***
তাঁর সাহিত্যচর্চা, বিশেষত স্বপ্নপ্রয়াণ, মেঘদূতের বঙ্গানুবাদ ও অন্যান্য কাব্য শ্রীযুক্ত সুকুমার সেন তার ইতিহাস গ্রন্থে অত্যুত্তম আলোচনা করেছেন। বস্তুত তিনি দ্বিজেন্দ্রনাথকে উপেক্ষা করেননি বলে বঙ্গজন তার কাছে কৃতজ্ঞ। এ নিয়ে আরও আলোচনা হলে ভালো হয়।
আশ্চর্য বোধ হয়, এই সাতিশয় অন-প্রাকটিক্যাল, অধ্যবসায়ী লোকটি কেন যে বাঙলায় শর্টহ্যান্ড প্রচলন করার জন্য উঠে-পড়ে লাগলেন! এ কাজে তার মূল্যবান সময় তো একাধিকবার গেলই, তদুপরি আগাগোড়া বইখানা–দু দুবার-ব্লকে ছাপতে হয়েছে, কারণ তিনি যেসব সাংকেতিক চিহ্ন (সিম্বল) আবিষ্কার করে ব্যবহার করেছেন সেগুলো প্রেসে থাকার কথা নয়। তদুপরি মাঝে মাঝে পাখি, মানুষের মুখ, এসবের ছবিও তিনি আপন হাতে একে দিয়েছেন।
প্রথমবারের প্রচেষ্টা পুস্তকাকারে প্রকাশের(১২) বহু পরে তিনি দ্বিতীয় প্রচেষ্টা দেন। তার প্রাক্কালে তিনি বিধুশেখরকে যে পত্র দেন সেটি প্রথম (কিংবা দ্বিতীয় প্রচেষ্টার পুস্তকের ভিতর একখানি চিরকুটে আমি পেয়েছি। তাতে লেখা,
শাস্ত্রী মহাশয়,
আমি বহু পূর্বে হোলদে কাগজে রেখাক্ষর স্বহস্তে ছাপাইয়াছিলাম১৩-লাইব্রেরিতে তাহার গোটা চার-পাঁচ কপি আছে। তাহার একখানি পাঠাইয়া দিন। নিচে স্বাক্ষর নেই। শুনেছি, স্বৰ্গত রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের অনুরোধে তিনি দ্বিতীয়বার একখানি পূর্ণাঙ্গ পুস্তক রচনা করেন। প্রথমখানির সঙ্গে দ্বিতীয়খানি মিলালেই ধরা পড়ে যে, তিনি এবারে প্রায় সম্পূর্ণ নতুন করে বইখানা লিখলেন। এটির প্রকাশ ১৩১৯ সনে।
এবং বই দুইখানি না দেখা পর্যন্ত কেউ বিশ্বাস করবেন না যে, শর্টহ্যান্ডের মতো রসকষহীন বিষয়বস্তু তিনি আগাগোড়া লিখেছেন পদ্যে–নানাবিধ ছন্দ ব্যবহার করে।
প্রথমেই তিনি লেগেছেন বাঙলার অক্ষর কমাতে; লিখেছেন–
রেখাক্ষর বর্ণমালা
॥ প্রথম ভাগ ॥
বত্রিশ সিংহাসন।
বাঙলা বর্ণমালায় উপসর্গ নানা।
অদৃভুত নূতন সব কাণ্ডকারখানা।
য-যে শূন্য, ড-য়ে শূন্য, শূন্য পালে পাল!
দেবনাগরিতে নাই এসব জঞ্জাল।
য যবে জমকি বসে শবদের মুড়া।
জ বলে সবাই তারে কি ছেলে কি বুড়া ॥
মাজায় কিম্বা ল্যাজায় নিবসে যখন।
ইয় উচ্চারণ তার কে করে বারণ।
ময়ূর ময়ূর বই মজুর তো নয়।
উদয় উদজ নহে, উদ্য উদয়।
এরপর তাঁর বক্তব্য ছবি দিয়ে দৃষ্টি আকৃষ্ট করে তিনি ড ঢ ও ড় ঢ় নিয়ে পড়লেন :
কেন এ ঘোড়ার ডিম ড-য়ের তলায়।
বুঢ়াটাও ডিম পাড়ে! বাঁচিনে জ্বালায়?
একি দেখি! বাঙ্গালার বর্ণমালী যত
সকলেই আমা সনে লঢ়িতে উদ্যত।
ব্যাকরণ না জানিয়া অকারণ লঢ়।
শবদের অন্তে মাঝে ড ঢ-ই তো ড় ঢ়।
দ্বিতীয় সংস্করণে ব্যাপারটি তিনি আরও সংক্ষেপে সারছেন :
শূন্যের শূন্যত্ব
শবদের অন্তে মাঝে বসে যবে সুখে।
বেরোয় য়-ড়-ঢ় বুলি য-ড-ঢ’র মুখে।
জানো যদি, কেন তবে শূন্য দেও নীচে?
চেনা বামুনের গলে পৈতে কেন মিছে!
নীচের ছত্তর চারি চেঁচাইয়া পড়–
যাবৎ না হয় তাহা কষ্ট্রে সড়গড়।
পাঠ
আষাঢ়ে ঢাকিল নভ পয়োধর-জালে।
বায়স উড়িয়া বসে ডালের আড়ালে।
ঘনরবে ময়ূরের আনন্দ না ধরে।
খুলিয়া খড়ম জোড়া ঢুকিলাম ঘরে।
একেই বোধহয় গ্রিক অলঙ্কারের অনুকরণে ইংরেজিতে বেথস বলা হয়। প্রথম তিন লাইনে নৈসর্গিক বর্ণনার মায়াজাল নির্মাণ করে হঠাৎ খড়ম-জোড়ার মুদার দিয়ে আলঙ্কারিক মোহ-মুদার নির্মাণ।
ছন্দ মিল ব্যঞ্জনা অনুপ্রাসকবিতা রচনার যে কটি টেকনিক্যাল স্কিল প্রয়োজন তার সবটাই কবির করায়ত্ত। কোনটা ছেড়ে কোনটা নিই! এর পরেই দেখুন সাদামাটা পয়ার ভেঙে ১১ অক্ষরের (!) ছন্দ :
চারি কর্মপতি
ক চ-বগের ক মহারথী :
ত প-বরগের ত কুলপতি,
ন ট-বরগের ন নটবর;
র স-বরগের গুণধর;–
চারি বরগের চারি অধিপ
বরণমালার প্রদীপ ॥
শুধু তাই নয়, পাঠক লক্ষ করবেন, প্রথম চার ছত্রের প্রথম অংশে ছ অক্ষর, শেষের অংশে চার অক্ষর; ফলে জোর পড়বে সপ্তম অক্ষর ক, ত, ন, র-এর ওপর। এবং সেইটেই লেখকের উদ্দেশ্য, জোর দিয়ে শেখানো।
এই যুগে অনেকেই বৈষ্ণবদের ঢলাঢলি পছন্দ করতেন না। দ্বিজেন্দ্রনাথ তাঁদের বহু ঊর্ধ্বে। তাই :
এই এউ আউ ইত্যাদি ডিফথং-এর অনুশীলন করাতে এগুলো নিয়ে কীরকম কবিতা ফেঁদেছেন, দেখুন :
আউলে গোঁসাই গউর চাঁদ
ভাসাইল দেশ টুটিয়া বাঁধ
দুই ভাই মিলি আসিছে অই(১৪)
কী(১৫) মাধুরী আহা কেমনে কই।
পাষাণ হৃদয় করিয়া জয়
আধাআধি করি বাঁটিয়া লয়
শওশ হাজার দোধারি লোক।
দোঁহারে নেহারে ফেরে না চোক।
কূল ধসানিয়া প্রেমের ঢেউ
দেখেনি এমন কোথাও কেউ
এই নাচে গায় দুহাত তুলি।
এই কাঁদে এই লুটায় ধূলি।
কে বলবে এটা নিছক রসসৃষ্টি নয়, অন্য উদ্দেশ্য নিয়ে রচনা? নিতান্ত গদ্যময় শর্ট্যান্ড-পদ্যে!
এর পর তিনি যেটা প্রস্তাব করেছেন সেটি বহু বৎসর পরে মেনে নেওয়া হল :
শুনিবে গুরুজি মোর কি বলেন? শোনো!
চেলা শিরে তেল দিয়া ফল নাই কোনও
আর-ত দিলে আর্ত-এ ছাড়িবে আর্তরব।
আর-দ চাপাইলে পিঠে রবে না গর্দভ।
ইট করিও না নষ্ট বোঝা করি পুষ্ট।
অর্ধে(১৬) দিয়া জলে ফেলি অর্ধে থাক তুষ্ট।
কর্মের ম এ ম ফলা অকর্ম বিশেষ।
কার্য্যের যয়ে য ফলা অকার্যের শেষ।