এখানে এসে আমার ব্যক্তিগত মত অসঙ্কোচে বলছি–বিড়ম্বিত হতে আপত্তি নেই, যদি শাস্ত্রজ্ঞরা বলেন, আমার মতের কীই-বা মূল্য- বাঙলা ভাষায় এরকম গ্রন্থ তো নেই-ই, ভারতীয় তথা ইংরেজি, ফরাসি, জর্মনেও ভারতীয় তত্ত্বালোচনার এমন গ্রন্থ আর নেই।
যাদের সামনে (এবং খুব সম্ভব তাদের অনুরোধেই তিনি এ গ্রন্থখানি লেখেন) তিনি এই গ্রন্থখানি পাঠ করে শোনান (পুস্তকের ভূমিকায় আছে এই গীতাপাঠ তত্ত্ববোধিনী এবং প্রবাসীতে ছাপাইতে দিবার পূর্বে সময়ে সময়ে শান্তিনিকেতনের ব্রহ্মবিদ্যালয়ের আচার্যগণের সভা আহ্বান করিয়া তাহাদিগকে উত্তরোত্তর-ক্রমে নানো হইয়াছিল) তাদের অনেকেই ইয়োরোপীয় দর্শনে সুপণ্ডিত ছিলেন। তাই তাদের বোঝার সুবিধার জন্য (আজও তাই ইয়োরোপীয় দর্শনের পণ্ডিতদের কাছে এ বইটি অমূল্য) তিনি প্রয়োজনমতো ইয়োরোপীয় দার্শনিকদের অভিমতও প্রকাশ করেছেন। দৃষ্টান্তস্বরূপ উদ্ধৃত করি : উপনিষদে আছে অবিদ্যা শব্দটি; সেটি বোঝাতে গিয়ে তিনি বলেছেন, বেদান্ত এবং সাংখ্য ছাড়া আরেক শাস্ত্র আছে; সে শাস্ত্রে বলে এই যে, ১. সাংখ্যের অচেতন প্রকৃতি, ২. কান্টের Thing-in-itself, ৩. Schopnhauer-এর অন্ধ Wil, ৪. Mil]-এর ইন্দ্রিয়-চেতনার অধিষ্ঠাত্রী নিত্যা শক্তি, ইংরাজি ভাষায়– Permanent Possibility of Sensation, ৫. বেদান্তের সদসদৃভ্যামনির্বাচনীয়া অবিদ্যা; পাঁচ শাস্ত্রের এই পাঁচ রকমের বস্তু একই বস্তু। পূর্বেই বলেছি, দ্বিজেন্দ্রনাথের মূল উপনিষদ, গীতা, মহাভারত, বেদান্ত (দর্শন) সাংখ্য ও যোগ। পাঠক আরও পাবেন, বেন্থাম, চার্বাক, সফি, স্টয়ি, ডারুইন, ভোজরাজ, যাজ্ঞবল্ক্য, জনক, ভাস্করাচার্য, সেন্ট আইস্টিন, নীলকণ্ঠ, স্পেন্সার প্রভৃতি।
সম্পূর্ণ পুস্তিকায় পাঠক পাবেন কী? এর নাম নাকি গোড়াতে ছিল গীতাপাঠের ভূমিকা পরে গীতাপাঠ-এ পরিবর্তিত হয়। সাংখ্য বেদান্ত তথা তাবৎ ইয়োরোপীয় জ্ঞান (এবং বিজ্ঞান) ও দর্শনের ভিতর দিয়ে দ্বিজেন্দ্রনাথ তরল সাধককে গীতাপাঠ এবং তার অনুশীলনে নিয়ে যেতে চান।
তাই তিনি আরম্ভ করেছেন সাংখ্য নিয়ে।
দুঃখত্রয়াভিঘাত জিজ্ঞাসা।
অর্থাৎ ত্রিবিধ দুঃখের (বাইরে থেকে, নিজের থেকে এবং দৈবদুর্বিপাকে ঘটিত দুঃখ) কীরূপে বিনাশ হইতে পারে, তাহাই জিজ্ঞাসার বিষয়। এবং সেটা যেন একান্তাভ্যন্ততোভবাৎ ক্ষণিক বা আংশিক বিনাশ না হয়; হয় যেন, ঐকান্তিক এবং আত্যন্তিক বিনাশ। কারণ, দুঃখ লোপ পেলেই সুখ দেখা দেবে। যেরকম শরীর থেকে সর্বরোগ দূর হলে স্বাস্থ্যের উদয় হয়। তা ভিন্ন স্বাস্থ্য বলে অন্য কোনও জিনিস নেই। এবং এ সুখ যা-তা সুখ নয়। উপনিষদের ভাষায় অমৃত, আনন্দ।
গ্রন্থের মাঝামাঝি এসে তিনি এই তত্ত্বটি গীতা থেকে উদ্ধৃত করে আরও পরিষ্কার করে বলেছেন :
আপূৰ্যমানমচলপ্রতিষ্ঠং সমাপঃ
প্রবিশন্তি যদবৎ।
তদবৎকামা যং প্রবিশন্তি সর্বে স
শান্তিমাপ্নোতি ন কামকামী।
অর্থাৎ স্বস্থানে অবিচলিতভাবে স্থিতি করিতেছেন যে আপূৰ্যমান সমুদ্র, তাহাতে যেমন নদনদী সকল প্রবেশ করিয়া বিলীন হইয়া যায়, তেমনি, যিনি আপনাতে স্থির থাকেন, আর, চতুর্দিক হইতে কামনা সকল যাহাতে প্রবেশ করিয়া বিলীন হইয়া যায়, তিনিই শান্তি লাভ করেন; যিনি কামনার পশ্চাৎ পশ্চাৎ ধাবমান হন– তিনি না।
এরই টীকা করতে গিয়ে তিনি তার জীবনের উদ্দেশ্য, মানবমাত্রেরই জীবনের উদ্দেশ্য অতি পরিষ্কার ভাষায় বলেছেন :
আত্মসত্তার রসাস্বাদ-জনিত একপ্রকার নিষ্কাম প্রেমানন্দ যাহা মনুষ্যের অন্তঃকরণের অন্তরতম কোষে নিয়তকাল বর্তমান রহিয়াছে, তাহা জীবাত্মার অনন্তকালের পাথেয় সম্বল, এবং সেইজন্য তাহারই পরিস্ফুটন মনুষ্যজীবনের চরম উদ্দেশ্য হওয়া উচিত। (গীতাপাঠ পৃ. ১৬২)।
এই চরম মোক্ষকেই মুসলমান সাধকেরা বলে থাকেন, ফানা ও বাকা। খ্রিষ্টীয় সাধকরা 98 atat inco FC 1691699, As the bridegroom rejoiceth over the bride, so shall the Lord rejoice over thee i
এদেশে একাধিক সাধকও ওই একই বর্ণনা দিয়েছেন।
দ্বিজেন্দ্রনাথ খুব ভালো করেই জানতেন এ যুগে কেন, সর্বযুগেই মানুষ সাধনার এই কঠিন পথ বরণ করতে চায় না। তাই তিনি গীতা পাঠের তৃতীয় অধিবেশনের অন্তে বলেছেন :
আনন্দ সম্বন্ধে এ যাহা আমি কথা প্রসঙ্গে বলিলাম– এটা সাধন পদ্মানদীর ওপারের কথা; আমরা কিন্তু রহিয়াছি এপারে কারাবদ্ধ, কাজেই আমাদের পক্ষে ওরূপ উচ্চ আনন্দের কথাবার্তার আন্দোলন এক প্রকার গাছে কাটাল– গোঁফে তেল। এরকম বাক্যবাণ আমার সহা আছে ঢের; সুতরাং উহা গ্রাহ্যের মধ্যে না আনিয়া আমার যাহা কর্তব্য মনে হইল তাহাই আমি করিলাম– যাত্রীরা পাছে নৌকাযোগে পদ্মানদী পার হইতে অনিচ্ছুক হন– এই জন্য পদ্মানদীর ওপার যে কীরূপ রমণীয় স্থান তাহা দুরবীনযোগে (অর্থাৎ প্রথম তিন অধিবেশনে তিনি যে অবতরণিকা নির্মাণ করেছেন তা দিয়ে লেখক) তাহাদিগকে দেখাইলাম। এখন নৌকা আরোহণ করিবার সময় উপস্থিত; অতএব যাত্রী ভায়ারা পেট্রলাপুঁটুলি বাঁধিয়া প্রস্তুত হউন।(২১)
এই অমূল্য পুস্তকের গুণাগুণ বিচার করা আমার জ্ঞানবুদ্ধি ত্রিসীমানার বাইরে। তবে বর্ণনা দিতে গিয়ে এইটুকু নিবেদন করতে পারি, জড়-প্রকৃতি, জীব-প্রকৃতি, তথা জীবের সুখ-দুঃখ বিশ্লেষণ করার সময় তিনি প্রধানত শরণ নিয়েছেন সাংখ্যের, সাধনার যে পন্থা অবলম্বন করেছেন সেটি যোগের এবং আস্থা ও আশা রেখেছেন বেদান্তের ওপর।