প্রথম পাঠ সাঙ্গ হলে কবি-মাস্টার ভরসা দিচ্ছেন পুরো লেখা সাঙ্গ হবে অর্ধেক পাতায়। এবং তদুপরি
কাগজ বাঁচিবে ঢের নাহি তায় ভুল।
বাঁচিতেও পারে কিছু ডাকের মাশুল।
এ না হয় হল। কিন্তু গড়ের মাঠে যখন কংগ্রেসিরা (তখনও কনিষ্টি আসেননি), বাক্যের ঝড় বওয়াবেন তখন? তখন কি সেটা শব্দে শব্দে ভোলা যাবে না।
ওবিদ্যার কর্ম নহে- যখন বক্তার
মুখে ঝড় বহি চলে ছাড়ি হুহুকার
তার সঙ্গে লেখনীর টক লাগানো
এ বিদ্যা দ্বিতীয় খণ্ডে হয়েছে বাগানো।
তখন
মস্তকে মথিয়া লয়ে পুস্তকের সার,
হস্তকে করিবে তার তুরুক-সোআর।
হইবে লেখনী ঘোড় দোউড়ের ঘোড়া
আগে কিন্তু পাকা করি বাঁধা চাই গোড়া।
এবং দ্বিতীয় খরে পুস্তক সমাপ্তিতে বলছেন;
তখন তাহাকে হবে থামানো কঠিন।
ছুটিবে– পরাণ ভয়ে যেমতি হরিণ।
এই বইয়ে প্রতিটি ছত্র তুলে দিতে ইচ্ছে করে। কিন্তু স্থানাভাব। তবে সর্বশেষে কয়েকটি ছত্র না তুলে দিলে সে আমলের কয়েকটি তরুণ আজ তারা বৃদ্ধ– মর্মাহত হবেন। কারণ রেখাক্ষর তারা না শিখলেও এ কবিতাটি মুখে মুখে এতই ছড়িয়ে পড়েছিল যে, আজও সেটি কিয়নের কণ্ঠস্থ :
আনন্দের বৃন্দাবন আজি অন্ধকার।
গুঞ্জরে না ভৃঙ্গকুল কুঞ্জবনে আর(১৭)
কদম্বের তলে যায় বংশী গড়াগড়ি
উপুড় হইয়া ডিঙ্গা পঙ্কে আছে পড়ি।
কালিন্দীর কূলে বসি কান্দে গোপনারী,
তরঙ্গিণী তরাইবে কে আর কাণ্ডারী(১৮)
আর কি সে মনোচোর দেখা দিবে চক্ষে
সিন্ধিকাঠি থুয়ে গেছে বিন্ধাইয়া বক্ষে ॥
কৃষ্ণ গেছে গোষ্ঠ ছাড়ি রাষ্ট(১৯) পথে হাটে।
শুষ্ক মুখ রাধিকার দুখে বুক ফাটে।
কৃষ্ণ বলি ভ্রষ্ট বেণী বক্ষে ধরি চাপি।
ভূপৃষ্ঠে লুটায় পড়ে মর্মদাহে ভাপি।
কষ্ট বলে অষ্ট সখী মমদাহে কোলে
চিন্তা করিও না রাই কৃষ্ণ এল বলে।
এত বলি হাহু করে বাষ্প আর মোছে।
সবারই সমান দশা কেবা কারে পোছে।
দুষ্ট বধে পূরে নাই কৃষ্ণের অভীষ্ট।
অদৃষ্টে অবলাবধ আছে অবশিষ্ট। (২০)
কে বলবে প্রথমাংশ লেখা হয়েছে ন, ঙ, ম-প্রধান যুক্তাক্ষর ও দ্বিতীয়টি স্ব-প্রধান যুক্তাক্ষরের অনুশীলনের জন্য! আরেকটি কথা এই সুবাদে নিবেদন করি আমার এক আত্মজনের মুখে শোনা : বঙ্কিমচন্দ্র যখন তার কৃষ্ণচরিত্রে প্রমাণ করতে চাইলেন, গীতার শ্রীকৃষ্ণ আর বৃন্দাবনের শ্রীকৃষ্ণ এক ব্যক্তি নন, তখন দ্বিজেন্দ্রনাথ নাকি রবীন্দ্রনাথের কাছে এসে বলেন, বঙ্কিমবাবু, এসব কী আরম্ভ করলেন, রবি? বৃন্দাবনের রসরাজকে মেরে ফেলছেন যে! বাঙলা সাহিত্য বৈষ্ণব পদাবলীর ওপর কতখানি খাড়া, আজ সেটা স্বীকার করতে আমাদের আর বাধে না। কিন্তু সেই মারাত্মক পিউরিটান যুগে, যখন কেউ কেউ নাকি কদম্ববৃক্ষকে অশ্লীলবৃক্ষ (এটা অবশ্য বিরুদ্ধপক্ষের ব্যঙ্গ- রিডাকসিও অ্যাড আবসার্ডাম পদ্ধতিতে) বলতেন তখন দ্বিজেন্দ্রনাথ জানতেন, বৃন্দাবনের শ্রীকৃষ্ণকে গীতার শ্রীকৃষ্ণ থেকে ভিন্ন করে ফেললে বৃন্দাবন-লীলা নিতান্তই মানবিক প্রেমে পর্যবসিত হয়; ভক্তজন তাঁদের আধ্যাত্মিক অমৃত থেকে বঞ্চিত হবেন।
প্রথম যৌবন থেকেই দ্বিজেন্দ্রনাথ ধর্ম-সঙ্গীত রচনা আরম্ভ করেন। রবীন্দ্রনাথ জীবনস্মৃতিতে লিখেছেন তাঁর এগারো বছর বয়সে আমি বেহাগে গান গাহিতেছি–
তুমি বিনা কে প্রভু সংকট নিবারে
সে সহায় ভব-অন্ধকারে
তিনি (পিতা) নিস্তব্ধ হইয়া নতশিরে কোলের উপর দুই হাত জোড় করিয়া শুনিতেছেন– সেই সন্ধ্যাবেলাটির ছবি আজও মনে পড়িতেছে।
এই গানটি দ্বিজেন্দ্রনাথের রচনা; এবং রেখাক্ষর বর্ণমালাতেও তিনি অনুশীলন হিসেবে এটি উদ্ধৃত করেছেন। যদিও ব্রহ্মসঙ্গীতে তার মাত্র ত্রিশাট গান পাওয়া যায়, তবু এ বিষয়ে সন্দেহ নেই তিনি বিস্তর গান রচনা করেছিলেন। কিন্তু তিনি নিজের রচনা সম্বন্ধে এমনই উদাসীন ছিলেন একথা পূর্বেই উল্লেখ করেছি যে সেগুলো বাঁচিয়ে রাখবার কোনও প্রয়োজন বোধ করেননি।
ধীরে ধীরে তিনি সাহিত্য, কাব্য, সঙ্গীত, শব্দতত্ত্ব, ইতিহাসের দর্শন সব জিনিস থেকে বিদায় নিয়ে ভারতীয় তত্ত্বজ্ঞান ও তার অনুশীলনে নিযুক্ত হলেন। এ যে কী অভ্রভেদী দুর্জয় সাধনা তার বর্ণনা দেবার শাস্ত্রাধিকার আমার নেই। একদিকে ইয়োরোপীয় দর্শন তাঁর নখদর্পণে ছিল। অন্যদিকে বেদান্ত, সাংখ্য এবং মোগ– উপনিষদ, গীতা এবং মহাভারতের তত্ত্বাংশ। ভারতীয় তত্ত্বজ্ঞান শুধু স্পেকুলেট তথা তর্কবিতর্ক করতে শেখায় না। গোড়ার থেকেই ধ্যানধারণা, সাধনা করতে হয়। ভারতীয় তত্ত্বজ্ঞান মেন্টাল জিমনাস্টিক নয়।
দ্বিজেন্দ্রনাথ শাস্ত্রচর্চার সঙ্গে সঙ্গে ধ্যানধারণায় মগ্ন হলেন।
এখনও বাঙলা দেশে বিস্তর না হোক, বেশকিছু লোক বেঁচে আছেন যারা তার সে ধ্যানমূর্তি দিনের পর দিন দেখেছেন। সুর্যোদয়ের বহু পূর্বেই তিনি আগের দিনের বাসি জলে স্নান করে ধ্যানে বসতেন। সেসময় ছোট ছোট পাখি, কাঠবেড়ালি তাঁর গায়ের উপর বসত, ওঠা-নামা করত। ঘন্টার পর ঘন্টা কেটে যেত। পাখিরা অপেক্ষা করত, ধ্যান ভঙ্গের পর তিনি তাদের খাওয়াবেন। ময়দার গুলি বানিয়ে মুনীশ্বর তার ব্যবস্থা করে রাখত।
বহু বৎসর একাগ্রচিত্তে ধ্যানধারণা ও শাস্ত্র-চর্চার ফলস্বরূপ তার গ্রন্থ, বাঙলা তত্ত্বকথার অতুলনীয় সম্পদ, গীতাপাঠ।