্রয়োজনমতো ইউরোপীয় দর্শন দিয়ে সেটা আমাদের আরও কাছে টেনে এনে তার সঙ্গে নিজের অক্লান্ত পরিশ্রমজনিত দীর্ঘকালব্যাপী সশ্রদ্ধ সাধনালব্ধ অমূল্য নিধি যোগ করে, কবিজনোচিত অতুলনীয় তুলনা, ব্যঞ্জনা, বর্ণনা দিয়ে অতিশয় কালোপযোগী করে তিনি এই পুস্তকখানি নির্মাণ করেছেন।
সকলেই বলে, এ পুস্তক বড় কঠিন। আমিও স্বীকার করি। তার প্রধান কারণ, দ্বিজেন্দ্রনাথ একই সময়ে একাধিক ডাইমেনশনে বিচরণ করেন। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে একথাও পুনরায় সবিনয় নিবেদন করি, এরকম কঠিন জিনিস এতখানি সরল করে ইতোপূর্বে আর কেউ লেখেননি।
———–
১. এ তথ্যগুলো প্রভাত মুখোপাধ্যায়ের রবীন্দ্রজীবনী থেকে নেওয়া।
২. আমি ভ্রমণগমনে পাঠও শুনেছি। কিন্তু স্পষ্টত জ অক্ষর– চেয়ে ভালো।
এই কবিতাটির আর একটি পাঠ আমি পেয়েছি। কোনটা আগের কোনটা পরের বলা কঠিন। মনে হয় নিম্নলিখিতটাই আগের। এটি রাজনারায়ণ বসুকে লিখিত :
দীন দ্বিজের রাজ-দর্শন না ঘটিবার কারণ।
টঙ্কা দেবী কর যদি কৃপা
না রহে কোন জ্বালা।
বিদ্যাবুদ্ধি কিছুই কিছু না
খালি ভন্মে ঘি ঢালা ॥
ইচ্ছা সম্যক্ তব দরশনে
কিন্তু পাথেয় নাস্তি
পায়ে শিক্লি মন উড়ু উড়
এ কি দৈবের শাস্তি ॥
৩. এর থেকে কিছুটা উৎসাহ পেয়েই বোধহয় সত্যেন্দ্রনাথ রচেন পিঙ্গল বিল, ব্যথিত নভতল,-! চতুষ্পদীটি আমি স্মৃতিশক্তির ওপর নির্ভর করে উদ্ধৃত করছি বলে ছন্দপতন বিচিত্র নয়। সংস্কৃত কাব্যের আদি ও মধ্যযুগে মিল থাকত না (মিল জিনিসটাই আর্য ভাষা গোষ্ঠীর কাছে অর্ধপরিচিত। পক্ষান্তরে সেমিতি আরবি ভাষাতে মিলের ছড়াছড়ি। মিলের সংস্কৃত ‘অন্ত্যানুপ্রাস শব্দটিই কেমন যেন গায়ের জোরে তৈরি বলে মনে হয়। এ নিয়ে গবেষণা হওয়া উচিত।)
৪. বসন্তে আমের বোল যেমন অকালে অজস্র ঝরিয়া পড়িয়া গাছের তলা ছাইয়া ফেলে, তেমনি স্বপ্নপ্রয়াণের কত পরিত্যক্ত পত্র বাড়িময় ছড়াছড়ি যাইত তাহার ঠিকানা নাই। বড়দাদার কবিকল্পনার এত প্রচুর প্রাণশক্তি ছিল যে, তাহার যতটা আবশাক তাহার চেয়ে তিনি ফলাইতেন অনেক বেশি। এই জন্য তিনি বিস্তর লেখা ফেলিয়া দিতেন। সেইগুলো কুড়াইয়া রাখিলে বঙ্গসাহিত্যের একটি সাজি ভরিয়া তোলা যাইত।- জীবনস্মৃতি।
৫. অবশ্য শেষ পর্যন্ত কৈবল্য লাভের পর এটিও থাকে না। গীতাতে আছে, ভূমিরাপোঞ্জলো বায়ুঃখং মনোবৃদ্ধিরেবচ অহঙ্কার ইতীয়ং মে ভিন্না প্রকৃতিরষ্টকা ॥ ভূমি জল অগ্নি বায়ু আকাশ মন বুদ্ধি অহঙ্কার (আমিত্ববোধ) এ প্রকৃতি অপরাপ্রকৃতি। প্রবন্ধের কলেবর দীর্ঘ হয়ে যাবে বলে কৈবল্য লাভে বুদ্ধির কতখানি প্রয়োজন সেটি এস্থলে না বলে পাঠককে ঠাকুর রামকৃষ্ণের কথামৃত, পঞ্চম ধরে ৪৭ পৃষ্ঠায় বরাত দিচ্ছি।
৬. দ্বিজেন্দ্রনাথের এক আত্মীয়ের (ইনি রবীন্দ্র সদনে কাজ করেন) মুখে শুননছি, রবীন্দ্রনাথ যখন তাঁর কাব্যের ইংরেজি অনুবাদ আরম্ভ করেন তখন দ্বিজেন্দ্রনাথ তাকে একদিন বলেন, এসব কাজ তুই করছিস কেন? যার দরকার সে অনুবাদ করিয়ে নেবে। তুই তোর আপন কাজ করে যা না।
৭. দেবকুমার রায়চৌধুরী, দ্বিজেন্দ্রলাল, পৃ. ৩২০
৮. যদিও দেবকুমার হতাশায় লিখেছেন তিনি এগুলো অবিকল মুদ্রিত করে দিয়েছেন, তবু আমার মনে ধোঁকা আছে যে তাঁর নকলনবিশ কোনও কোনও স্থলে ভুল করেছেন। এমনকি শান্তিনিকেতন লাইব্রেরিতে যে দ্বিজেন্দ্রলালের জীবনী রয়েছে সেটিতে চৌদ্দপুরুষ তব ত্রাণ পায় যদি স্থলে চৌদ্দপুরুষাবধি ত্রাণ পায় যদি কে যেন মার্জিনে পাঠান্তর প্রস্তাব করছেন, হস্তাক্ষরে। তাই বোধ করি হবে। কারণ প্রতি ছত্রে ভিতরের মিল, যথা সম্পত্তির সঙ্গে বৃহস্পতি, কানন-এর সঙ্গে বাহন, সত্যি-র সঙ্গে রত্তি রয়েছে। বস্তৃত দ্বিজেন্দ্রনাথের এসব রচনা কখনও পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয়নি বলে শুদ্ধপাঠ জোগাড় করা প্রায় অসম্ভব।
৯. ব্রাহ্মসমাজ ও বঙ্কিমে তখন যে বাদ-বিবাদ হয় সেসময় প্রসঙ্গক্রমে বঙ্কিম লেখেন, ’১৫ শ্ৰবণ আমার ঐ প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। তারপর অনেক রবীন্দ্রবাবুর সঙ্গে সাক্ষাৎ হইয়াছে। প্রতিবারে অনেকক্ষণ ধরিয়া কথাবার্তা হইয়াছে। কথাবার্তা প্রায় সাহিত্য বিষয়েই হইয়াছে। (বঙ্কিম রচনাবলী, সাহিত্যসংসদ, ২ খণ্ড, পৃ. ৯১৬।১৭। বলাবাহুল্য বঙ্কিম যেতেন দ্বিজেন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করতে।
১০. বস্তুত তখন বাঙলা দেশে প্রচলিত ধারণা ছিল, বিদ্যাসাগর ও কং-এর শিষ্য বঙ্কিমের। ঈশ্বরবিশ্বাস দৃঢ় নয়।
১১. তিনি একাধিকবার গীতা থেকে, প্রসন্নচেতসো ন্যস্ত বুদ্ধিঃ পর্যবতিষ্ঠতে প্রচিত্ত ব্যক্তির বুদ্ধি লক্ষ্যবস্তুতে স্থিরভাবে নিবিষ্ট হয়, ছত্রটি উদ্ধৃত করেছেন।
১২. ১৩. এ পুস্তক বোধহয় কখনও সাধারণে প্রকাশ হয়নি। প্রাইভেট সার্কুলেশনের জন্য ছিল। তার অন্যতম কারণ তাতে প্রকাশক বা প্রকাশস্থানের নাম নেই। এবং লেখক বলছেন, তিনি স্বহস্তে ছাপিয়েছিলেন।
১৪. এটি বহু বৎসর পরে বানান-সংস্কার-সমিতি গ্রহণ করেন।
১৫, পরবর্তী যুগে তিনি প্রধানত বিষয় হলে (যেমন এখানে) কী লিখতেন। অবশ্য বানান-সংস্কার-সমিতির বহু পূর্বে।